আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ২৭-০৫-২০১৯ তারিখে পত্রিকা

ভেজালে জীবন অতিষ্ঠ

বিশ্বজিত রায়
| সম্পাদকীয়

ভেজালের বিষে ভুগছে জীবন। থামানো যাচ্ছে না ভেজালের এই অনিরাপদ পথচলা। তাই খাদ্যে ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় হাইকোর্ট বলেছেন, সরকার মাদকের বিরুদ্ধে যেমন যুদ্ধ পরিচালনা করেছে, তেমনি খাদ্যে ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে জরুরি অবস্থা জারি করে অভিযান পরিচালনা করতে সরকারি দল ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ রাখছি। ভোক্তা অধিকার সংস্থা ‘কনসাস কনজুমার্স সোসাইটি’র (সিসিএস) করা এক রিট আবেদনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভেজাল ও নিম্নমানের ৫২টি পণ্য বাজার থেকে সরানোর নির্দেশনা দিতে গিয়ে হাইকোর্ট এ অনুরোধ জানান। এছাড়া হাইকোর্ট তার পর্যবেক্ষণে আরও বলেছেন, খাদ্যে ভেজাল রোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা শুধু একজন কর্মকর্তা হিসেবে নন, একজন দেশপ্রেমিক হিসেবে জনগণের প্রতি ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতা থেকে অর্পিত দায়িত্ব পালন করবেন বলে এ আদালত প্রত্যাশা করছেন। সরকার ও সরকারের সব সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্তরা যদি সঠিকভাবে কাজ করতেন তাহলে ভেজাল রুখতে হাইকোর্ট এভাবে অনুরোধ জানাতেন না। 
এ দেশে ভেজাল কতটুকু অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে হাইকোর্টের প্রতিক্রিয়ায় তা পরিষ্কারভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। দেশের মানুষ যেন ভেজালের কাছে অসহায়। বাধ্য হয়েই ভেজাল অর্থাৎ বিষযুক্ত খাবার গ্রহণ করছে মানুষ। মাত্রাতিরিক্ত ভেজালের দৌরাত্ম্য দেখে আদালত এও বলেছেন, যে পরিস্থিতি দেখছি তাতে এ দেশে থাকাটাই অনিরাপদ হয়ে গেছে। দুধের কি অবস্থা দেখুন। দুধে পানি মেশানো হচ্ছে। ইটের গুঁড়ো দিয়ে মশলা বানাচ্ছে, ভুসি দিয়ে মশলা বানানো হচ্ছে। এই ভেজালের কারণে গত ১০ বছরে দেশে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে। (সূত্র : কালের কণ্ঠ, ১৩.০৫.১৯)।
ভেজালের ভয়ানক যাত্রায় হেঁটে চলেছে বাংলাদেশ। ভেজাল বিষাক্ত দেশে ভেজালমুক্ত খাবার খাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বরং ভেজালযুক্ত হওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারবে যে কেউ। আমাদের সার্বিক জীবন ব্যবস্থায় ভেজালের বিভীষিকাময় কর্তৃত্ব সুস্থ-সবল জীবন ধারণের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বলতে লজ্জা হয়, তারপরও বলতে হয়, বাংলাদেশটা যেন ভেজালের বিস্ময় ভূমিতে পরিণত হয়েছে। আর এ দেশের অধম মানুষই ভেজালের ভয়ংকর কারিগর। আর এটা আমাদের দেশে চলছে অনেকটা প্রকাশ্যে, সহাস্যে, স্বমহিমায়। ভেজালকারী মুনাফাখোর মন্দ মানুষ ভেজালে ভেজালে পুরো দেশকে গিলে খাওয়ার তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু চালিয়ে যাচ্ছে বললে ভুল হবে, ভেজালের বিপন্ন ভূমিতে পরিণত করেছে বাংলাদেশকে। পৃথিবীর সভ্য কোনো দেশে জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এসব অপকর্ম চলতে পারে কি না, সে বিষয়ে প্রশ্ন উঠছে। ভেজালের উদ্ভট পিঠে চড়া বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে জানতে ইচ্ছে করছে, ভেজালের ছাড়পত্র দিয়ে ভেজালকারীদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে কি না। হাইকোর্ট অনতিবিলম্বে ভেজাল ও নিম্নমানের যে ৫২টি পণ্য বাজার থেকে সরাতে নির্দেশ দিয়েছেন তার অধিকাংশই নামিদামি কোম্পানির। এছাড়া বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের হাইকোর্টে জমা দেওয়া এক প্রতিবেদনে কাঁচা তরল দুধের ৯৬টি নমুনার মধ্যে ৯৩টিতেই ক্ষতিকর উপাদান পাওয়া গেছে, সেখানেও ভালো কোম্পানির নাম থাকতে পারে। এই নামিদামি ভালো কোম্পানিগুলো কীভাবে পণ্যে নিম্নমান ও ভেজাল দিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে? এদের ভেজাল অপকর্মে কেউ খবর রাখছে না বিধায় তারা তাদের মতো করে ভেজাল মেশাচ্ছে।
ভেজালে ভেজালে মানুষ মারার অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করছে ভেজালকারীরা। মুনাফাখোর এই লোভী মানুষ ‘মানুষ মরে মরুক, তবুও অঢেল অর্থ কামানো চাই’ মানসে বাধাহীনভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। দেহ গঠনে অত্যন্ত কার্যকরী দুধটাও ভেজালকারীদের নোংরা অপকর্মের শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ অনুজৈবিক বিশ্লেষণ রিপোর্ট অনুযায়ী, তরল দুধের ৯৩টি নমুনায় টিপিসি ও কলিফরম কাউন্ট ক্ষতিকর মাত্রায় বিদ্যমান এবং একটি নমুনায় সালমোনেলা পাওয়া গেছে। রাসায়নিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ৫টি নমুনায় সিসা, ৩টিতে আফলাটক্সিন, ১০টিতে টেট্টাসাইক্লিন, একটিতে সিপ্রোফ্লক্সাসিন এবং ৯টিতে পেস্টিসাইট ক্ষতিকর মাত্রায় পাওয়া যায়। প্যাকেটজাত তরল দুধের ৩১টি নমুনার (দেশি ২১টি এবং আমদানি করা ১০টি) মধ্যে ১৭টি দেশি দুধের নমুনায় টিপিসি ও কলিফরম কাউন্ট, ১৪টিতে মোল্ডস এবং আমদানি করা তরল দুধের একটি নমুনায় কলিফরম কাউন্ট ক্ষতিকর মাত্রায় বিদ্যমান। রাসায়নিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশি দুধের একটি নমুনায় আফলাটক্সিন, ছয়টিতে টেট্টাসাইক্লিন এবং আমদানি দুধের তিনটিতে টেট্টাসাইক্লিন ক্ষতিকর মাত্রায় রয়েছে। দইয়ের ৩৩টি নমুনার ১৭টিতে টিপিসি, ৬টিতে পলিফরম কাউন্ট, ১৭টিতে ইস্ট/মোল্ড এবং একটিতে সিসা ক্ষতিকর মাত্রায় বিদ্যমান। পশুখাদ্যের ৩০টির মধ্যে ১৬টিতে ক্রোমিয়াম, ৪টিতে আফলাটক্সিন, ২২টিতে টেট্টাসাইক্লিন, ২৬টিতে এনরোফ্লক্সাসিন, ৩০টিতে সিফরোফ্লক্সাসিন এবং ২টিতে পেস্টিসাইট (এন্ডসালফান) ক্ষতিকর মাত্রায় বিদ্যমান। (সূত্র : ইত্তেফাক, ০৯.০৫.১৯)।
নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যসহ প্রায় সবকিছুতেই কোনো না কোনোভাবে ভেজাল মিশ্রিত রয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির উদ্যোগে দেশে পরিচালিত এক গবেষণায় চালে মারাত্মক ক্ষতিকর ভারি ধাতুর উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। এতে চালের ২৩২ নমুনার মধ্যে ১৩১টিতে বিভিন্ন মাত্রায় মানুষের জন্য বিপজ্জনক ক্রোমিয়াম, ১৩০টিতে ক্যাডমিয়াম, সমসংখ্যক নমুনায় সিসা, ৮৩টিতে আর্সেনিকের অস্তিত্ব মিলেছে। এছাড়া ২০টি নমুনার মধ্যে তিনটিতে পাওয়া যায় আফলাটক্সিন। এ ক্ষেত্রে আফলাটক্সিনের মাত্রা (০.০০০৪-০.০০১৩) সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার (০.০১) নিচে থাকলেও ৫৬টি নমুনায় ক্রোমিয়াম, ১৭টিতে ক্যাডমিয়াম, ২২টিতে সিসা এবং পাঁচটিতে আর্সেনিক শনাক্ত হয়েছে মানুষের শরীরে সহনীয় মাত্রার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। কয়েক বছর আগে এক গবেষণায় শাকসবজি, চিংড়ি ও শুঁটকিতে ক্ষতিকর মাত্রায় কীটনাশকের অস্তিত্ব পেয়েছিল বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। ২০১৫ সালের মার্চে অষ্টম ওয়ান হেলথ বাংলাদেশ সম্মেলনে উপস্থিত এ সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, এখনই ব্যবস্থা না নিলে কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে। এ সতর্কতার পরও ভেজাল ব্যবহার বাড়ছে বৈ কমছে না।
আমরা যে শাকসবজি ও ফলমূল নিত্য খাচ্ছি তা মোটেও নির্ভেজাল নয়। কীটপতঙ্গের আক্রমণ থেকে শাকসবজি ও ফলমূল রক্ষা করার জন্য একদিকে ব্যবহার করা হয় কীটনাশক এবং ফলমূল পাকানো ও পচন রোধের জন্য অন্যদিকে ব্যবহার করা হচ্ছে ক্যালসিয়াম কার্বাইড ও ফরমালিন। আপেল, টমেটো, জাম, মরিচ, আঙুর, লেটুস, ব্রুকলি, স্ট্রবেরি, পালংশাক, সবুজ শিম, মটরশুঁটি, বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি, পটোল, শসা, ঢ্যাঁড়শ, করলা ইত্যাদিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। যে শাকসবজি বা ফলমূল মানুষ খায়, তাতে ব্যবহৃত ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ফরমালিন ও কীটনাশক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মানবদেহের অপূরণীয় ক্ষতি ডেকে আনছে। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ৩০ লাখ মানুষ কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয় এবং দুই লাখ ২০ হাজার মানুষ মারা যায়। এসব মৃত্যুর বেশির ভাগ ঘটে অনুন্নত বিশ্বে। কীটনাশক ব্যবহারে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কৃষকের প্রশিক্ষণ থাকে না এবং এই কারণে কীটনাশকের অপব্যবহার হয়। কীটনাশকের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিভিন্ন বয়সি মানুষ। (সূত্র : কালের কণ্ঠ, ১৪.০৫.১৯)।
আমাদের দেশে ভেজাল এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখান থেকে ফেরাটা প্রায় যুদ্ধের শামিল অবস্থা। আমরা প্রতিনিয়ত যা গ্রহণ করছি সবকিছুতেই ভেজাল বিদ্যমান। এসব ভেজাল আমাদের স্বাভাবিক জীবনকে মুমূর্ষু পথে ঠেলে দিচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য থেকে শুরু করে যে কোনো খাদ্যদ্রব্যে ভেজালের আধিপত্য বিরাট আকার ধারণ করেছে। এই ভেজালের সুবাদে আমাদের দেহে নানা রকম রোগব্যাধি বিস্তার লাভ করছে। ভেজালের সঙ্গে নিত্য বসবাস করছি আমরা। ঘর থেকে বের হলেই ভেজালের খিলবিল খেলা সুস্থ ভাবনায় সর্বদা অসুস্থতার জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। আমরা অনেকে জেনেশুনে, কেউবা না জেনে না বুঝে ভেজাল মিশ্রিত বিষ নিয়ে বাড়ি ফিরছি। সোজা কথায় বলতে গেলে আমরা সবাই টাকা দিয়ে বিষ কিনে খাচ্ছি। বিষক্রিয়ায় মানুষ তাৎক্ষণিক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, আর ভেজাল গ্রহণে মানুষ রোগে-শোকে দীর্ঘ যন্ত্রণা ভোগ করে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। এই ভেজাল থেকে মুক্তি পেতে চায় মানুষ।
ভেজাল আমাদের সর্বদিকে গ্রাস করে ফেলেছে। আমরা সর্বদা যা হাতে নিচ্ছি সবকিছুতেই ভেজাল অর্থাৎ দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর উপাদান মিশ্রিত রয়েছে। মাছ-মাংস, দুধ-ডিম, তেল-ঘি, ফলমূল, তরিতরকারি ও প্যাকেটজাত দ্রব্য থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় এমন কোনো পণ্য বাদ নেই যেখানে ভেজাল বিদ্যমান নেই। এসব ভেজাল খেতে খেতে আমরা ভেজাল সহনীয় পর্যায়ে চলে গেছি। একপর্যায়ে দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াচ্ছি। এভাবে কি জীবন চলে? প্রশ্নটা রাষ্ট্রযন্ত্রের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলসহ সবার কাছে রেখে বলতে চাচ্ছিÑ ভেজালকারীরা কি রাষ্ট্রযন্ত্র থেকেও শক্তিশালী? ভেজালে বিপন্ন বাংলাদেশের পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, রাষ্ট্র এদের কাছে নতজানু। নইলে দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়কে কেন এ ব্যাপারে অনুরোধ করতে হবে। সরকারের কি কোনো দায়িত্ব নেই? স্বাস্থ্যসম্মত নিরাপদ খাবারের সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিতে সরকারের বাধ্যবাধকতা থাকলেও এক্ষেত্রে সরকার ও সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা একেবারে অসহায়। এই অসহ্যকর ভেজাল বিষক্রিয়া থেকে বাঁচতে সরকারকে সরকার ও সরকারের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা ভেজালবান্ধব শক্তিশালী চক্রের বিষদাঁত ভেঙে দিতে হবে। ভেজালে বিদ্যমান আইনের ধারা পরিবর্তন করে কঠোর ধারা যুক্ত করতে হবে। এভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে কিছু অর্থদ- দিয়ে ভেজালকারীদের ছেড়ে দিলে চলবে না। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এখনই এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন।

 বিশ্বজিত রায়
সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]