রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া জটিল থেকে জটিলতর দেখছি। ১১ লাখের অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশের টেকনাফের বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে অবস্থান করছে। এখনও তাদের আসা থেমে নেই। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দপ্তর ও মিয়ানমার সরকার বৈঠকের পর বৈঠক করছে বলে শুনতে পাচ্ছি। আট হাজারের অধিক রোহিঙ্গা পরিবারের একটি তালিকা বাংলাদেশের পক্ষে হস্তান্তর করা হয়েছে। এর মধ্যে এখনও রোহিঙ্গা আগমন অব্যাহত আছে। খবর আছে, রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে দেশি-বিদেশি এনজিও ষড়যন্ত্র করছে। পৃথিবীর নানা দেশের অনেকগুলো এনজিও এখানে তাদের নিয়ে পুনর্বাসনের কথা বলে রোহিঙ্গাদের বিভ্রান্ত করছে। সাহায্য ও সহযোগিতার প্রলোভনে ক্যাম্পে ক্যাম্পে রোহিঙ্গা যুবকদের সন্ত্রাসী কর্মকা-ে উদ্বুদ্ধ করার সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিবেশ ধ্বংস করতে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তৎপর। রোহিঙ্গা যুবকদের প্রশিক্ষণের নামে সন্ত্রাসী হিসেবে তৈরি করার কথা শোনা যাচ্ছে। ক্যাম্পে ও ক্যাম্পের বাইরে অনেক রোহিঙ্গা যুবক সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। অনেকে আশ্রয় ক্যাম্প ত্যাগ করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে। ওই এলাকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন পরিবেশ হুমকির মধ্যে। গাছপালা, পাহাড়, টিলা, ভূমি কর্তন করে বেড়ে উঠেছে রোহিঙ্গাদের আবাসন। তাদের আশ্রয়ে হাজার হাজার একর পাহাড় গাছগাছালি ধ্বংস, পশুপাখির বিচরণ মারাত্মকভাবে শূন্যের কোঠায়। অতিথি পাখিদের সেখানে আর ঠিকানা হচ্ছে না। বিলুপ্ত হচ্ছে এসব পাখি। লাখ লাখ বাংলাদেশি নাগরিক সেখানে বেকার হচ্ছে। মিল-কারাখানায় রোহিঙ্গারা ঢুকে পড়ছে। ক্যাম্প ও ক্যাম্পের বাইরে রোহিঙ্গারা অনেকেই এখন ছোটখাটো ব্যবসা চালাচ্ছে। কেউ কেউ দেশি-বিদেশি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ করে সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ছে। কিছু সন্ত্রাসী কারাগারে ঢুকছে। কক্সবাজার-টেকনাফের পরিবেশ ক্রমেই ভারি হচ্ছে। দিন দিন এখানকার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক পরিবেশ নষ্ট হওয়ার পরিবেশ দেখছি। একটি মহল তাদের বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে রেখে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করছে। তাদের মধ্য থেকে কিছু যুবককে নিয়ে সন্ত্রাসী গ্রুপ হচ্ছে। তাদের অবৈধ অস্ত্র আর অর্থ দিচ্ছে। তারা সন্ত্রাসী জঙ্গি হসেবে তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করে এখানে সন্ত্রাসী কর্মকা- পরিচালনা করা হলে দেশের ভূখ-ের জন্য কী পরিমাণ হুমকি তৈরি হচ্ছে সেটা এখনই ভাবতে হবে। রোহিঙ্গা বিশাল জনগোষ্ঠীর কারণে বাংলাদেশের আলো-বাতাস, পরিবেশের ক্ষতি কতদিন নাগাদ জনগণ সহ্য করবে। কৃষিপণ্যের ভরা মৌসুমও সবজি, মাছ, মরিচের বাজার লাগামহীন। ১৭ কোটির অধিক বাংলাদেশি নাগরিকের জনবহুল বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের চাপ আর কতদিন সইতে হবে বলা যাচ্ছে না। তবে তাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া যে বিলম্বিত ও বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে সেটা এখন আলোর মতো পরিষ্কার। রোহিঙ্গারা তাদের জন্মভূমিতে নাগরিক অধিকার, কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসন সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ফিরতে চায়। এর ব্যতিক্রম ঘটলে সেখানে তারা যেতে চায় না। মিয়ানমার সরকারের নীতিনির্ধারণী চিন্তায় ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। একেক সময় একেক ধরনের শর্ত তুলে দিচ্ছে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ চায় সুষ্ঠু, সুন্দর ব্যবস্থাপনায় নাগরিক মর্যাদায় তাদের পূর্ণ অধিকার দিয়ে ফেরত নেওয়া হোক। তারা যেন ঠিকভাবে তাদের বাড়িঘরে গিয়ে উঠতে পারে, চাষবাস, শিক্ষার পূর্ণ নাগরিক অধিকার যেন তারা ভোগ করতে পারে, রাষ্ট্রীয় সুবিধা ও নাগরিক মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পরে। বাংলাদেশের নাগরিক ও সরকারের সেটাই কাম্য। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার চায় যত দ্রুত সম্ভব তাদের প্রত্যাবাসন করতে। মিয়ানমার সরকারের নানা নিয়ম ও বিধি প্রক্রিয়ায় এ চেষ্টায় বারবার বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘসহ পৃথিবীর নানা দেশের অব্যাহত চাপকেও মিয়ানমার সরকার তেমন তোয়াক্কা করছে না। পাশের দেশ বাংলাদেশকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় তেমন সহযোগিতা করছে বলে মনে হয় না। এখানে একটি রাজনৈতিক পলিসি চলছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন। বাংলাদেশ সরকার ও জনগণ শুধু মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দিয়েছে। বাংলাদেশের মাটি, পানি, আলো, বাতাস তাদের জন্য আজ উন্মুক্ত করে দিতে হয়েছে। এর অর্থ এই নয়, তারা এখানে থেকেই যাবে। তাদের এখানে রেখে দিতে হবে। বাংলাদেশের প্রায় ১৮ কোটি মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান আর শিক্ষার সুযোগ থেকে যেখানে অনেক নাগরিক এখনও বঞ্চিত সেখানে ভিনদেশি নাগরিকের ভরণপোষণ এ দেশের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। ফলে তাদের সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সে জায়গায় রোহিঙ্গাদের দীর্ঘদিন এভাবে উদ্বাস্তুর নামে রেখে দিয়ে রাজনৈতিক কৌশল করে বাংলাদেশকে চাপে রাখার রাজনীতি এ দেশের মানুষ বোঝে। প্রতিবেশী দেশ যদি বাংলাদেশের উপকারে সঙ্গে না থাকে তাহলে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আগে সংকটে পড়বে। দেশের মানুষ আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ দেশের মানুষের শিক্ষাদীক্ষা কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য-পরিবেশ আরও বাধাগ্রস্ত হবে। মিয়ানমার সরকার এখনও তাদের ষড়যন্ত্রের কর্মসূচিতে রয়েছে। রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নাগরিক অধিকার নিয়ে প্রত্যাবাসন সরকার চায় না। ওরা এটাকে রাজনীতি হিসেবে জিইয়ে রাখার ষড়যন্ত্র করছেÑ এমনটাই মনে হয়। পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষের চিন্তাচেতনার আহ্বানেও মিয়ানমার সরকার শ্রদ্ধা জানাচ্ছে না। তাহলে কী মিয়ানমার সরকারের অন্যায়-জুলুম এভাবে আমরা সহ্য করে যাব? তাদের অন্যায়ের কোনো বিচার দুনিয়ার কোনো শাসক করতে পারবে না? তারা কারও কথা বুঝতে কী বাধ্য নয়? দুনিয়ায় কী জালিমের কোনো বিচার করার ক্ষমতা কারও নেই? বিশ্ব বিবেকবান মানুষের কাছে এসব প্রশ্ন ছেড়ে দিলাম। তবে কী উত্তর পাওয়া যাবে অথবা পাওয়া যাবে না দুটিই মাথায় রাখলাম। হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী-শিশুর হত্যাকারী সু চি সরকার এতই ক্ষমতাধর, পৃথিবীর কোনো সংস্থা ও দেশ এ জুলুম ও অন্যায়ের বিচার করার সাহস পাচ্ছে না। মিয়ানমার সরকার সে ক্ষেত্রে কারও কথা শুনছে না। তাহলে এখানে এত কথা, বৈঠক, মিটিং-যোগাযোগ দিয়ে কি হবেÑ সে জায়গায় দেশের বিবেকবান মানুষ আশ্বস্ত হতে পারছে না। বাস্তবে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া কতটুকু সফল ও বাস্তব রূপ নেবে সেটা দেখার অপেক্ষায় আছে দেশের মানুষ। যত দ্রুত সম্ভব তাদের নিজ দেশে ফেরত দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের শান্তিশৃঙ্খলা পরিবেশ রক্ষায় আরও আন্তর্জাতিক কুটনৈতিক প্রক্রিয়া জোরদার করা দরকার। এ প্রচেষ্টা অন্য সব রাষ্ট্রীয় পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে দেখতে হবে। কারণ রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের জন্য একটা মারাত্মক সমস্যা। অঙ্গে একটি সমস্যা দেখা দিলে যেরূপ পুরো শরীর অসুস্থ হয়, অনুরূপ রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সামাজিক নিরাপত্তার জন্য বড় সমস্যা। এ সমস্যা যতই বিলম্বিত হবে ততই বাংলাদেশের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দেবে। দেশি-বিদেশি মহল তাদের বাংলাদেশে রেখে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। রাষ্ট্রকে এসব বিষয় গুরুত্ব দিয়ে দেশের জন্য অবশ্যই এ সমস্যা দীর্ঘায়ুভাবে রাখা যাবে না। বাংলাদেশের যে কোনো অঞ্চলে তাদের পুনর্বাসনের আমি বিরোধী। এমনিতেই তারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঢুকে যাচ্ছে। দেশের নাগরিকত্বের পরিচয় বহন করে বিদেশেও বাংলাদেশি পরিচয়ে বৈধ-অবৈধ পথে পাড়ি জমাচ্ছে। এসব কর্মকা- অবশ্যই স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের জন্য মহাবিপদ ডেকে আনছে। পৃথিবীর যে কোনো দেশে তারা বাংলাদেশ থেকে গিয়ে দেশের সুনাম নষ্ট করার সংবাদ পাওয়া যায়। প্রকৃত বাংলাদেশি নাগরিক রোহিঙ্গাদের অনৈতিক কর্মকা-ের ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছে। কফি আনানের রিপোর্টের ভিত্তিতে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে তাদের দ্রুত ফেরত পাঠাতে ব্যবস্থা করতে হবে। এভাবে বছরের পর বছর বাংলাদেশে তাদের অবস্থান দেশের জনগণ মেনে নিতে পারছে না। দেশের অন্য কোথাও তাদের পুনর্বাসন জনগণ মেনে নিতে চাচ্ছে না।
মাহমুদুল হক আনসারী
গবেষক, প্রাবন্ধিক