নতুন বাড়ি করার পর পীর সাহেবকে বাড়িতে দাওয়াত করেছেন এক নতুন মুরিদ। মুরিদের বাড়িতে এসে পীর সাহেব এদিক-ওদিক দৃষ্টিপাত করে জানতে চাইলেন, এই যে দেয়ালগাত্রে ছিদ্রপথ, এগুলো কিসের জন্য? আগেকার দিনে বাড়িঘরে জানালা ছিল না। জানালার পরিবর্তে ব্যবহৃত হতো কতক ছিদ্র, সাহিত্যের ভাষায় গবাক্ষ। ফারসি ভাষায় বলা হয় রওযান। পীর সাহেবের মুখে এমন প্রশ্ন শুনে হুজুরের প্রতি মুরিদের খানিকটা মায়া হলো। তিনি সোৎসাহে বললেন, কেন হুজুর! বাইরের আলো, এক-আধটু বাতাস ঘরে ঢুকবে, তার জন্য এসব গবাক্ষ রাখতে হয়। পীর সাহেব বললেন, তা ঠিক, তবে যদি ছিদ্রপথ তৈরির সময় তোমার নিয়তটা এমন করতেÑ বাইরের আলো-বাতাসের সঙ্গে পাঁচ ওয়াক্ত আজানের শব্দও মসজিদের মিনার থেকে ভেসে আসবে, তখন আমি শুনব, নামাযের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারব, তাহলে বাড়ির ভেতরে আলো বাতাসের সাথে দ্বীনি উদ্দেশ্যের কারণে স্থায়ী সওয়াবের ভাগীও হতে পারতে।
মুরিদের চিন্তায় একটুখানি নাড়া দিয়ে পীর সাহেব সম্পূর্ণ দুনিয়াদারির একটি কাজকে ধর্মীয় কাজে
রূপান্তরিত করে দিলেন। এই কাহিনি অবতারণার পর বিশ্বপ্রেমিক সাধক ও দার্শনিক মওলানা জালাল উদ্দীন (রহ.) মসনবি শরিফে একটি সুন্দর জীবন দর্শন উপস্থাপন করে বলেন, নিয়তের সুবাদে আমাদের দুনিয়াদারির কাজেগুলোও দ্বীনি কাজে পরিণত হতে পারে, আবার একই কারণে ধর্মীয় কাজগুলো দুনিয়াদারি ও ভ-ামিতে পরিণত হওয়া অসম্ভব নয়।
মওলানা রুমির এই দীক্ষা শুধু বাড়িঘর নির্মাণের বেলায় নয়, সাংসারিক কাজকর্ম, আহারবিহারেও সমানভাবে প্রযোজ্য। মওলানা রুমির এই দর্শন ইসলামী শিক্ষারই মৌল চেতনারই কাব্যিক রূপ। কোরআন মজিদের পর ইসলামী জাহানের দ্বিতীয় বিশুদ্ধ গ্রন্থ বুখারি শরিফের প্রথম হাদিসটি নিয়ত সম্পর্কিত। হযরত ওমর (রা.) বর্ণিত ওই হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘যাবতীয় কাজকর্ম নিয়ত (বা উদ্দেশ্য) অনুযায়ী বিচার্য হবে। কাজেই যে ব্যক্তি আল্লাহ ও রাসুলের উদ্দেশ্যে হিজরত করে তার হিজরত আল্লাহ ও রাসুলের উদ্দেশ্যে বলে গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তি দুনিয়ার সুযোগ-সুবিধা অর্জন বা কোনো মহিলাকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে হিজরত করবে তার হিজরত তার নিয়ত অনুসারে বিচার্য হবে।’ বস্তুত নিয়তের কারণে বাহ্যত দ্বীনি কাজও দুনিয়াদারি ও গোনাহের কাজে পরিণত হয়। আবার দৃশ্যত দুনিয়াবি কাজও নিয়তের বিশুদ্ধতার কারণে ধর্মীয় ও সওয়াবের কাজে পরিণত হয়।
ঈদ উপলক্ষে আমাদের কেনাকাটা করতে হয়, দেখতে তা দুনিয়াদারি হিসেবে গণ্য; কিন্তু যদি পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজনের হক আদায়ের নিয়ত আমাদের মনে থাকে, তা সদকার সওয়াব বয়ে আনবে। হাদিস অনুযায়ী ‘মুমিন তার পরিবারের মুখে যে খাবার তুলে দেয় তা সদকা হিসেবে গণ্য।’ ‘এক মুসলমান অন্য মুসলমানের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলাও সদকা।’ কাজেই আমরা যদি মনে মনে বলি, আল্লাহ ও রাসুলের (সা.) হুকুম অনুযায়ী আমার ওপর স্ত্রীপুত্র-পরিজনের যে দায়িত্ব রয়েছে তা পালন করার জন্য ঈদের এই কেনাকাটা, সংসারের টানাপড়েনের ঘানি টানা, তাহলে আমাদের সংসার জীবন দ্বীনদারি ও সওয়াবের কাজে পরিণত হবে। ঈদের আনন্দ, সালাম শুভেচ্ছা বিনিময় ও হাসিমুখে দেখা-সাক্ষাৎও ইবাদত এবং সদকা হিসেবে গণ্য হবে। তাতে জীবনের নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলার বিরাট শক্তিতে বলিয়ান হবে মুমিনের চেতনা ও মন।
হযরত আবু মসউদ আনসারী বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন : যখন কোনো মুসলমান আপন পরিবারের জন্য কোনো খরচ করে এবং তার পেছনে সওয়াবের আশা থাকে, তাহলে তা তার জন্য দানসদকা হিসেবে গণ্য হবে। (বোখারি ও মুসলিমের বরাতে মেশকাত : ১৮৩৪)
হযরত উম্মে সালামা ছিলেন আমাদের মা, নবীজির স্ত্রী। প্রথমে তিনি সাহাবি আবু সালামার স্ত্রী ছিলেন। আবু সালামার ইন্তিকালের পর নবীজি অসহায় উম্মে সালামাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করেন। আগের স্বামীর ঘরে তার একাধিক সন্তান ছিল। তিনি নবীজির কাছে জিজ্ঞেস করেন : ইয়া রাসুলুল্লাহ! আবু সালামার সন্তানদের জন্য খরচপাতি করলে আমার কি সওয়াব হবে ? তারা যে আমারই সন্তান। আল্লাহর রাসুল বললেন, তাদের জন্য খরচ কর। তাতে তাদের জন্য যে পরিমাণ খরচ করবে সে অনুপাতে তোমার সওয়াব হবে। (বোখারি ও মুসলিমের বরাতে মেশকাত : ১৮৩৪)