আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ২৮-০৫-২০১৯ তারিখে পত্রিকা

মূল্যবোধের অবক্ষয় ঠেকাতে সচেতন হতে হবে

আফতাব চৌধুরী
| সম্পাদকীয়

ব্যক্তিকে নিয়েই সমাজ। তাই ব্যক্তির চিন্তা, ইচ্ছা, অনুভূতি সবকিছুই সমাজ-জীবনে প্রতিবিম্বিত হয়। সমাজ তাই ব্যক্তিমনেরই প্রকাশ। একজন ব্যক্তির ভালো-মন্দ, দোষ-গুণ, তার সততা, বুদ্ধিবিবেচনা, সর্বোপরি তার সৎ শিক্ষা কল্যাণমুখী বা সুশীল সমাজ তৈরি করতে সাহায্য করে। সমাজ-দর্শন এ কথাই বলে এবং রাষ্ট্র, পরিবার, ধর্ম, নীতিবোধ সবকিছুই সমাজ-দর্শনের বিষয়বস্তু। তাই ব্যক্তির ব্যক্তিচেতনা ভীষণ জরুরি। একইভাবে সামাজিক জীবনের সঙ্গে মানুষের আচরণ, পারস্পরিক সম্পর্ক, মিলেমিশে থাকা, নিজেকে সৎ রাখা এগুলো ঠিকঠাক থাকলে সমাজের স্বাস্থ্যরক্ষা করা সহজ হয়। 
সামাজিক দায়দায়িত্ব, কর্তব্য একজন নাগরিক ঠিকমতো পালন করলে সে নিশ্চয়ই দায়িত্ববান নাগরিক বলে গণ্য হবে। আদিম যুগে মানুষের জীবনরক্ষা ও শুধু টিকে থাকার জন্যই সামাজিক জীবনের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু পরবর্তী যুগে ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য মানুষের সমাজের ভীষণ প্রয়োজন হয়ে পড়ল, কারণ সমাজ ছাড়া মানুষের বাঁচা সম্ভব নয়। তাই মানুষ পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্ক আর নিয়ম-কানুন সম্পর্কে চেতনাবোধে সংঘবদ্ধভাবে বাঁচার কথা উপলব্ধি করল। এ বোধই মানুষকে করল সামাজিক। এই চেতনাবোধ না থাকলে সমাজের মধ্যে বাস করেও মানুষ অসামাজিক কাজে লিপ্ত থাকবে।
রুশোর মতে, প্রাক-সামাজিক প্রকৃতিরাজ্যে মানুষ সহজ, সুন্দর, সরল ও মুক্ত উদার জীবনযাপন করত। প্রকৃতিরাজ্য ছিল ভূস্বর্গ। কিন্তু এ অবস্থায় বেশি দিন বাস করা মানুষের পক্ষে সম্ভব হলো না। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ব্যক্তিগত সম্পত্তির সূচনা এবং মানুষের চিন্তার ক্রমবিকাশ এ প্রকৃতিরাজ্যের সাম্য ও সুখ-শান্তি নষ্ট করে দিল। সংঘর্ষ, বিরোধ, বিবাদ, হত্যা, অরাজকতার সৃষ্টি করল। 
সামাজিক অপরাধ হলো সামাজিক দুর্নীতি। এ অপরাধে যারা লিপ্ত থাকে তারা সমাজকে সুস্থ থাকতে দেয় না, নানা রকমের সমাজবিরোধী কাজ, যেমনÑ আইন অমান্য করা, মানুষকে প্রতারিত করা, অন্যের সম্পত্তি নষ্ট করা, অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা ইত্যাদি কাজ নির্ভয়ে করতে দ্বিধাবোধ করে না। অপরাধ সম্পর্কীয় সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, সামাজিক অব্যবস্থার জন্যই অপরাধ হয়। সমাজের মধ্যে যে অসাম্য, অসংগতি, অর্থনৈতিক বৈষম্য, দুর্নীতি বর্তমানে আছে, তার জন্যই অপরাধপ্রবণতা মানুষের মনে দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। তবে আমরা অস্বীকার করতে পারি না যে, দারিদ্র্য, অভাব, অনটন, দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি সুস্থ জীবনযাপন করতে বাধা দিচ্ছে। তবে এমনটা বলা যাবে না যে, অপরাধগুলো শুধু এসবের জন্যই হচ্ছে। অনেক অর্থবান মানুষ লোভে পড়ে অসহায় মানুষকে প্রতারিত করে কীভাবে সাম্রাজ্য বিস্তার করে তার নমুনা ভূরি ভূরি আছে আমাদের দেশে। প্রতিদিন পত্রপত্রিকা পাঠে জানা যায়, একশ্রেণির মানুষ অসহায় জনসাধারণকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে আর ভাঁওতাবাজি করে সরলতার সুযোগ নিয়ে টাকার পাহাড় গড়ে তোলে। অবৈধ টাকা জমানো যে অপরাধ তার প্রতি তাদের লক্ষ নেই। 
কত মানুষের তিল তিল করে রক্ত জমানো টাকা লোভের বশবর্তীতে অপরাধীরা আত্মসাৎ করছে দিনের পর দিন। আমাদের দেশে কত ধরনের যে অপরাধ ঘটছে প্রতিদিন, তা লিখে শেষ করা যাবে না। তাই দূরের দিকে না তাকিয়ে আমাদের আশপাশে যেসব ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে যাচ্ছে, সে দিকে তাকালে একবারও কি মনে হয়, আমরা আবার সব ধরনের অশুভ কাজকর্ম থেকে মুক্ত হয়ে নতুন ভোরের আলো আগামী প্রজন্মকে উপহার দিয়ে যেতে পারব?
কোন পথে চলছি আমরা? প্রচুর টাকা-পয়সা খরচ করে ক’বছর আগে ঢাকার এক ইউনিভার্সিটিতে ‘সমাবর্তন’ উৎসবে আমাদের দেশের শিক্ষামন্ত্রীসহ খ্যাতনামা ব্যক্তি ও শিক্ষাবিদরা জড়ো হয়েছিলেন। উজ্জ্বল নক্ষত্রদের সমাবেশে আমরা গর্বিত। সব মিলিয়ে এখানে চমৎকার আয়োজনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। অনুষ্ঠানস্থলের প্রবেশপথের অবস্থা ছিল অত্যন্ত জরাজীর্ণ। উদ্যোক্তারা তাড়াহুড়ো করে পথঘাটের ওপর প্রলেপ দিয়ে সাময়িক হাঁটাচলার ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু এ ভাঙা পথের ওপর দিয়ে কত যানবাহন, বিশেষ করে ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। শুধু সদিচ্ছার অভাবে এ সড়ক ঠিক হলো না। যখনই বড়মাপের কোনো বিদেশি এ শহরে আসেন, সঙ্গে সঙ্গে আমরা দেখি ‘গরিবি হটাও’র মতো সব ঠেলাধাক্কা বা ভেঙে দিয়ে সাময়িকভাবে ঠিক করে দেওয়া হয়। এর মতো লজ্জা আর কী আছে? এগুলো সব অপরাধের তালিকা থেকে মুক্ত নয়। সবকিছুর প্রভাব জনসাধারণের ওপরই পড়বে। 
প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মরহুম ড. ওসমান গনি বলে গেছেন, ‘মানুষের মতো মানুষ হওয়াটাই সবচেয়ে বড় কথা।’ আকুলতার সঙ্গে ছাত্রদের উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘কথা দাও তোমরা দুর্নীতি থেকে দূরে থাকবে।’ বর্তমান রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে সততা, মূল্যবোধ ও দায়িত্বশীলতার ওপর জোর দিয়েছেন। বলেছেন, সততার শিক্ষা আসে পরিবার থেকে, সবারই চেষ্টা করা উচিত নৈতিক অধঃপতন রোধ করা।
সত্যিই যদি ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, জনসাধারণ, অভিভাবক, রাজনৈতিক নেতারা এসব শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারতেন, কাজকর্মে দৃষ্টান্ত রেখে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালাতেন, তাহলে সুশীল সমাজ গড়ে তুলতে কোনো অসুবিধাই হতো না। তাই আমার মনে হয়, প্রত্যেকে যদি নিজের স্বার্থকে সবসময় বড় করে না দেখে অন্যের মঙ্গলের কথাও ভাবেন, তাহলে হয়তো অপরাধের মাত্রা কিছুটা হলেও কমানো যাবে। মানুষ যখন নীতিভ্রষ্ট হয়, বোধশক্তি বিনষ্ট হয় বা স্বার্থচেতনা প্রবল হয়, তখই মানুষ লোভের বশবর্তীতে অপরাধ করে। তাই অপরাধকে এক ধরনের ব্যাধি বলা হয়।
স্কুল-কলেজগুলোতে যদি লেখাপড়া ছাড়াও বৃত্তিগত ও ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হয়, তাহলে অর্থনৈতিক দিক থেকে আত্মনির্ভর হতে পারে। তাছাড়া বাঁচার জন্য উপযুক্ত বাসগৃহ, সুন্দর জীবনযাপনের উপযোগী ব্যবস্থা, খেলাধুলা, শরীরচর্চার ব্যবস্থা, আমোদ-প্রমোদ, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা, অরাজকতা কঠোর হাতে দমন করা, সরকার ও প্রশাসনকে সাহায্য করা, সহযোগিতাসুলভ মনোভাব থাকাÑ এগুলো মেনে চলে কিছুটা অপরাধপ্রবণতা কমবে বৈ বাড়বে না। 
অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অপরাধ বাড়বে তা অস্বীকার করার উপায় নেই; তবে সুস্থ মানসিকতা আর সততা থাকলে সুস্থ সমাজ তৈরি করতে কষ্ট হয় না। আমাদের আর্তনাদও কিছু কমবে। তবে অপরাধ করার প্রবণতা হঠাৎ করে কমবে না, কারণ অপরাধ জগতের নায়করাও মানুষ। আমরা অপরাধীদের নিয়েই বাস করতে অভ্যস্ত, অনেকে আবার আমাদের প্রতিনিধি। অপরাধ জগতের দীর্ঘ ছায়া হওয়া সত্ত্বেও আমরা তাদের অনুসরণ করি, যা করা মোটেই সমীচীন নয়। এই দেশে, এই সময়ে দাঁড়িয়ে খুন, জখম, ধাপ্পাবাজি ও নানা ধরনের দুর্নীতিতে ভরা চতুর্দিকের পরিবেশকে দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা পরিচ্ছন্ন করার কঠিন কাজে বেশি করে ব্রতী হলে আমাদেরই মঙ্গল। কারণ আমরা দেখতে আগ্রহী একটা স্বচ্ছ সুন্দর সমাজ। নয়তো হাঁটি হাঁটি পা ফেলে যে শিশু হাঁটতে শিখবে, পদে পদে দেখবে তার চোখের সামনে অন্ধকার এক জগৎ, আর সেই জগৎকে আঁকড়েই তাকে এগিয়ে যেতে হবে বৃহত্তর জীবনে, যে জীবন, যে সমাজব্যবস্থা অত্যন্ত কঠিন ও নিরাপত্তাহীন।

 আফতাব চৌধুরী 
সাংবাদিক ও কলামিস্ট