আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ২৮-০৫-২০১৯ তারিখে পত্রিকা

নিরাপদ যাত্রায় নিশ্চিন্ত ঈদ উৎসব

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ
| সম্পাদকীয়

ঈদের সময় বাড়তি যাত্রীর স্থান সংকুলানের জন্য বেশি সংখ্যক লঞ্চ, বাস ও ট্রেন নামাতে হবে। তবে ফিটনেসবিহীন কোনো ধরনের যানবাহন চলতে দেওয়া যাবে না। আর ঈদ-পার্বণের সময় পরিবহন মালিকদের মধ্যে যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা লেগে যায়, তা-ও বন্ধ করতে হবে

উৎসব-পার্বণের আনন্দ সবাই মিলেমিশে ভাগ করে উপভোগ করা বাঙালির স্বভাবজাত। বছরের দুটি ঈদে রাজধানীতে কর্মরত মানুষ তাই ছুটে যান তাদের নিজ শহরে অথবা গ্রামের বাড়িতে। সেখানে অবস্থানরত মা-বাবা, ভাইবোনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেন। এ যেন এক অদৃশ্য নাড়ির টান। কেউ নিজের স্ত্রী-সন্তানকে বাড়িতে রেখে রাজধানীতে চাকরি করতে বাধ্য হন। কর্মব্যস্ত জীবনের মাঝে তারা ঈদের লম্বা ছুটিতে নিকটজনের সঙ্গে মিলে উৎসবের নির্মল আনন্দের সবটুকু উপভোগ করার সুযোগ করে নিতে চান। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, এই আনন্দ অনেক সময় শোকে পরিণত হয়। ছুটিতে বাড়ি যেতে বা ঈদ শেষে রাজধানীতে ফিরে আসার সময় দুর্ঘটনায় কেড়ে নেয় প্রাণ। একমাত্র কর্মক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে পুরো পরিবার পথে বসে। প্রতি বছর এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্যমতে, গত তিন ঈদে ৬০৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৮০৩ জন। এর মধ্যে ২০১৮ সালের ঈদুল ফিতরে ঈদযাত্রা শুরুর দিন থেকে ঈদ শেষে বাড়ি থেকে কর্মস্থলে ফিরতে ১৩ দিনে ২৭৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৩৯ জন নিহত এবং ১ হাজার ২৬৫ জন আহত হয়েছেন। একই সময় নৌপথে ১৮টি দুর্ঘটনায় ২৫ জন নিহত, ৫৫ জন নিখোঁজ ও ৯ জন আহত হয়েছেন। রেলপথে ট্রেনে কাটা পড়ে ৩৫, ট্রেনের ধাক্কায় ৪, ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে দুজনসহ ৪১ জন নিহত হয়েছেন। 
প্রতি বছর দু-দুটি ঈদের ছুটিতে লঞ্চে, ট্রেনে ও বাসে থাকে উপচেপড়া যাত্রীদের ভিড়। জীবনের তোয়াক্কা না করে যাত্রীরা ঠাঁই নেন যানবাহনের ছাদে। বাস-ট্রেনে জায়গা না পেয়ে ট্রাকে চড়ে মানুষ ঢাকা থেকে বিভিন্ন শহরে গমন করে। সাম্প্রতিক সময়ে সড়কের নানা অব্যবস্থাপনা ঠেকাতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও যানবাহন চলছে আগের মতো ফ্রি-স্টাইলে। ফলে দুর্ঘটনার হার বাড়ছে বৈ কমছে না। প্রতিদিনের খবরের কাগজের পাতা খুললেই এর সত্যতা মিলবে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে এসেছে ঈদ উৎসবের ছুটি। স্বল্পসংখ্যক গণপরিবহনে বাড়তি যাত্রী সামাল দিতে গতিসীমার বাইরে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে বেশি ট্রিপ দেওয়ার অশুভ প্রতিযোগিতা লেগে যায়। অধিক মুনাফার লোভে পরিবহন সংস্থাগুলো চালকদের অনেক বেশি কর্মঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য করে। ফলে চালকের ওপর এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ পড়ে, তাকে বেসামাল হয়ে গাড়ি চালানোর পথে ঠেলে দেয়, যা প্রকারান্তরে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। গবেষণা বলছে, চালকের অদক্ষতা ও বেপরোয়া যানবাহন চালানোর পাশাপাশি ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, সড়ক ও সেতুর নাজুক অবস্থাও সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। ১৮ মে বাগেরহাটে চাকা ফেটে এক বাস দুর্ঘটনায় পড়ে ছয়জন যাত্রী মারা যান। 
ঈদের দীর্ঘদিনের ছুটির শুরুতে যাত্রীদের বাড়ি যাওয়ার সময় সড়কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে রকম নজরদারি থাকে, ফিরতি পথে তেমনটি থাকে না। কেননা ছুটির শুরুতে সবাই প্রায় একই সময় বাড়িতে গেলেও তারা ফেরেন বিভিন্ন সময়ে। আর সড়ক-মহাসড়কও থাকে কিছুটা ফাঁকা, আর এ সুযোগে চালকরা তীব্র বেগে গাড়ি চালান আর দুর্ঘটনাও বেশি ঘটে। রাস্তায় যে কোনো যান চলাচলের আগে তার ত্রুটিবিচ্যুতি পরীক্ষা করা বাধ্যতামূলক হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা মানা হয় না। এ ধরনের প্রবণতাকে রুখতে হবে। ঈদকে সামনে রেখে লক্কড়ঝক্কড়, অচল যানবাহনকে রং লাগিয়ে যেনতেন মেরামত করে রাস্তায় নামানোর বদলে যেন ভালো ইঞ্জিনসমৃদ্ধ গাড়ি রাস্তায় চলাচল করে, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। মাদকাসক্ত চালকের অমনোযোগের কারণে যেন যানবাহনে দুর্ঘটনা না ঘটে তার প্রতিকার করতে হবে। গাড়ি চালানোর সময় চালকের সেলফোন ব্যবহার বন্ধ রাখতে হবে। সড়ক-মহাসড়কের যেসব জায়গায় কারিগরি নির্মাণ ত্রুটি, অপরিকল্পিত মোড়-বাঁক রয়েছে, সেগুলো ঈদের ছুটির আগেই মেরামত করতে হবে। যানবাহন চলাচলে ট্রাফিক বিভাগের স্পিড-মিটার ব্যবহারসহ হাইওয়ে পুলিশের কঠোর নজরদারি অত্যাবশ্যক। 
মহাসড়কে যানবাহনের চালকের বেপরোয়া মনোভাবজনিত ওভারটেকিং কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে। যানবাহনে ধারণক্ষতার অতিরিক্ত যাত্রী বহন মনিটরিং করতে হবে। রাস্তায় ট্রাফিক সাইন ও সিগন্যাল, ট্রাফিক আইন না মেনে গাড়ি চালালে চালকদের বিরুদ্ধে নিতে হবে আইনগত ব্যবস্থা। মহাসড়কে থ্রি-হুইলার, নছিমন, ভটভটি চলাচল বন্ধ রাখতে হবে। এছাড়া সড়কের ওপর হাটবাজার বসানো যাবে না। রাস্তা ব্যবহারকারীদের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে সচেতনতা। সরকার নিয়ন্ত্রিত বিআরটিসির বাসে দুর্ঘটনার হার তুলনামূলকভাবে প্রাইভেট মালিকানাধীন বাসের চেয়ে অনেক কম। কেননা বিআরটিসি বাসচালকরা নির্দিষ্ট গতিসীমায় বাস চালান। প্রাইভেট বাসচালকের বেলায়ও এমনটি হলে দুর্ঘটনা কমবে। চালকের শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং বয়সের ব্যাপারে সীমাবদ্ধতা রাখা হয়েছে, কার্যক্ষেত্রেও যেন এর সফল বাস্তবায়ন হয়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে। অপেশাদার চালক যেন কোনোভাবে গণপরিবহন চালাতে না পারে, সে ক্ষেত্রে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। 
সারা বছর রেলসড়কে তেমন দুর্ঘটনা না ঘটলেও দুটি ঈদে ট্রেনে যাতায়াত করতে গিয়েও অনেকেই প্রাণ হারান। এর প্রধান কারণ অতিরিক্ত যাত্রী বহন। ট্রেনের ছাদে যাত্রী বহন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। রেললাইনের এলাইনমেন্ট সঠিক রয়েছে কি না, তা পরীক্ষা করতে হবে। রেলক্রসিং এবং লেভেলক্রসিংসহ পুরো রেললাইনের মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ ঈদের ছুটির আগেই শেষ করতে হবে। লেভেলক্রসিংয়ে গেটম্যানের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি নিশ্চিত করাও বাঞ্ছনীয়। রেললাইনের পাশে হাটবাজার বসানো পুরোপুরি বন্ধ রাখতে হবে। ট্রেনের শিডিউল ঠিক রাখার ব্যাপারে রেল কর্তৃপক্ষকে সজাগ থাকতে হবে। ট্রেন যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সম্প্রসারিত করতে নতুন নতুন রেল ইঞ্জিন ও বগি আমদানি করতে হবে। ট্রেনে অধিকসংখ্যক যাত্রী একসঙ্গে যাতায়াত করতে পারেন এবং ট্রেনের ভাড়াও তুলনামূলকভাবে কম। সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন রেলযোগাযোগ সম্প্রসারিত হলে বেসরকারি খাতের বাস সার্ভিসের ওপর চাপ কমবে। তাদের মাঝে প্রতিযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি হবে। সেবার মানও বৃদ্ধি পাবে। রেল বিভাগে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দায়িত্বসচেতন হলে নিশ্চিতভাবে ট্রেনের দুর্ঘটনা অনেকাংশে হ্রাস পাবে।
নৌপথে লঞ্চে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বহন বন্ধ করাসহ অচল লঞ্চ মেরামত করে যেন নৌপথে নামানো না হয়, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রতিটি লঞ্চে লাইসেন্সধারী অভিজ্ঞ মাস্টার ছাড়া লঞ্চ চালাতে দেওয়া যাবে না। লঞ্চে বিকন বাতি, পর্যাপ্ত সংখ্যক লাইফবয়া রাখা নিশ্চিত করতে হবে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় কোনোক্রমে লঞ্চ চলাচল করতে দেওয়া যাবে না। নির্দিষ্ট সংখ্যক যাত্রী নিয়ে প্রতিটি লঞ্চকে ঘাট ছেড়ে যেতে হবে। মাঝনদীতে লঞ্চ থামিয়ে রেখে নৌকা দিয়ে যাত্রী তোলা যাবে না। এসব নিশ্চিত করতে নৌপুলিশ ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের নজরদারি জরুরি। নৌপথে সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন স্টিমার সার্ভিস প্রায় বিলুপ্তির পথে। নতুন করে স্টিমার সার্ভিস চালু করার ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। এখন নৌপথ ব্যবহারকারীদের একমাত্র ভরসা ব্যক্তিমালিকানাধীন লঞ্চ সার্ভিস। লঞ্চ মালিকরা অনেক পুঁজি খাটিয়ে বৃহদাকার বিলাসবহুল লঞ্চ সার্ভিস চালু করেছেন। ঈদের সময় তারা ঢাকা-বরিশাল-ঢাকা রুটে ডবল ট্রিপও দেন। ঈদ মৌসুমে টিকিটের ভাড়া না বাড়িয়ে যাত্রীসবার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। যাত্রীরা টিকিট পেতে কালোবাজারিদের হাতে যেন হয়রানির শিকার না হন, সেদিকে মালিকদের খেয়াল রাখতে হবে। ঈদের সময় বাড়তি যাত্রীর স্থান সংকুলানের জন্য বেশি সংখ্যক লঞ্চ, বাস ও ট্রেন নামাতে হবে। তবে ফিটনেসবিহীন কোনো ধরনের যানবাহন চলতে দেওয়া যাবে না। আর ঈদ-পার্বণের সময় পরিবহন মালিকদের মধ্যে যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা লেগে যায়, তা-ও বন্ধ করতে হবে। সবকিছু মিলিয়ে ঈদযাত্রায় যাত্রীদের জীবন নিরাপত্তার দিকে যানবাহন মালিক ও চালকসহ সড়ক পরিবহন সংশ্লিষ্ট সবার মানবিক দায়িত্ব পালন করতে হবে, যাতে সড়ক, নৌ এবং রেলপথের যাত্রীদের ঈদ উৎসব উপভোগের ইচ্ছার মৃত্যু না ঘটে। 

 মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ
প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক