বিশ্বাস। আরবিতে যাকে বলে আকিদা। মানব মনের স্পর্শকাতর জায়গার নাম। বিশ্বাসে টালমাটাল ও অস্থিরতার সৃষ্টি হলে ব্যক্তির গোটা জীবন ওলটপালট হয়ে যায়। বিশ্বাসের কোনো সময়সীমা নেই, এখানে নেই কোনো বয়সের হিসাব-নিকাশ। জীবনের শুরু থেকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ পর্যন্ত শুদ্ধ ও সত্য বিশ্বাস লালন জরুরি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর যারা ঈমান আনয়ন করেছে (অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করেছে) এবং তাদের বিশ্বাসকে কোনো প্রকার জুলুমের সঙ্গে মিশ্রণ ঘটায়টি, তারাই নিরাপদ এবং তারাই সঠিক পথপ্রাপ্ত।’ বিশ্বাস ও আকিদার শুদ্ধতা নিরূপণ যেভাবে প্রাপ্তবয়স্কের ক্ষেত্রে জরুরি, সমানভাবে ছোট বাচ্চা ও শিশুদের ক্ষেত্রেও শুদ্ধ আকিদা লালন জরুরি। বড়দের ব্যাপারে অনেকের মাঝে সচেতনতা বিদ্যমান হলেও শিশু ও কোমলমতি বাচ্চাদের বিশ্বাসের ব্যাপারে সবার মাঝে অনাকাক্সিক্ষত অবহেলা প্রদর্শিত হয়ে থাকে, যা কখনও কাম্য নয়। মনে রাখতে হবে, আজকের শিশুই আগামীর ভবিষ্যৎ। পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নির্মাণ করবে তারা। সুতরাং অঙ্কুরে তার বিশ্বাস ও আকিদায় অশুদ্ধি ও অসত্য জায়গা করে নিলে গোটা জীবনে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে থাকবে।
শৈশবেই বিশ্বাসের সবক দেওয়া ও বিশ্বাসকে শুদ্ধ করা স্বয়ং আম্বিয়ায়ে কেরামের পদ্ধতি। তারা হলেন পৃথিবীর বুকে আগত মানুষদের সেরা ও শ্রেষ্ঠ। তাদের প্রতিটি কর্ম ও পদ্ধতি অনুসৃত ও আদর্শ। হজরত ইবরাহিম (আ.) এর কর্মপদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর এ ব্যাপারে ইবরাহিম ও ইয়াকুব (আ.) তদ্বীয় পুত্রদের বিশেষ উপদেশ দিয়ে বলেছেন, হে আমার সন্তানরা! নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা তোমাদের জন্য এ দ্বীনকে বাছাই করেছেন, সুতরাং তোমরা পূর্ণ আত্মসমর্পণ ব্যতিরেকে মৃত্যুবরণ কর না।’ (সূরা বাকারা : ১৩২)। হজরত লোকমান (আ.) স্বীয় পুত্রকে নসিহত করছেন, ‘হে বৎস! তুমি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করো না। নিশ্চয়ই শিরক একটি মহা অন্যায়।’ (সূরা লোকমান : ১৩)।
আমাদের নবী মুহাম্মদ (সা.)ও শিশুর জন্মের পর থেকেই তাদের বিশ্বাসের সবক দেওয়ার বিষয়টির প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। শিশু সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) কে উপদেশ দিচ্ছেন, হে বৎস! আমি তোমাকে কয়েকটি কথা শেখাচ্ছি, তুমি এগুলোর প্রতি যতœবান হও। তুমি আল্লাহর হকগুলো সংরক্ষণ করো, তিনিও তোমাকে (বিপদ থেকে) রক্ষা করবেন। তুমি দ্বীনের ব্যাপারে যতœবান হও, আল্লাহর বিশেষ দৃষ্টি লাভে সক্ষম হবে। যখন তুমি চাইবে আল্লাহর কাছে চাইবে। সাহায্য প্রার্থনা করলেও তাঁর কাছেই করবে। জেনে রাখ, যদি সমগ্র মানুষ চাইলেও আল্লাহ তোমার জন্য যা লিখে রেখেছেন, এর বাইরে তোমাকে তারা কোনো উপকার করতে পারবে না। অনুরূপ সমগ্র মানুষ যদি তোমার কোনো ক্ষতি সাধনের ব্যাপারে একমত হয়; তবু আল্লাহর লিখে রাখার বাইরে তারা তোমার কোনো ক্ষতিই করতে পারবে না। কলম উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং পৃষ্ঠা শুকিয়ে গেছে। (সুনানে তিরমিজি : ২৫১৬)।
হজরত রাফে (রা.) বর্ণনা করেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) কে দেখেছি, হাসান (রা.) এর ভূমিষ্ঠের পর তার কানে আজান দিতে। (সুনানে আবি দাউদ : ১১৭৩)। ইবনুল কায়্যিম আল জাওজিয়্যা (রা.) এর পেছনে কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ‘নব-ভূমিষ্ঠ হওয়া সন্তানের কানে আজান দেওয়ার রহস্য হলো, এর দ্বারা সন্তানের কানে জন্মের প্রথম প্রহরে এমন আওয়াজ পড়ে, যা আল্লাহর বড়ত্ব ও তাঁর সম্মানের পরিচয় বহন করে। ভূমিষ্ঠকালে সন্তানের অনুভূতি ও বোধ জাগ্রত না হলেও তার ওপর পঠিত বাক্য ও দোয়ার ফল অস্বীকার করা যায় না।’
এ ব্যাপারে রাসুল (সা.) নিজে সুসংবাদও উচ্চারণ করেছেন। এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো শিশুকে লালনপালনের দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং তাকে লা ইলাহা ইল্লাহ বলা পর্যন্ত তার কাছে রেখে দেয়, আল্লাহ তায়ালা তার কোনো হিসাব নেবেন না।’ (আল মুজামুল আউসাত, খ--৫, পৃষ্ঠা-১৩০)।
শুধু ঈমানের ব্যাপারেই নয়, পাশাপাশি ইসলামের অন্যান্য মৌলিক বিষয়েও শিশুসন্তানকে সঠিক শিক্ষা দেওয়া বাবা-মায়ের কর্তব্য। হজরত আলী (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের তিন উত্তম বৈশিষ্ট্যের ওপর লালনপালন করো। তোমাদের নবীকে ভালোবাসা, তাঁর পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রাখা এবং কোরআন তেলাওয়াত করা।’ (কানযুল উম্মাল, খ--১৬, পৃষ্ঠা-১৮৯)।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যখন বাচ্চারা কথা বলতে শেখে, তখন তাদের লা ইলাহা ইল্লাহ শেখাও। এরপর তাদের মৃত্যু পর্যন্ত আর কোনো পরোয়া না করলেই হবে।’ (আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লাইলাহ, খ--১, পৃষ্ঠা-৩৭৩)।
সাহাবায়ে কেরাম (রা.) এর ক্ষেত্রেরও এ আমলের ব্যত্যয় দেখা যায়নি। তাদের মধ্যেও সমানভাবে শিশুদের মাঝে উত্তম বিশ্বাস রোপণ ও কালেমার শিক্ষা দেওয়ার প্রচলন ছিল। হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) এর মা উম্মে রুমাইসা (রা.) ছোট আনাস, যখন সে দুধ ছাড়েনি, তাকে কালেমা শেখাতেন। বলতেন, তুমি বল, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই। তার বাবা (তিনি তখনও মোশরেক ছিলেন) আনাস (রা.) এর মাকে সম্বোধন করে বলতেন, আমার বাচ্চাকে নষ্ট করো না। তিনি বলতেন, আমি তাকে নষ্ট করছি না, বরং শুদ্ধতার শিক্ষা দিচ্ছি। (সিয়ারু আলামিন নুবালা, খ--২, পৃষ্ঠা-৩০৫)।
এটা তো স্পষ্ট সত্য, শিশুরা আকিদা বিশ্বাসকে পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারে না, তাদের কাছে আকিদা গভীরতাহীন একটি অস্পষ্ট বিষয় আকারেই রয়ে যায়। কিন্তু বয়স বেড়ে যাওয়া ও বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে প্রতিস্থাপিত বিশ্বাসগুলো প্রভাব সৃষ্টি করতে থাকে। এজন্য বাবা-মা ও পরিবারের দায়িত্বশীলদের অনিবার্য কর্তব্য হলো শিশুদের অন্তরে সঠিক বিশ্বাস ও আকিদা সৃষ্টি করা। আমাদের চারপাশে বিদ্যমান যাবতীয় বস্তুর সঙ্গে স্রষ্টার গভীর সম্পর্ক, তাঁর গুণাবলি, ক্ষমতা ও বিশ্ব পরিচালনা পদ্ধতির ব্যাপারে তাদের অন্তরে স্বচ্ছ ধারণা দেওয়া। এক্ষেত্রে অভিভাবকের কাছে বাচ্চার মেধা, স্মৃতিশক্তি ও তার ধারণক্ষমতার ব্যাপারটি পরিষ্কার হওয়া জরুরি। নতুবা বাচ্চা ভুল বুঝতে পারে এবং হিতে বিপরীত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। বাচ্চার মেধা ও ধীশক্তি হলো একটা উর্বর ভূমি। আপনি তাতে যা-ই রোপণ করবেন তার জন্যই এটি হবে উর্বর ক্ষেত্র।
সন্তানদের উন্নত রুচিবোধ ও উত্তম আচরণের ওপর গড়ে তোলা একটি চলমান প্রক্রিয়া। সন্তান বড় ও বুঝমান না হওয়ার পর্যন্ত লাগাতার এর প্রতি যতœবান থাকতে হবে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবনের প্রতিটি ধাপে ধাপে বাবা-মায়ের অনুশাসন ও দিকনির্দেশনার প্রয়োজন হবে। ফলে বড় হওয়ার সঙ্গে বৈরী পরিবেশ তাদের ভেতরে নষ্ট বিশ্বাস গেঁথে দিতে পারবে না।
সন্তানের অন্তরে বিশ্বাসের বীজ বোপণ করার ক্ষেত্রে রাসুলে করিম (সা.) এর অনুসৃত পদ্ধতি সর্বপেক্ষা কার্যকর ও অধিক উপযোগী। আর তিনি মূলত সরাসরি কোরআনের পদ্ধতির বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন। নতুন যে কোনো ব্যাপারে কাউকে ধারণা দেওয়ার ক্ষেত্রে কোরআন কখনও উৎসাহ-উদ্দীপনা, কখনও ভীতিপ্রদর্শকে কাজে লাগিয়েছে। আমরাও সন্তানের প্রতি প্রাথমিক পর্যায়ে উৎসাহব্যঞ্জক পদ্ধতির প্রয়োগ করতে পারি, যাতে তারা স্বাগ্রহে দ্বীন চর্চার প্রতি আকাক্সক্ষা পেশ করে এবং অন্তরে ভয়ের সৃষ্টি না হয়।
সন্তানের অন্তরে বিশুদ্ধ চিন্তাচেতনা ও আকিদা বিশ্বাস লালনের ব্যাপারে তার বাবা-মা কেয়ামতের দিন জিজ্ঞাসিত হবে। কারণ তারাই সন্তানের শুদ্ধ চেতনা ও অশুদ্ধ চেতনা লালনের কেন্দ্রবিন্দু। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রতিটি সন্তান ইসলামের স্বভাবজাত চেতনার ওপর জন্মলাভ করে। পরে তার বাবা-মা তাকে ইহুদিবাদ, খ্রিষ্টবাদ কিংবা অগ্নি-উপাসনার শিক্ষা দেয়।’ (বোখারি : ১৩৩০)। এ হাদিসটি স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করছে যে, স্বভাবগতভাবে সবাই সমান। পরবর্তী সময়ে বাবা-মায়ের বিকৃত কিংবা অশুদ্ধ চেতনা সন্তানকে ভিন্ন মত ও আদর্শের প্রতি ঠেলে দেয়।
সন্তানের আকিদা ও বিশ্বাসের ব্যাপারে বাবা-মায়ের অবহেলা সন্তানের অধিকার বিনষ্টও বটে। কারণ বিশ্বাস শৈশবেই রোপিত হয়। সন্তান বড় হলে নিজের থেকেই পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকে। তখন বাবা-মায়ের বিশেষ শিক্ষা ও দিকনির্দেশনা তাদের কাছে বিষতুল্য মনে হয়। তাদের কাছে এটি অনধিকার চর্চা ও অবৈধ হস্তক্ষেপ আকারে ধরা দেয়। এখন সে নিজেকে চিন্তা-চেতনা ও ভাবনার ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবতে থাকে। আল্লামা ইবনুল কায়্যিম আল জাওজিয়্যাহ (রা.) বলেন, ‘যে বাবা-মা সন্তানকে উপকারী জ্ঞান দিতে অবহেলা করে এবং এমনিতেই ছেড়ে রাখে, তারা বড় ভুলের শিকার হয়ে আছে। অধিকাংশ সন্তান নষ্ট হওয়া এবং আদর্শচ্যুত হওয়ার ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের নেতিবাচক ভূমিকার প্রভাব অনেক বেশি। ফলে বড় হয়ে সেই সন্তানরাই আজ অবাধে গোনাহে লিপ্ত হয়, ফারায়েজগুলো বিনষ্ট করে। আর বাবা-মাকে আজ নীরবে সব সয়ে নিতে হয়। অথচ শৈশবে সামান্য মনোযোগী হলেই আজ তাদের এহেন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো না।’
লেখক : শিক্ষক, দারুল হুদা আশরাফুল উলুম মাদ্রাসা, রাজশাহী