দুই সপ্তাহ আগে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়ে যে সংকট দেখা দিয়েছিল, তা এখনও কাটেনি। এ কমিটিতে বিতর্কিতদের বাদ দেওয়া, পদবঞ্চিতদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মধুর ক্যান্টিনে পদবঞ্চিতদের সংবাদ সম্মেলনে হামলার বিচারÑ এ তিন দফা দাবি পূরণে ২০ মে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা আশ্বাস দিলেও তা পূরণ হয়নি। এজন্য রোববার মধ্যরাত থেকে পদবঞ্চিত ও প্রত্যাশা অনুযায়ী পদ না পাওয়ারা ঢাবির রাজু ভাস্কর্যের
পাদদেশে অবস্থান নিয়েছেন। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা সেখানে অবস্থান করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এমনকি আসন্ন ঈদের দিনও তারা সেখানে অবস্থান করবেন বলে জানিয়েছেন। এ সংকটের মধ্যেই সোমবার দুপুরে নবগঠিত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটির সবাইকে নিয়ে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এ সময় বিতর্কিতরাও ছিলেন বলে জানা গেছে।
জানা যায়, রোববার দিবাগত রাত ১টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে অবস্থান নেন সংগঠনটির পদবঞ্চিত ও প্রত্যাশা অনুযায়ী পদ না পাওয়া নেতারা। তারা কর্মসূচির বিষয়ে সোমবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করেন। এ সময় সংগঠনটির বিগত কমিটির উপদপ্তর সম্পাদক শেখ নকিবুল ইসলাম সুমন বলেন, আমরা এখানে অবস্থান করব, ঈদ আমরা ঢাকায় করার প্রস্তুতি নিয়েছি। যদি আমাদের এ সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান না দেওয়া হয়, তাহলে আমরা রাজু ভাস্কর্যে অবস্থান করব। ঈদের দিনও আমরা রাজু ভাস্কর্যে থাকব।
গত কমিটির ঢাবির রোকেয়া হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি বিএম লিপি আক্তার বলেন, আমি সবার সঙ্গে আছি। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের দাবি না মেনে নেওয়া হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা এখানে অবস্থান করব। তিনি বলেন, আমাদের মূল দাবি হলো ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, মাদকাসক্ত, বিবাহিত, জামায়াত-শিবির পরিবারের যারা; তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১৭ জনের একটি লিস্ট দিয়েছেন। ১১ দিন আগে তাদের নাম ঘোষণা করা হলেও তাদের পদশূন্য ঘোষণা করা হয়নি এবং তাদের নিয়ে আজকে ফুল দিতে যাচ্ছে ছাত্রলীগ। এ ঘটনার আমরা তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। লিপি বলেন, ধানমন্ডির ৩২ নম্বর একটি পবিত্র জায়গা। সেখানে জাতির কলঙ্কিত যারা, তাদের নিয়ে কোনোভাবে ফুল দিতে যেতে পারে না ছাত্রলীগ। এটা আমরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না। এ সময় পাশে অবস্থান করা ছাত্রলীগের পদবঞ্চিতরা ‘শেইম, শেইম’ বলে নিন্দা জানান। কর্মসূচিতে গত কমিটির প্রচার সম্পাদক সাইফ বাবু, কর্মসূচি ও পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদক রাকিব হোসেন, সমাজসেবা সম্পাদক রানা হামিদ, উপদপ্তর সম্পাদক গোলাম মোস্তফা, স্কুল ছাত্রবিষয়ক উপসম্পাদক সৈয়দ আরাফাত, সদস্য তানভীর হাসান সৈকত প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ছাত্রলীগের আংশিক কমিটি প্রকাশের প্রায় ১০ মাস পর ১৩ মে ৩০১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়। ওই দিন সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে পদবঞ্চিত ও প্রত্যাশা অনুযায়ী পদ না পাওয়া ছাত্রলীগের গত কমিটির নেতারা সংবাদ সম্মেলন করতে গেলে সংগঠনের বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অনুসারীরা তাদের ওপর হামলা চালান। এতে কয়েক নারী নেত্রীসহ ১০ থেকে ১২ জন আহত হন। এ ঘটনা নিয়ে আন্দোলনে নামেন পদবঞ্চিতরা। পরে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের আশ্বাসে তারা আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ান। যদিও মধুর ক্যান্টিনের সেই ঘটনায় ২০ মে রাতে পাঁচজনকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করে ছাত্রলীগ। তবে পদবঞ্চিতরা বলছেন, হামলার ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টো ওই হামলায় আহত একজনকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় কমিটিতে বিতর্কিতদের নিয়ে পদবঞ্চিতরা সরব হয়ে উঠলে ১৫ মে দুপুরে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিতর্কিতদের বিরুদ্ধে তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। পরে ওই দিন মধ্যরাতে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বিতর্কিতদের বহিষ্কারে ২৪ ঘণ্টা সময় নেন ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী। সেখানে চিহ্নিত ১৭ জনের মধ্যে বিতর্কিত ১৬ জনের নামও প্রকাশ করেন তারা। সেই ঘোষণার এক সপ্তাহেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এখনও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ঈদের আগে বিষয়টির সুরাহা হবে।
২০ মে রাতে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়ে দলের চার জ্যেষ্ঠ নেতা ও ছাত্রলীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে বৈঠকের পর এক সপ্তাহ ধরে চালিয়ে আসা বিক্ষোভ কর্মসূচি স্থগিত করেছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদবঞ্চিত ও প্রত্যাশা অনুযায়ী পদ না পাওয়া ছাত্রলীগের গত কমিটির নেতারা। ওই বৈঠকে তদন্তের মাধ্যমে ছাত্রলীগের কমিটির ‘বিতর্কিত’ পদগুলো শূন্য ঘোষণা করে যোগ্যতার ভিত্তিতে সেসব পদ পূরণ করার পাশাপাশি মধুর ক্যান্টিনে মারামারির ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের আশ্বাস দেওয়া হয় বলে জানান পদবঞ্চিত ও প্রত্যাশা অনুযায়ী পদ না পাওয়া নেতারা। এ সময় পদবঞ্চিতদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতেরও আশ্বাস দেন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা। এক সপ্তাহ তাদের আশ্বাসের প্রতিফলন না হওয়ায় রোববার মধ্যরাত থেকে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে অবস্থান নেন সংগঠনটির পদবঞ্চিত ও প্রত্যাশা অনুযায়ী পদ না পাওয়া নেতারা।
গত কমিটির স্কুল ছাত্রবিষয়ক উপসম্পাদক সৈয়দ আরাফাত বলেন, কমিটি গঠনের পর থেকে ছাত্রলীগে যে সংকট তৈরি হয়েছিল, তা এখনও কাটেনি। কমিটি থেকে বিতর্কিতদের বাদ দেওয়াসহ যে তিনটি দাবি ছিল, তার একটিও পূরণ হয়নি। তাই ঢাবির রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে অবস্থান নিয়েছে পদবঞ্চিত ও প্রত্যাশা অনুযায়ী পদ না পাওয়া নেতারা। তিনি জানান, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা সেখানে অবস্থান করবেন।
এ প্রসঙ্গে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী বলেন, সেই ১৬ জনের মধ্যে আটজন এখন পর্যন্ত নিজেদের নির্দোষ দাবি করে তাদের কাছে দালিলিক তথ্যপ্রমাণ দিয়েছেন। বাকি যে আটজন এখনও তথ্যপ্রমাণ দিতে পারেননি, ঈদের আগে তাদের পদ শূন্য ঘোষণা করা হবে। তিনি দাবি করেন, যে আটজন নিজেদের নিরপরাধ দাবি করে দালিলিক তথ্যপ্রমাণ জমা দিয়েছেন, সেই তথ্যগুলোর সত্যতা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। বাকি আটজন যেহেতু নিজেদের পক্ষে কোনো তথ্যপ্রমাণ জমা দেননি, তাদের পদ শূন্য হচ্ছেÑ এটা নিশ্চিত। ঈদের আগেই এটি করা হবে। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে খুব সিরিয়াস।