দীর্ঘ নয় বছর বন্ধ থাকার পর নতুন করে এমপিওভুক্ত হচ্ছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। জুনের মধ্যে যোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম ঘোষণা দেওয়া হবে আর কার্যকরী হবে ১ জুলাই থেকে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, এমপিওভুক্তির কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে
আমাদের দেশের সব স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কয়েক ক্যাটাগরিতে বিভক্ত। প্রাথমিক পর্যায়ের বিশাল অঙ্কের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র পরিচালিত অর্থাৎ পুরোপুরি সরকারি। তার পরবর্তী স্তরের ক্ষেত্রে রয়ে গেছে বিশাল সমস্যা। প্রায় ২০ হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে বহু বছর ধরে মাত্র ৩১৭টি ছিল পুরোপুরি সরকারি। বর্তমান সরকার তার আগের মেয়াদে এবং বর্তমান মেয়াদে আরও কিছু মাধ্যমিক বিদ্যালয় সরকারি ঘোষণা করে। সেগুলো এখনও পুরোপুরি সরকারি নিয়মনীতির মধ্যে আসেনি, অনেক ক্ষেত্রে জটিলতা রয়ে গেছে। তারপরও এ পর্যন্ত ৬৬৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে সরকারি বলা যায়। এর বাইরে রয়ে গেছে মাধ্যমিক শিক্ষার বিশাল বহর, যা চলছে বেসরকারিভাবে। বেসরকারির আবার ধরন আছে। এক ক্যাটাগরিতে রয়েছে এমপিওভুক্ত বিদ্যালয় অর্থ প্রতি মাসে মূল বেতন ও নির্দিষ্ট কিছু মেডিকেল অ্যালাউন্স ও বাড়ি ভাড়া (যা সরকারি চাকরিজীবীদের মতো নয়) সরকার থেকে আসে। আর এক ক্যাটাগরিতে আছে শুধু শিক্ষার্থী বেতনে চলে সরকারি অনুমতি আছে। অন্য আর একটি ক্যাটাগরি হচ্ছে পুরোপুরি ব্যক্তিপর্যায়ে পরিচালিত মাধ্যমিক বিদ্যালয়; তবে পাঠদানের অনুমতি আছে। আরও একটি ক্যাটাগরি আছে, যেখানে সরকারি কোনো অর্থ সহায়তাও নেই আবার পাঠদানের অনুমোদনও নেই। এই ছোট দেশে এত ক্যাটাগরি হওয়ার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। যেমনÑ জনসংখ্যার আধিক্য, বেকারত্ব ও শিক্ষার প্রতি রাষ্ট্রীয় অবহেলা। এই প্রেক্ষাপটে নতুনভাবে এমপিওভুক্তির ঘোষণা শিক্ষাক্ষেত্রে এক ধরনের আনন্দের সংবাদই বলা চলে। মাধ্যমিক পর্যায়ে বর্তমানে এমপিওভুক্ত বিদ্যালয় রয়েছে ১৬ হাজার ১৯৭টি। মাধ্যমিক পর্যায়ে নয় হাজারের মতো মাদ্রাসাও রয়েছে, যেগুলোর মধ্যে এমপিওভুক্ত মাদ্রাসা হচ্ছে ৭ হাজার ৬১৮টি। বর্তমানে সব মিলিয়ে ২৬ হাজার ১৮০টি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত। এর মধ্যে কলেজ ২ হাজার ৩৬৫টি। এ খাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মোট বরাদ্দের ৬৫ শতাংশই ব্যয় হয় এমপিওর টাকা দিয়ে। তবে এ সংখ্যা নিয়েও স্বচ্ছ কোনো রিপোর্ট বা ফিগার পাওয়া যায় না। এতদিন আমরা জেনে এসেছি দেশে ২৮ হাজারেরও অধিক এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। খোদ মন্ত্রণালয় থেকেই এ কথা বহুবার বলা হয়েছে। এখন শোনা যাচ্ছে এটি ২৭ হাজরের কাছাকাছি। এসব খবর স্বচ্ছ হওয়া প্রয়োজন, জনগণের স্পষ্টভাবে জানা প্রয়োজন। তাহলে দুই পক্ষেরই সুবিধা হয়।
সরকার সর্বশেষ ২০১০ সালের জুন মাসে ১ হাজার ৬২৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করে, তারপর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণ বন্ধ আছে। এমপিওভুক্তির দাবিতে আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু সরকার এমপিও দিতে পারেনি। নতুন প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১৮ সালের ১২ জুন। ওইদিন এমপিওবিহীন বেসরকারি স্কুল, কলেজ এমপিওভুক্তকরণের নীতিমালা এবং জনবল কাঠামো জারি করা হয়। এরপর একে একে মাদ্রাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানের জন্য আলাদা নীতিমালা প্রকাশ করা হয়। এর মধ্যে জাতীয় নির্বাচন চলে আসে। নির্বাচনকে সামনে রেখে শিক্ষকরাও দাবি আদায়ের জন্য রাজপথে নেমে আসেন। তখন শিক্ষকদের শান্ত করতে গত আগস্টে নীতিমালা অনুযায়ী এমপিওবিহীন প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে অনলাইনে আবেদন চাওয়া হয়। সরকারি আহ্বানে সাড়া দিয়ে ননএমপিওভুক্ত ৯ হাজার ৬১৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আবেদন করে। কিন্তু এত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোনটিকে রেখে কোনটি বাদ দেওয়া হবে, আর বাদ দিলে নির্বাচনের আগে শিক্ষকদের মাঝে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা নির্বাচনের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। এমন অবস্থায় আবেদনকৃত প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য যাচাই-বাছাই নামক বিলম্বের কৌশল অবলম্বন করে মন্ত্রণালয়। তবে সেই তথ্য যাচাই ছাড়াও এমপিওভুক্ত করা হচ্ছে বলে কেউ কেউ বলছেন।
দীর্ঘ নয় বছর বন্ধ থাকার পর নতুন করে এমপিওভুক্ত হচ্ছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। জুনের মধ্যে যোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম ঘোষণা দেওয়া হবে আর কার্যকরী হবে ১ জুলাই থেকে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, এমপিওভুক্তির কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। এ পর্যন্ত জানা গেছে, ২ হাজার ৭৬২টি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা এমপিওভুক্তির জন্য যোগ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে। নীতিনির্ধারকদের ইচ্ছা সবগুলো প্রতিষ্ঠানকেই স্বল্প পরিসরে হলেও এমপিওভুক্ত করা হোক। নানা বিশ্লেষণের পর এ পর্যন্ত ১ হাজার ৭৯৬টি প্রতিষ্ঠান চূড়ান্তভাবে এমপিওভুক্ত হতে পারে। তবে বিষয়টি নির্ভর করছে নতুন প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে অর্থপ্রাপ্তি এবং পরবর্তী বছরে সেই অর্থ বরাদ্দ রাখার ওপর।
এদিকে উল্লেখিত সাড়ে নয় হাজার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২ হাজার ৭৬২টি এমপিও নীতিমালার তিনটি ধারায় বর্ণিত চার যোগ্যতার মানদ- পূরণ করেছে। এগুলোর মধ্যে নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় ৬১৫টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ৭৯৮টি, উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ ৯১টি এবং ডিগ্রি কলেজ ৪৪টি। এছাড়াও দাখিল মাদ্রাসা আছে ৩৬২টি, আলিম মাদ্রাসা ১২২টি, ফাজিল মাদ্রাস ৩৮টি এবং কামিল মাদ্রাসা ২৯টি। কারিগরি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এসএসসি ভোকেশনাল (হাইস্কুল সংযুক্ত) ১৪৬টি, এসএসসি ভোকেশনাল (স্বতন্ত্র) ৪৮টি, দাখিল মাদ্রাসা সংযুক্ত দুটি, এইচএসসি (ব্যবসায় প্রশাসন সংযুক্ত) ৮৯টি, এইচএসসি ব্যবসায় প্রশাসন (স্বতন্ত্র) ২৩৫টি এবং কৃষি ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট ৬২টি।
চার শর্ত হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক স্বীকৃতি, শিক্ষার্থীর সংখ্যা, পরীক্ষার্থীর সংখ্যা এবং পরীক্ষায় পাসের হার। প্রতিটি মানদ-ের জন্য ২৫ নম্বর রাখা হয়েছে। তবে স্বীকৃতিতে ছাড় না দিলে প্রতিষ্ঠান সংখ্যা আরও কমে ২ হাজার ৭৫৬টি হতে পারে বলে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য আবেদন করেছে এর সবগুলোকে এমপিওভুক্ত করলে প্রয়োজন হবে ৪ হাজার ৩৯০ কোটি ১২ লাখ ৫ হাজার টাকা। আর যদি যোগ্য বিবেচিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমপিওভুক্ত করা হয়, তাহলে প্রয়োজন হবে ১ হাজার ২০৭ কোটি ৬৬ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। যদি স্বীকৃতির মেয়াদ বিবেচনা না করে এমপিও দেওয়া হয়; তবে ব্যয় হবে ১ হাজার ২১০ কোটি ৩৭ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। এসব বিষয় উল্লেখ করে এমপিওভুক্তির জন্য টাকা চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আশ্বাস নাকি পাওয়া গেছে। অন্য এক সূত্রে জানা যায়, অর্ধেক অর্থের আশ্বাস পাওয়া গেছে। তবে অর্থের পরিমাণ কোনোটিই কিন্তু কম নয়। তাই শেষ পর্যন্ত ১ হাজার ৭৯৬টি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হতে পারে বলে কোনো কোনো সূত্র বলছে।
শিক্ষক নেতারা বলছেন, ‘এমপিওভুক্তি আমাদের ন্যায্য দাবি হলেও এ দাবি আদায়ে সারা দেশের সব শিক্ষক-কর্মচারীর দফায় দফায় রাজপথে বসে আন্দোলন করতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আমাদের দাবি বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়েছেন; কিন্তু আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি। তারপরও আশা করব, মানবিক দিক বিবেচনা করে দ্রুত আমাদের দাবি বাস্তবায়ন করা হবে।’ আমরা চাই শিক্ষকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, যাতে তারা শিক্ষাদানের মতো মহতী কাজে আরও বেশি মনোযোগী হতে পারেন। এমপিওভুক্তির তালিকা দীর্ঘ হোক কিংবা শিক্ষা পুরোপুরি জাতীয়করণ করা হোকÑ দুটির যে কোনোটিই শিক্ষকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার কথা বলে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্যও চিন্তা করতে হবে। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষকদের চাকরি সরকারি, তাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা মজবুত। এটি রাষ্ট্রের প্রশংসনীয় পদক্ষেপ এবং সিদ্ধান্ত; কিন্তু যখন দেখি যে, প্রাথমিক শিক্ষার মান কাক্সিক্ষত পর্যায়ের ধারেকাছেও নেই, তখন দুঃখ হয়। দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হতে হবে একেকটি সামাজিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এখান থেকে যারা বের হবে তারা হবে সত্যিকারের আদর্শ মানুষ। তাহলে সমাজের প্রতিটি স্তরে যে মূল্যবোধের চরম অবক্ষায় চোখে পড়ে সেটি নিরসন করা সহজ হবে। আর আদর্শ মানুষ যারা তৈরি করবেন তাদের হতে হবে কষ্টিপাথরের মতো। তাহলেই সমাজ থেকে অশান্তি দূর হবে, সমাজে পশুত্বের প্রভাব আর রাজত্ব কায়েম হবে না। কিন্তু কবে হবে সেই প্রতিষ্ঠান? কবে হবে সেই পরিবর্তন? শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নের ওপর যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করতে হবে যেখানে শুধু বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান নয়, থাকতে হবে সততা, মূল্যবোধ, মানবিকতা ও মহানুভবতার শিক্ষা। তবেই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের সান্নিধ্যে, তাদের দক্ষ পরিচালনায় সত্যিকার মানুষ হয়ে প্রতিষ্ঠান থেকে বের হবে। আর তখনই আমরা বলতে পারব, রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে শিক্ষায় বিনিয়োগকৃত অর্থ সঠিক পথেই ব্যয় করা হয়েছে।
ষ মাছুম বিল্লাহ
শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক
বর্তমানে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত
[email protected]