আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ২৯-০৫-২০১৯ তারিখে পত্রিকা

“অর্থনৈতিক ন্যায্যতায় ও টেকসই উন্নয়নে যাকাতের ভূমিকা” শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক

| নগর মহানগর

হজ ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেডের পৃষ্ঠপোষকতায় ২৫ মে শনিবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন ও দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ আয়োজিত ‘অর্থনৈতিক ন্যায্যতায় ও টেকসই উন্নয়নে জাকাতের ভূমিকা’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনার বিষয় সারসপেক্ষপ নিয়ে আজকের

অনুষ্ঠানের শুরুতে উপস্থিত সবাইকে স্বাগত জানিয়ে সঞ্চালক কাজী আলী রেজা আলোচনার মূল উদ্দেশ্য বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, জাকাত দরিদ্রদের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও দারিদ্র বিমোচনে অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। দারিদ্র বিমোচন ও অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠায় জাকাত কী ভূমিকা রাখতে পারে এবং জাকাত সংগ্রহ ও বিতরণে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বা রূপরেখা তৈরিতে সাহায্য করা যায় কী নাÑ তা নিয়ে আলোচনা ও সুচিন্তিত মতামত প্রদানের আহ্বান জানান তিনি।

 

মোহাম্মদ লকিয়ত উল্লাহ

নির্বাহী পরিচালক, হজ ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড

সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে যথার্থভাবে জাকাত প্রদান করে মানুষকে স্বাবলম্বী করা সম্ভব। দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে স্বাবলম্বী করার দ্বারাই টেকসই উন্নয়ন সম্ভব। সবাই যখন স্বাবলম্বী হবে, দারিদ্র্য ঘুচে যাবে, টেকসই উন্নয়নের মাত্রাও তত বৃদ্ধি পাবে। অসংখ্য মানুষ জাকাত দিতে ইচ্ছুক; কিন্তু তারা উপযুক্ত খাত পাচ্ছে না। মানুষ তাদের জাকাত কোথায় কীভাবে আদায় করবে, তা জানতে চাচ্ছে। আহ্ছানিয়া মিশন ১১টি খাতে জাকাত ব্যয় করে। তারা অনাথ-ছিন্নমূল-টোকাই শ্রেণির শিশুদের জন্য পঞ্চগড়ে একটি স্কুল করেছেন। সেই স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য জাকাত ফান্ডের একটি অংশ তারা ব্যয় করেন। সরকারি ব্যবস্থাপনায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে জাকাতের অর্থ সংগ্রহ ও বিতরণ করা হয়। যারা জাকাত দিতে আগ্রহী তাদের অর্গানাইজড করতে হবে এবং যাদের জাকাত দেওয়া হচ্ছে তারা স্বাবলম্বী হচ্ছে কি না, তা মনিটরিং করতে হবে। যাদের জাকাত দেওয়া হচ্ছে তাদের স্বাবলম্বী করা না গেলে জাকাতের দৃশ্যমান সুফল পাওয়া যাবে না। জাকাতের দৃশ্যমান ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে যাদের ওপর জাকাত ফরজ হয়েছে তাদের প্রায় সবাই জাকাত দেবে। মানুষ লাখ লাখ, কোটি কোটি টাকা জাকাত দেবে, যদি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জাকাত বিতরণ করা হয়, যথার্থ খাতে ব্যয় করা হয়।

ড. এম এহছানুর রহমান 

নির্বাহী পরিচালক, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন

আমি আয়োজকদের অবস্থান থেকে যে কারণে এই গোলটেবিলের আয়োজন তা তুলে ধরতে চাই। যাতে পরবর্তী বিজ্ঞ আলোচকরা তাদের মূল্যবান সুপারিশ তুলে ধরতে পারেন। আমরা এ আয়োজনটি করছি মূলত সরকার যে অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা করতে যাচ্ছে সেটিকে সামনে রেখে। তার কারণ সরকার সপ্তম যে পরিকল্পনা নিয়েছিল তা শেষ হতে যাচ্ছে। একুশ সাল থেকে অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে। আমরা আগে থেকেই চাইছি যেন জাতীয় পরিকল্পনার সঙ্গে এর সমন্বয় ঘটানো যায়।  আমরা জানি, জাকাত চ্যারিটি নয়, বাধ্যতামূলক ইবাদত। আমরা চাই ট্যাক্স যেভাবে বাধ্যতামূলক আদায় করা হয়, জাকাতও সেভাবে মুসলিমপ্রধান দেশে বাধ্যতামূলক করা হোক। সেটা করতে পারলে জাকাত ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ অবধারিত। একটি পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংকে শুধু এফডিআরের এক বছরের টাকার ওপর জাকাত আসে ৩০ হাজার কোটি টাকার ওপর। তাহলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জাকাত সংগ্রহ করা হলে সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং আন্তর্জাতিক এসডিজি বাস্তবায়নে অভ্যন্তরীণ সোর্স থেকে বিরাট জোগান দেওয়া সম্ভব। ১৭টি এসডিজির মধ্যে রয়েছে দারিদ্র্যবিমোচন ও ক্ষুধামুক্তি, খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টির লক্ষ্য অর্জন, টেকসই কৃষি ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন নিশ্চিত করা, সব বয়সের সবার কল্যাণে কাজ করে যাওয়া, অন্তর্ভুক্তি ও সমতাভিত্তিক মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা, আজীবন শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা ইত্যাদিÑ এসব বাস্তবায়নে যে বিশাল ব্যয় দরকার তার অনেকখানির জোগান আসতে পারে এই জাকাত খাত থেকে। যদি সেটা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কালেক্ট করা হয়। দেশের শতকরা ১১ পার্সেন্ট মানুষের বাস দারিদ্র্যসীমার নিচে। অর্থাৎ দুই কোটি মানুষ দরিদ্র। জাকাত এদেরই প্রাপ্য। এদের পেছনে জাকাতের বিপুল অর্থকে ওই লক্ষগুলো বাস্তবায়নে কাজে লাগানো হলে দারিদ্র্যবিমোচন কিংবা শতভাগ দারিদ্র্য নির্মূল একেবারেই সম্ভব। আমরা সে লক্ষ্যেই চাইছি জাকাতের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হোক। 

মুফতি শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অফ সুফিজম
কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘ইহা প্রাপ্য অভাবগ্রস্ত লোকদের; যারা আল্লাহর পথে এমনভাবে ব্যাপৃত যে, দেশময় ঘোরাফেরা করতে পারে; যাচ্ঞা না করার কারণে অজ্ঞ লোকেরা তাদের অভাবমুক্ত বলে মনে করে; তুমি তাদের লক্ষণ দেখে চিনতে পারবে। তারা মানুষের কাছে নাছোড় হয়ে যাচ্ঞা করে না।’ (সূরা বাকারা : ২৭৩)। জাকাত কাদের জন্য? যারা আল্লাহর কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে ঘোরাফেরা করতে পারে না, আত্মমর্যাদার কারণে কারও কাছে কিছু চাইতে পারে না, ভিক্ষা করে না, সুওয়াল করে নাÑ জাকাত দানের ক্ষেত্রে তারা অগ্রাধিকার পাবে। জাকাতা দানের ক্ষেত্রে দুটি বিষয় লক্ষ রাখতে হবে: প্রকৃত হকদার জাকাত পাচ্ছে কি না। ছিন্ন বস্ত্র ও শীর্ণ চেহারা দেখে জাকাত দেওয়া যাবে নাÑ তার প্রকৃত অবস্থা কী সেটা জেনে তারপর জাকাত আদায় করতে হবে। তা না হলে ফরজ জাকাত আদায় হবে না। দ্বিতীয় বিষয় হলো, জাকাতের দ্বারা দারিদ্র্য বিমোচন হচ্ছে কি না, সেটা বিবেচনায় রাখতে হবে। জাকাত ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যারা জাকাত ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী, তারা জাকাত ফান্ড থেকে বেতন নিতে পারবেন। ওআইসির ফিকাহ একাডেমি কর্তৃক ঘোষিত নীতিমালা অনুযায়ী জাকাত ফান্ড থেকে সর্বোচ্চ ১২.৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জ কাটা যাবে। আর জাকাত প্রদান করতে গিয়ে আত্মপ্রচার হলো শিরকের শামিল। এসব ঘটনায় যারা হতাহত হয়েছে তাদের ক্ষতিপূরণ ওই জাকাতদাতাকে বহন করতে হবে। যারা জাকাতের হকদার নয়, তারা যেন জাকাত থেকে কোনোভাবে লাভবান না হয়, তা খেয়াল রাখতে হবে। 

মো. রায়হান উদ্দিন খান

সিইও, সিলেকশন টেকনোলজি

সুষ্ঠুভাবে জাকাত প্রদানের মাধ্যমে সমাজে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। একটি মহামানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জাকাতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাকাত প্রদানের মাধ্যমে মানি সার্কুলেশন বৃদ্ধি পায়। মানি সার্কুলেশন বৃদ্ধি করাও জাকাতের একটি উদ্দেশ্য। মানি সার্কুলেশন বৃদ্ধি পেলে অর্থনীতি গতিময় হয়। এতে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হয়। টেকসই উন্নয়নের জন্য জাকাতের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ। 

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

সাবেক চেয়ারম্যান, এনবিআর
জাকাত গরিবের হক, তার প্রতি করুণা নয়। আল্লাহ তায়ালা কোরআনে বলেছেন, ‘এবং তাদের ধন-সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতের হক রয়েছে।’ (সূরা জারিয়াত : ১৯)। তার মানে হলো, নেসাবের মালিক যখন ১০০ টাকার মালিক হন, তার পুরোটার মালিক আপনি নন। এর আড়াই টাকার মালিক অন্যরা। এই আড়াই টাকা যদি প্রাপ্য লোকদের না দেন, তাহলে আপনার অবশিষ্ট টাকা অপবিত্র হয়ে যাবে। 
আল্লাহ তায়ালা এমন বিধান দেওয়ার উদ্দেশ্য সমাজে ও রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক ন্যায্যতা নিশ্চিত করা। এই ন্যায্যতা বিধানের মাধ্যমেই সাধিত হয় টেকসই উন্নয়ন। এর জন্য দরকার প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ। আমরা যদি ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিই, তাহলে দেখতে পাইÑ রাসুল (সা.) এর আদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবেই জাকাত কালেকশন করা হয়েছে। খোলাফায়ে রাশেদিনের আমলেও তাই করা হয়েছে। ব্রিটিশদের শাসনের আগ পর্যন্ত সব মুসলিম খলিফার আমলেই কম-বেশি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ বহাল ছিল জাকাত কালেকশনের জন্য। ব্রিটিশরা এসে ইসলামের ধারাবাহিক সিস্টেমগুলোকে মিসমার করে দেয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জাকাত কালেকশনের চর্চা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশেও বিগত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন উদ্যোগ চলছে জাকাতের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে। সরকারি উদ্যোগে ইসলামিক ফাউন্ডেশন এবং বেসরকারি উদ্যোগে সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্টসহ কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছে। এখন এটাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে করা দরকার। জাকাত দিলে কর মওকুফের আইন করা যায়।

ড. মুহাম্মদ আবদুর রশীদ

অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জাকাতের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোরআন বলছে, ‘যাতে ধনসম্পদ শুধু তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যেই পুঞ্জীভূত না হয়।’ (সূরা হাশর : ৭)। অর্থাৎ জাকাত ফরজই করেছেন মহান আল্লাহ ধনী-গরিবের ব্যবধান দূর করার জন্য। ধনীরা শুধু ধনী আর গরিব শুধু গরিব হতেই থাকবে ইসলাম সে সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। জাকাতের মাধ্যমে গরিবের জন্য উঠে আসার পথ করে দিয়েছে। গরিবকে অনুগ্রহ হিসেবে নয়, অনুদান হিসেবে নয়Ñ একেবারে ওই টাকার মালিক বানিয়ে দেওয়ার নাম জাকাত। মালিক না বানালে জাকাত আদায় হবে না। তাই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জাকাত আদায় করতে হলে তাদের গরিবের মালিকানা অর্জনের ব্যাপারটির প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। মালিক হওয়ার অর্থ হলো টাকা খরচ করার শতভাগ অধিকার তার থাকতে হবে। সন্দেহ নেই, যদি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও সততা নিশ্চিত করা যায় তাহলে শুধু ৩০ হাজার কোটি টাকা শুধু নয়, ট্যাক্সের মতো প্রতিটি অ্যাকাউন্ট থেকে নিসাব পরিমাণ হলে এক বছর অ্যাকাউন্টে পড়ে থাকলে সরাসরি কেটে সরকারি প্রতিষ্ঠানকে দিলে এই অঙ্ক আরও তিন-চারগুণ বেশি হবে। এ থেকে ১১ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচের জনগোষ্ঠীকে সর্বোচ্চ মাত্র ১০ বছরের মধ্যে উন্নয়নের মহাসড়কে আনা সম্ভব।  অভিজ্ঞতায় দেখেছি এক-দুজন ব্যক্তিও নিজেদের জাকাত দিয়ে কোনো পরিবার বা এলাকার দারিদ্র্যবিমোচন করেছেন। 

ড. এসএম খলিলুর রহমান

সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন
বাংলাদেশে জাকাত দেওয়ার লোকের অভাব নেই; কিন্তু বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠানের অভাব রয়েছে এবং বিশ্বস্ত লোকবলের অভাব রয়েছে। ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন ২০০৫ সাল থেকে অফিসিয়ালি জাকাতের টাকা উত্তোলন শুরু করে। ওই বছর ২২ লাখ ১৪ হাজার ৩২০ টাকা জাকাত আদায় হয় এবং বিতরণ করা হয়। আহ্ছানিয়া মিশনের জাকাত ব্যবস্থাপনা কমিটি রয়েছে। শরিয়া কাউন্সিলে ছয়জন সদস্য রয়েছেন। জাকাত ব্যবস্থাপনার জন্য নিযুক্ত লোকবল রয়েছে। জাকাত ফান্ড থেকে ৭.৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জ (ম্যানেজমোন্ট কস্ট) হিসেবে ব্যয় করার নীতি রয়েছে; কিন্তু আমরা ২০০৫ থেকে ২০১৯ সালের আজ পর্যন্ত একটি পয়সাও সার্ভিস চার্জ হিসেবে ব্যয় করিনি। যত টাকা জাকাত উত্তোলন হয়েছে তার পুরোটাই আমরা যথার্থ খাতে যথাযথভাবে ব্যয় করেছি। আমরা জাকাত ফান্ড থেকে দরিদ্র ও দুস্থদের জন্য টাকা বিতরণ করি, অসহায় রোগীদের জন্য টাকা বিতরণ করি। আমরা অনাথ ও ছিন্নমূল শিশুদের জন্য শিশুপল্লি নির্মাণ করেছি। সেখানে সহস্রাধিক শিশুকে লালনপালন করা হয়, সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করা হয়। ২০১৫ সাল থেকে আহ্ছানিয়া মিশন ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনের কাজ শুরু করেছে। এখন পর্যন্ত ৫৯৯  জন ভিক্ষুককে পুনর্বাসনের আওতায় আনা হয়েছে। আহ্ছানিয়া মিশন মাদকাসক্তদের নিয়ে কাজ করছে। গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর গজারিয়া পাড়ায় আমাদের মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র রয়েছে। যশোরের ভেকুটিয়ায় আমাদের মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র রয়েছে। রাজধানীর শ্যামলীতে রয়েছে নারী মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র। মাদকাসক্তদের নিরাময় ও পুনর্বাসনে আহ্ছানিয়া মিশনের কর্মতৎপরতা দিন দিন জোরদার হচ্ছে।

হাফেজ মাওলানা নুরুল হক

ইমাম, গাউসুল আজম জামে মসজিদ
প্রত্যেক মসজিদে এ কথা বোঝানো উচিত যে, জাকাত একটি ফরজ বিধান। ইমামদের এ ব্যাপারে সচেতন ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা কোরআনে বলেছেন, ‘যেদিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেওয়া হবে, সেদিন বলা হবে, ইহাই তা, যা তোমরা নিজেদের জন্য পুঞ্জীভূত করতে। সুতরাং তোমরা যা পুঞ্জীভূত করেছিলে তা আস্বাদন করো।’ (সূরা তওবা : ৩৫)। সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখলে এবং জাকাত আদায় না করলে বা জাকাত আদায়ে টালবাহানা ও অপকৌশল অবলম্বন করলে অবশ্যই তাকে জাহান্নামের কঠিন আজাব ভোগ করতে হবে। জাকাত প্রদানের মাধ্যমে যেমন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়, তেমনি জাকাতের দ্বারা একটি দেশের উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব। 

ড. মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া

সিইও, সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্ট
জাকাতের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ শব্দটি আমার বড় পছন্দ হয়েছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এ ধারণার প্রচলন চাইছি। দেখুন, জাকাতের বিধান আল্লাহ বাস্তবায়ন করেছেন তাঁর নবীর মাধ্যমে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন রাষ্ট্রপ্রধান। তিনিই জাকাতের ব্যবস্থাপনা ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পূর্ণতা দিয়েছেন। এর চেয়েও বড় কথা, সূরা তওবায় জাকাতের আটটি খাতের মধ্যে ‘ওয়াল আমিলিনা আলাইহা’ বলে তৃতীয় খাত বানানো হয়েছে জাকাত ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে। এর মাধ্যমে প্রকারান্তরে আল্লাহ তায়ালাই প্রাতিষ্ঠানিক জাকাত ব্যবস্থার কথা বলেছেন।  সুন্দর পরিকল্পনা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা গেলে প্রাতিষ্ঠানিক জাকাত কালেকশনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের দারিদ্র্যবিমোচন ও টেকসই উন্নয়ন শতভাগ নিশ্চিত করা সম্ভব। এটা কোনো থিউরি নয়, বাস্তবতা। ইসলামের ইতিহাসে অন্তত দুটি উদাহরণ দেওয়া যায় এক্ষেত্রে। ওমর বিন খাত্তাব (রা.) এর শাসনামলে ইয়ামানের গভর্নর কেন্দ্রে চিঠি লিখে জানতে চান তার এলাকায় জাকাত নেওয়ার মতো কেউ নেই। তাই রাষ্ট্রের কালেকশন করা জাকাত কাকে দেবেন? তেমনি ওমর বিন আবদুল আজিজ (রহ.) এর যুগে মিসর থেকে চিঠি আসে। সেখানকার গভর্নর জানান একই সমস্যার কথা। সবাই জাকাতদাতা তথা ধনী হয়ে গেছে, এখন জাকাত নেওয়ার মতো গরিব নেই। জাকাত যা উঠেছে সেটা কোথায় ব্যয় করি? 
লক্ষ করে দেখুন, ইসলামের নামাজ জামাতবদ্ধ বা সামষ্টিক ইবাদত। রোজার ইফতারি ও তারাবি সামষ্টিক ইবাদত। হজ সামষ্টিক ইবাদত। সব ক্ষেত্রেই জামাত বা সামষ্টিকতা ইসলামে এক ইতিবাচক দিক। এ থেকে বোঝা যায় জাকাত আদায় ও ব্যবস্থাপনার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নতুন ধারণা নয়।  আরেকটা ব্যাপার। জাকাত ফরজ তথা বাধ্যতামূলক। এটা কেউ অস্বীকার করলে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র ব্যবস্থা নেবে। তার বিরুদ্ধে ফোর্স করা যাবে। নবীজি (সা.) এর ইন্তেকালের পর খলিফা হলেন আবু বকর (রা.)। তখন কেউ কেউ এ কথা বলে রাষ্ট্রকে জাকাত দিতে অস্বীকার করল যে, আমরা নবী (সা.) কে জাকাত দিতাম। তিনি নেই তাই আমরা জাকাত দেব না। আবু বকর (রা.) বললেন, ‘আল্লাহর কসম, যে ব্যক্তি সালাত ও জাকাতের মধ্যে পার্থক্য করবে, আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। নবীজি (সা.) কে যে উটের রশিও জাকাত দিত তা যদি দিতে অস্বীকার করে তবে তার বিরুদ্ধে আমি লড়াই করব।’

মাওলানা সাইফুল কবির

ইমাম ও খতিব, বঙ্গবভন জামে মসজিদ
রাসুলুল্লাহ (সা.) মুয়াজ (রা.) কে ইয়ামানে পাঠানোর সময় বলেছিলেন সেখানকার অধিবাসীদের নামাজের পর জাকাতের আদেশ দিতে। সেখানে তিনি জাকাত সম্পর্কে বলে দিয়েছিলেন, ‘তুমি এটা ধনীদের থেকে গ্রহণ করবে এবং গরিবদের মাঝে বিতরণ করবে। এ থেকেই বোঝা যায় জাকাতের উদ্দেশ্য কী। দারিদ্র্যবিমোচন এর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।  জাকাতের টাকা উত্তোলনের সঙ্গে সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে খুব দ্রুত যোগ্য পাত্রে হস্তান্তরের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। এনবিআর বা অন্যসব প্রতিষ্ঠান ট্যাক্সকে যতটা উৎসাহিত করে, জাকাতকে ততটা করে না। করবেও না। কারণ ট্যাক্সের টাকা নয়ছয় করা যায় নানা পর্যায়ে, নানা উপায়ে। কিন্তু জাকাতের টাকা যেহেতু পুরোটাই একটা ধর্মীয় খাত। এর প্রাপকও ধর্মের নির্দেশনা মতো নির্দিষ্ট, এ টাকা নয়ছয় করতে চাইলে বিবেক থেকে সায় মেলে না। তাই জাকাতকে যদি সততা ও নিখুঁত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করা হয় তাহলে এই টাকা দুর্নীতিমুক্তভাবে কাজে লাগিয়ে দারিদ্র্যবিমোচন দ্রুতই করা সম্ভব।

মসিউদ্দৌলা

ডিএমডি, হজ ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড
জাকাতের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করে জাকাত রিমাইন্ডার ডিক্লারেশন করা যেতে পারে। এতে ব্যাংকের কর্মকর্তারা গ্রাহকদের টাকা জমা হওয়ার পর জাকাত প্রদানের উপযুক্ত হলে রিমাইন্ডার দিতে পারবেন। ব্যাংকে যাদের ১ লাখ বা তার চেয়ে বেশি টাকা এক বছর বা তার চেয়ে বেশি সময় ধরে পড়ে আছে ব্যাংক থেকে তাদের রিমাইন্ডার দেওয়া হবে। এভাবে সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে এবং যারা জাকাত দিতে আগ্রহী তারা সময় হলে জাকাত দেওয়ার সুযোগ পাবে। গোটা বাংলাদেশে সব ব্যাংকে যত গ্রাহক আছেন তাদের সবাইকে নির্দিষ্ট সময়ে রিমাইন্ডার দিতে পারলে প্রাতিষ্ঠানিক জাকাত ব্যবস্থাপনায় গতি সঞ্চার হবে।

কাজী রফিকুল আলম


সভাপতি
ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন
অর্থনৈতিক ন্যায্যতায় ও টেকসই উন্নয়নে জাকাতের ভূমিকা শীর্ষক আজকের আলোচনায় অংশ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামত তুলে ধরার জন্য সকল আলোচককে ধন্যবাদ জানাই। সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। 


প্রফেসর ড. এ আর এম আলী হায়দার মুর্শিদি
অধ্যাপক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অর্থনৈতিক ন্যায্যতায় ও টেকসই উন্নয়নে জাকাতের ভূমিকা শীর্ষক আজকের আলোচনা আল্লাহ কবুল করুন। এমন উদ্যোগ নিয়মিত করার তাওফিক দান করুন। আল্লাহ আহ্ছানিয়া মিশনকে আরও এগিয়ে নিন এবং দরিদ্রদের সহায় হোন।

কাজী আলী রেজা
সঞ্চালক 

যুগ্ম সম্পাদক, দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ
জাকাতের ওপর আজকের এই আলোচনা আমাদের সকলকে উদ্বুদ্ধ করবে। আপনাদের সবাইকে আলোচনায় অংশ গ্রহণ করা জন্য ধন্যবাদ জানাই।  মোনাজাত পরিচালনা করলেন প্রফেসর ড. এ আর এম আলী হায়দার মুর্শিদি। মোনাজাতের মাধ্যমেই শেষ হলো আজকের গোলটেবিল বৈঠক।