ক্রিকেটের জন্মভূমি ব্রিটিশ মুল্লুক ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠেয় ২০১৯ বিশ্বকাপের দ্বাদশ আসরে অন্যতম শক্তিধর হিসেবে সবার নজর কেড়েছে বাংলাদেশ। ক্রিকেটপ্রাজ্ঞ রথী-মহারথীদের বিজ্ঞ বিচারে বাংলাদেশ ফোরফেভারেট দল। ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের পাশাপাশি সেমিফাইনালে বাংলাদেশের ওঠার সম্ভাবনা দেখছেন ভারতের সাবেক ব্যাটসম্যান ও ধারাভাষ্যকার আকাশ চোপড়া। তার ইউটিউব চ্যানেলে বিশ্বকাপের দলগুলোর সম্ভাবনা নিয়ে বিশ্লেষণে আকাশ বলেছেন, ‘সেমিফাইনালে বাংলাদেশ হবে আমার চতুর্থ দল। নিউজিল্যান্ডও অনেক লড়াই করবে এ স্থানের জন্য। পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকাও পিছিয়ে থাকবে না। তবে বাংলাদেশকে আমি এগিয়ে রাখব।’ বাংলাদেশ ক্রিকেটের চরম বৈরী রমিজ রাজা পাকিস্তান-বাংলাদেশের পরিসংখ্যান টেনে বলেন, পাকিস্তানের চেয়ে বিস্ময়করভাবে বাংলাদেশ এগিয়ে। ক্রিকেটের বিশ্ব মঞ্চে দুই দলের একমাত্র সাক্ষাৎ ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে। সেবার নর্দাম্পটনে পাকিস্তানকে ৬২ রানে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। সে ম্যাচের কথা মনে করিয়ে রমিজ বলেন, ‘১৯৯৯-এর ম্যাচটি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। কারণ ওই সময় পাকিস্তান খুবই শক্তিশালী ছিল। অথচ ওই দলটিকেই বংলাদেশ হারিয়ে দেয়।’ এই সাবেক পাকিস্তান ক্রিকেটারের মতে, রাউন্ড রবিন পর্বে বাংলাদেশের কাছে হেরে যাবে সরফরাজ আহমেদের পাকিস্তান। অন্যদিকে বিশ্বকাপ যুদ্ধে নামার পূর্ব মুহূর্তে আইসিসি ওয়ানডে র্যাংকিংয়ে অলরাউন্ডারের শীর্ষ স্থান ফিরে পাওয়া বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকে নিয়ে ভিন্ন কথা বলেছেন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে দুবারের বিশ্বকাপজয়ী সাবেক অধিনায়ক রিকি পন্টিং। ২ জুন বিশ্বকাপ প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশের মুখোমুখি হওয়া দক্ষিণ আফ্রিকাকে খানিকটা সতর্ক করে পন্টিং বলেন, ‘বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের প্রধানতম অস্ত্র সাকিব প্রোটিয়াদের জন্য বড় হুমকি হিসেবেই দেখা দেবেন।’ (সূত্র : দেশ রূপান্তর)।
ভারতের প্রধান কোচ রবি শাস্ত্রীর ভাবনায়ও ঠাঁই পেয়েছে বাংলাদেশ। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ দল ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছিল। ওরা কোথায় ছিল আর এখন কোথায় আছে। এবারের বিশ্বকাপে অনেক শক্ত প্রতিযোগী হবে বাংলাদেশ।’ এছাড়া ভারতের সাবেক লেগ স্পিনার অনিল কুম্বলেও বাংলাদেশের ব্যাপারে আশাবাদী। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশকে আমি কখনই ছোট হিসেবে দেখতে চাই না। সম্প্রতি তারা ভালো খেলছে এটাই আমার কাছে বড় মনে হয়েছে। (সূত্র : আমাদের সময়)।
স্বর্ণ যেমন পুড়ে পুড়ে খাঁটি হয়, তেমনি বাংলাদেশের ক্রিকেট না পারার তীব্র দহনে পুড়ে পুড়ে জ্বলে উঠেছে আপন শক্তিতে। সব ভাবনার উচ্চ সারিতে জায়গা করে নিয়েছে ম্যাশ-মুশির বাংলাদেশ। টাইগারদের ক্রিকেট আধিপত্য বিশ্ব ক্রিকেট চিন্তকদের চেতনায় চিড় ধরিয়েছে। তাদের চিন্তার জগতে ঘুরেফিরে আসছে টিম টাইগার্সের তাক লাগানো ক্রিকেট প্রদর্শনীর কথা। এরই ধারাবাহিকতায় ক্রিকেট পরাশক্তিদের হটিয়ে আলোচনার শীর্ষ চূড়ায় অবস্থান করা মাশরাফি এক্সপ্রেস এবারের বিশ্বকাপ আলোচনায় ইংল্যান্ড, ইন্ডিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে সমানতালে লিখিয়েছে নাম।
যে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবারের বিশ্বকাপ, সেই ব্রিটিশ বধের গল্প কবে রচনা করেছিল বাংলাদেশ সেটা স্মরণ আছে তো! সেই গত বিশ্বকাপে। ১৯৯৯ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে অংশ নিয়েই আলোচনায় এসেছিল টাইগাররা। বিশ বছরের সেই দীর্ঘ সময় পেরিয়ে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন দেখতেই পারে। তাই আকাশ চোপড়া, অনিল কুম্বলে, রমিজ রাজা, রিকি পন্টিং, রবি শাস্ত্রী ছাড়াও অনেক সাবেক ক্রিকেটার বাংলাদেশকে খাটো করে দেখছেন না। ২০১৮ সালে এশিয়া কাপের ফাইনালে ভারতের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত লড়াই করে হেরেছিল বাংলাদেশ। এছাড়া সম্প্রতি আয়ারল্যান্ডে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ত্রিদেশীয় সিরিজ জিতেছে দলটি। তাই ফুরফুরে মেজাজে টাইগার টিম। ২ জুন মাঠে নামবে তারা। ইংল্যান্ডের ব্যাটিং স্বর্গে নেমে প্রতিটি দলই খেলবে ৯টি ম্যাচ। বাংলাদেশও তাই। সেমিফাইনালে যেতে হলে ৫টি জিততে হবে। পারবে কি জিততে বাংলাদেশ! সেটাই এখন বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে।
২০১৭ সালে বাংলাদেশ ইংল্যান্ডে চ্যাম্পিয়ন ট্রফির সেমিফাইনালে খেলেছে। যেভাবে সেবার টাইগাররা নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছে সেটা সবার মনে গেঁথে গেছে। আগের বিশ্বকাপ ২০১৫-তে তো বাংলাদেশ ইংল্যান্ডকে বের করে দিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে। তাই এবারও আলোচনায় বাংলাদেশ।
১৯৮৬ সাল থেকে বাংলাদেশের ওয়ানডে খেলা শুরু। তবে প্রথম উৎসবের উপলক্ষ খুঁজে পেল ১৯৯৭ সালে। আইসিসি ট্রফি জয় করে আকরাম খানরা দেশের কোটি মানুষকে রাস্তায় নামিয়ে আনেন। এরপর ১৯৯৯ সালে প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে পাকিস্তানকে হারানো। তারপর দীর্ঘ বিরতি। ২০০৫ বা ২০০৬ সালের দিকে কিছু জয়, ২০০৮ বা ২০১০ সালে অল্পবিস্তর ধারাবাহিকতা দেখা গেল বটে। কিন্তু যে প্রতীক্ষায় সমর্থকরা, তার দেখা মেলে না। আর এ বৃত্ত থেকে বের করে দলকে একটু স্বস্তি দিতেই ২০১৪ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের সীমিত ওভারের দায়িত্বে ফিরিয়ে আনা হলো ২০০৯ সালেই ‘ফুরিয়ে যাওয়া অধিনায়ক’ মাশরাফি বিন মুর্তজাকে। তখন থেকেই পরিবর্তন। এ থেকেই বাংলাদেশ খুঁজে পায় কীর্তি ক্রিকেটের সন্ধান।
ক্রিকেটে বাংলাদেশ এখন পরিণত দল এতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশে জয়টা এখন আর অঘটন বলে চালিয়ে দিতে পারবে না ক্রিকেটবোদ্ধারা। বাজে বক মরার গল্প সাজাতে পারবে না কেউ। ক্রিকেটে টাইগাররা শিশু থেকে সাবালকের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে শাসন করছে বাঘা বাঘা সব দলকে। গত কয়েক বছর ধরে দারুণ খেলছে বাংলাদেশ। ক্রিকেটে ঘোর বিরোধীরাও তা শিকার করছে একবাক্যে। বিশেষ করে ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের পর বাংলাদেশের ক্রিকেটের গ্রাফটা ঊর্ধ্বমুখী। এ সময়ে ভারত, অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলগুলোকে হারিয়েছে বাংলাদেশ। তাই এবারও আশায় বুক বেঁধে আছে বাঙালি। ২০১৯ বিশ্বকাপে পারবে তো মাশরাফির বাংলাদেশ? হ
বিশ্বজিত রায়
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]