জাতিসংঘ ১৯৪৮ সালের ২৯ মে প্রথমবারের মতো মধ্যপ্রাচ্যে শান্তিরক্ষী মোতায়েন করে। এ পর্যন্ত জাতিসংঘ বিশ্বের ৭১টি দেশে ১০ লাখেরও বেশি শান্তিরক্ষী মোতায়েন করেছে শত শত কোটি মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে। বিশ্বব্যাপী শান্তি, স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশের সংবিধানে যে অঙ্গীকার করা হয়েছে, সেখান থেকেই বিশ্ব শান্তিরক্ষায় আমাদের অংশগ্রহণের বিষয়টি উৎসারিত। তাছাড়া ১৯৭১ সালে শান্তি, গণতন্ত্র ও সর্বোপরি দেশের স্বাধীনতার জন্য ৩০ লাখ বাঙালির আত্মত্যাগও বিশ্ব শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণের অন্যতম কারণ। তাছাড়া আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র হচ্ছে : সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়। এভাবেই রাষ্ট্রীয় আদর্শ অনুযায়ী বিশ্ব শান্তিরক্ষায় আমাদের কাজ করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ১৯৮৮ সালে ইরাক-কুয়েতে ১৫ জন সামরিক পর্যবেক্ষক প্রেরণের মধ্য দিয়ে সর্বপ্রথম জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। ১৯৮৮ সালে প্রথম শান্তিরক্ষী প্রেরণের পর বাংলাদেশ সবসময়ই শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশের মর্যাদা পেয়ে আসছে। ২০০০ সালের প্রথম দিকে বাংলাদেশ প্রথম শীর্ষস্থানীয় শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশের মর্যাদা পায়। এ ধারা এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে। বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের দায়িত্ব পালনে পক্ষপাতহীনতা, পেশাদারিত্ব, উচ্চমানের শৃঙ্খলা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যেসব দেশে সৈন্য প্রেরণ করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ কম্বোডিয়া, কুয়েত, হাইতি, বসনিয়া, পশ্চিম সাহারা, সিয়েরা লিওন, লাইবেরিয়া, আইভরি কোস্ট, কঙ্গো, মধ্য আফ্রিকা, মালি, সোমালিয়া, উগান্ডা, নামিবিয়া, মোজাম্বিক, জর্জিয়া, ইথিওপিয়া/ইরিত্রিয়া, বুরুন্ডি, সোমালিয়া, রুয়ান্ডা, চাদ, পূর্ব তিমুর, আফগানিস্তান, ক্রোয়েশিয়া, ইরান, ইরাক, সাউথ সুদান ও দারফুর (সুদান)। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এ পর্যন্ত ৪০টি দেশে মোট ৫৪টি মিশন সম্পন্ন করেছে। আর মিশন সম্পন্নকারী শান্তিরক্ষী হচ্ছেন ১ লাখ ৩২ হাজার ৮৩৭ জন। বর্তমানে জাতিসংঘ সদর দপ্তর ও অন্য নয়টি মিশনে মোট ৫ হাজার ৭৮ সেনাসদস্য কর্মরত আছেন। দেশগুলো হচ্ছেÑ কঙ্গো, লেবানন, সাউথ সুদান, দারফুর, পশ্চিম সাহারা, মালি, মধ্য আফ্রিকা, হাইতি ও সুদান। এ পর্যন্ত ৩১১ মহিলা শান্তিরক্ষী জাতিসংঘ মিশন সম্পন্ন করেছেন এবং বর্তমানে ৬৮ জন কর্মরত আছেন। জাতিসংঘ মিশনে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সেনাবাহিনীর ১১৭ শান্তিরক্ষী শহীদ হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ২০৯ জন। জাতিসংঘ মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মোট ছয়জন কর্মকর্তা ফোর্স কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাছাড়া সেক্টর কমান্ডার/ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ৫১ জন অফিসার। ফোর্স কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আবদুস সালাম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আনিসুর রহমান, লে. জেনারেল আবু তৈয়ব মোহাম্মদ জহিরুল আলম, মেজর জেনারেল আবদুল হাফিজ, মেজর জেনারেল ফজলে এলাহী আকবর এবং মেজর জেনারেল মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির। বিশ্ব শান্তি রক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দ্রুত উত্থান দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত/প্রচারিত হচ্ছে এবং বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদদের মহলে আলোচিত ও প্রশংসিত হচ্ছে। বাংলাদেশি সেনাসদস্যদের দায়িত্ব পালনে পেশাদারিত্ব, আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, শৃঙ্খলা ও দক্ষতা বিশ্বব্যাপী প্রশংসা পাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী দ্বন্দ্ব-সংঘাত এখনও অব্যাহত আছে। তাই ধারণা করা হচ্ছে, শান্তিরক্ষা কার্যক্রম ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। তবে সংঘাত সংঘর্ষের ধরন বদলে যাচ্ছে এবং নতুন নতুন কৌশলগত পরিস্থিতির উদ্ভব হচ্ছে। এ অবস্থায় শান্তিরক্ষা কর্যক্রমে আরও শক্তিশালী ও চৌকস শান্তিরক্ষীর প্রয়োজন পড়বে। তাছাড়া বিশ্ব অংশীদারিত্ব ও আঞ্চলিক প্রভাবের কারণে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। এ অবস্থায় বাংলাদেশকে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নজর দিতে হবে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যাবে শান্তিরক্ষীদের গুণগতমান বৃদ্ধির মাধ্যমে এবং অন্যদেশের শান্তিরক্ষীদের বিপরীতে পেশাদারিত্ব, যোগ্যতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে। এজন্য জাতীয় নীতিমালায় বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে, যা এরই মধ্যে বিশেষজ্ঞ মহলে আলোচিত হচ্ছে। এ নীতিমালা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিমালায়ও প্রতিফলিত হতে হবে। ফলে যেসব দেশে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেসব দেশে আমাদের জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ করা যাবে। বিশ্ব শান্তিরক্ষার বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রয়োজন শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের ব্যাপক অধ্যয়ন ও গবেষণার জন্য বিশেষ শিক্ষা ও গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন। উল্লেখ্য, এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস সাপোর্ট অপারেশন্স ট্রেনিং উন্নতমানের বহুজাতিক প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিস মাঝে মাঝে শান্তিরক্ষা বিষয়ে সেমিনারের আয়োজন করে থাকে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, শ্রীলঙ্কা, সৌদি আরব, তুরস্ক, কুয়েত, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি দেশের সঙ্গে যৌথ অনুশীলন ও প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করে। এ ধরনের অনুশীলন ও প্রশিক্ষণ বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টি, দক্ষতা বৃদ্ধি ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গঠিত হয়েছে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। এ সময় সেনাবাহিনীর সদস্যরা এ দেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতা তথা আপামর জনসাধারণের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে। তাছাড়া শেষ দিকে ভারতের সঙ্গে যৌথ বাহিনীর অংশ হয়ে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। অধিকন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পার্বত্য অঞ্চলে বিশেষ জাতিগোষ্ঠীর বিদ্রোহ দমন ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করার ফলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রয়েছে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। এসব অভিজ্ঞতা বিশ্ব শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সাফল্যের অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করেছে। ২২ মে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ে অনুষ্ঠিত ‘সিম্পোজিয়াম অ্যান্ড এক্সপোজিশন অব ল্যান্ড ফোর্সেস অব দ্য প্যাসিফিক’-এ উপস্থাপিত ‘আন্তঃঅভিযানে স্থলবাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি : বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট’ নিবন্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ, বিএসপি, বিজিবিএম, পিবিজিএম, বিজিবিএমএস, পিএসসি, জি বলেন, ‘জাতি হিসেবে আমরা সমৃদ্ধ সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী। বহুজাতিক পরিবেশে আমাদের শান্তিরক্ষীরা তাই অন্য সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে। সংস্কৃতির বৈচিত্র্যের প্রতি উঁচুমাত্রার শ্রদ্ধা দেখিয়ে আমরা স্থানীয় জনগণ এবং মিশনে কর্মরত অন্য দেশের বাহিনীর মন জয় করার চেষ্টা করি।’ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান আরও বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বহুজাতিক অংশীদারদের সঙ্গে কাজের ক্ষেত্রে আন্তঃআভিযানিক সক্ষমতা বাড়াতে কৌশল ও পদ্ধতির নিয়মিত মূল্যায়ন করে এবং শান্তিরক্ষীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। তিনি তার লিখিত নিবন্ধে উল্লেখ করেন, বিদেশে অভিযান শেষে ফিরে এসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কন্টিনজেন্টগুলো আভিযানিক সমস্যা এবং অর্জিত জ্ঞান লিপিবদ্ধ করে। গবেষণা ও উন্নয়ন কর্মসূচির অংশ হিসেবে আমাদের বিদেশি অভিযানবিষয়ক পরিদপ্তর প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ও শান্তি অভিযানের দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ ও পরিবর্তন করে থাকে। এ চলমান প্রক্রিয়াটি শান্তিরক্ষা মিশনে সেনাবাহিনীর আন্তঃআভিযানিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। সেনাবাহিনী প্রধান বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আন্তঃআভিযানিক সক্ষমতার ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে; তাই এটিই হবে শান্তি অভিযানের সাফল্যের চাবি।
নূর ইসলাম হাবিব
সহকারী পরিচালক, আইএসপিআর
[email protected]