আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ৩১-০৫-২০১৯ তারিখে পত্রিকা

ডা. হাফেজ মাও. আবদুুল বারী

৩৭ বছর ধরে তারাবি পড়ান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক

মুজীব রাহমান
| ইসলাম ও সমাজ

ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস অব ইন্টার্নাল মেডিসিনের একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণে গিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার রাজধানী কেপটাউনে আটলান্টিক মহাসাগরের এক বন্দরে ডা. আবদুল বারী

‘সেই সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত হাসপাতালের ডিউটি ক্লাস, অফিস, চেম্বার এত ব্যস্ততার মাঝে তারাবি পড়ান কীভাবে?’
‘সারা বছর কোরআন তেলাওয়াতের যেভাবে হক আদায় করা উচিত সেভাবে তেলাওয়াত করতে পারি না। তাই শত ব্যস্ততার মাঝেও রমজানে খতমে কোরআনের তারাবি পড়াই, যাতে এ অসিলায় কোরআন তেলাওয়াতের কিছুটা হক আদায় হয়।’

গায়ে ঢিলেঢালা লম্বা জামা। মাথায় সফেদ টুপি। মুখে লম্বা দাড়ি। সদা হাস্যোজ্জ্বল। চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ সবসময়।
‘আচ্ছা, এ পোশাক পরেই আপনি মেডিকেল কলেজে ক্লাস নেন। চেম্বারে বসেন। মিটিং, কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করেন। এ জন্য কখনও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েননি?’
‘না। এ পোশাকের কারণে আমি কখনও বিব্রতকর অবস্থায় পড়িনি। এ পোশাক সম্মানের। এ পোশাক অনেক জায়গায় আমার সম্মানকে বৃদ্ধি করেছে। যারা হীনম্মন্যতায় ভোগে তারা এ পোশাকের কারণে বিব্রতকর পরিস্থিতি পড়ে।’
বলছিলাম একজন হাফেজ মাওলানা ডাক্তারের গল্প। তিনি আবদুুল বারী। ময়মনসিংহ ঈইগঈই-এর (কমিউনিটি বেজড মেডিকেল কলেজ বাংলাদেশ) অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর (ইন্টার্নাল মেডিসিন)।
শৈশবের দুরন্তপনা, দুষ্টুমি, ডাংগুলি, ক্রিকেট সবকিছুতেই ফাস্ট হতেন তিনি। মাদ্রাসায় যখন হেফজখানায় পড়তেন তখন তার স্কুলের বন্ধুরা তাকে মাদ্রাসায় পড়ে বলে নাক সিটকাত। সেই থেকে তার জেদ চেপে বসে। লেখাপড়ায়ও সে তাদের থেকে এগিয়ে যাবে। সেই থেকে তার শুরু স্বপ্নজয়ের পেছনে ছোটা। আর পেছনে ফিরে তাকাননি। হেফজি শেষ করে ভর্তি হলেন মিরপুর ৬ নাম্বারের দারুল উলুমে। এরপর পাঁচ বছর পড়ালেখা করেন ঢাকার ঐতিহ্যবাহী জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগে। এরপর চলে আসেন ময়মনসিংহে। ময়মনসিংহের জামিয়া ইসলামিয়া থেকে ভালো রেজাল্ট করে দাওরায়ে হাদিস উত্তীর্ণ হন ১৯৯১ সালে। ১৯৯০-এ এসএসসি। ১৯৯২-তে আনন্দমোহন কলেজ ময়মনসিংহ থেকে এইচএসসিতে স্টার মার্কস পেয়ে উত্তীর্ণ হন। এরপর ভর্তি হন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে। সেখান থেকে ২০০০ সালে গইইঝ এবং ঢাকা ভার্সিটি থেকে ২০১২ সালে গউ (ফড়পঃড়ৎ ড়ভ সবফরপরহব রহ রহঃবৎহধষ) করেন।
তিনি হাফেজ হন ১৯৮২ সালে। সেই সময় থেকে ৩৭ বছর ধরে তিনি খতমে তারাবির ইমাম। হাফেজ হওয়ার পর থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত আসাদ গেটের কাছাকাছি নিউ কলোনিতে তারাবির ইমামতি করতেন। ২০০০ সাল থেকে বাসাতেই বাবা-মা-পরিবারকে নিয়ে তারাবির ইমামতি করছেন। 
তারাবিকে কেন্দ্র করে বাসায় মাগরিবের পর থেকেই তৈরি হয় এক নুরানি পরিবেশ। তিনি কোরআন তেলাওয়াতে মগ্ন থাকেন। মার তর্জনী ঘুরতে থাকে তাসবির দানায়। শিশুরা জায়নামাজে বসে থাকেন তারাবির অপেক্ষায়। তারাবির পর পঠিত আয়াতগুলোর ওপর সংক্ষিপ্ত তাফসিরও পেশ করেন। আলোচনা করেন বিভিন্ন মাসআলা মাসায়েল নিয়েও।
তার বাবা ইন্তেকাল করেছেন। ৯৫ বছর বয়সি বৃদ্ধা মা এখনও হাফেজ, আলেম ছেলের পেছনে তারাবি আদায় করেন। আবদুল বারী পহেলা রমজানে তার মাকে নিয়ে একটি আবেগঘন স্ট্যাটাস দেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ। ৯৫ বছরের বৃদ্ধা আম্মাকে সঙ্গে নিয়ে ঘরোয়া খতম তারাবির নামাজ আদায় করতে পারার প্রশান্তি অন্য রকমের...’
সুম্মা আলহামদুলিল্লাহ। তার আম্মাও খুব গর্ববোধ করেন ছেলের পেছনে তারাবির নামাজ পড়তে পেরে। 
‘সেই সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত হাসপাতালের ডিউটি ক্লাস, অফিস, চেম্বার এত ব্যস্ততার মাঝে তারাবি পড়ান কীভাবে?’
‘সারা বছর কোরআন তেলাওয়াতের যেভাবে হক আদায় করা উচিত সেভাবে তেলাওয়াত করতে পারি না। তাই শত ব্যস্ততার মাঝেও রমজানে খতমে কোরআনের তারাবি পড়াই, যাতে এ অসিলায় কোরআন তেলাওয়াতের কিছুটা হক আদায় হয়। এতে কোরআনের হেফজটাও ঠিক থাকে।
এর দ্বারা বাসায় একটা কোরআনি পরিবেশও তৈরি হয়। এ সময়টাতে সত্যিকারের অর্থে আত্মিক একটা প্রশান্তি পাই, যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।’
তিনি ২০১৮ এর অক্টোবরে দক্ষিণ আফ্রিকায় ডওঈগ (ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস অব ইন্টার্নাল মেডিসিন) এর একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন, জোহানেসবার্গ, প্রিটোরিয়া, সানসিটিসহ ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্য, আমেরিকা ও সৌদি আরবে একাধিকবার সফর করেন। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে হজব্রতও পালন করেন একাধিকবার।
তিনি প্রতি বছর তার ঈইগঈই কলেজের ছাত্র-শিক্ষকদের নিয়ে সিরাত ও বৈচিত্র্যময় ইসলামি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। ছাত্রছাত্রীরা ব্যাপক উৎসাহের সঙ্গে এতে অংশগ্রহণ করেন।
আবদুুল বারী মেডিকেলের শিক্ষক হলেও শিকড় তার কওমিতে। তিনি মনে করেন, তার মতো শত শত মেধাবী ছাত্র আছে কওমিতে। দাওরার পর তাদের একটা অংশ যদি মেডিকেল সায়েন্স, ইঞ্জিনিয়ারিং, আইন ইত্যাদিতে পড়ালেখা করে, তাহলে তারা দেশ ও জাতির আরও ব্যপকভাবে কল্যাণ বয়ে আনতে সক্ষম হবে।
তিনি মনে করেন, বর্তমান মুসলিম প্রজন্মের বিশাল একটি অংশ পরিপূর্ণ কোরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী জীবনযাপন করছে না। জীবনে প্রকৃত সফল হতে হলে আমাদের কোরআন-সুন্নার কাছে ফিরে আসতে হবে।
আবদুুল বারী সারাদিনের কর্মব্যস্ততার মাঝেও ময়মনসিংহের স্বনামধন্য এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পার্টটাইম হাদিসের দরস দেন।
একজন ডাক্তার আলেমের কণ্ঠে তখন ‘কালা হাদ্দাসানা’র সুর জীবন্ত থেকে আরও জীবন্ত হয়ে ওঠে।
আবদুল বারীর ভ্রমণ খুব প্রিয়। অবসর পেলে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখিও করেন।