সিরাজগঞ্জের বেলকুচি, শাহজাদপুর ও উল্লাপাড়ায় গাভী পালন করে অনেকেই তাদের ভাগ্যবদল করেছেন। উপজেলার অধিকাংশ গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে গাভীর খামার বা গরুর দুগ্ধ খামার গড়ে উঠেছে। দুধ প্রক্রিয়াজাতকরণ কোম্পানিগুলো খামারিদের কাছ থেকে দুধ নেওয়া থেকে শুরু করে গাভীর চিকিৎসা ও পরিচর্যায় পরামর্শ দেওয়ার কাজ করছে। এতে দিন দিন খামার ও খামারির সংখ্যা বাড়ছে।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের একটি গ্রামের নাম জামিরতা। এ গ্রামে ঘুরে দেখা গেছে, দুগ্ধ খামারকে কেন্দ্র করে এখানে নানা ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকা- এগোচ্ছে। যেমন, কেউ দুধ পরিবহন করেন; কেউ আবার গোবর কিনে সার তৈরি করেন; কেউবা গোবর শুকিয়ে লাকড়ি তৈরি ও বিক্রি করেন; গাভীর জন্য ঘাস চাষও করেন অনেকে। এ গ্রামের মতোই আশপাশের অনেক গ্রামেই বাড়ি বাড়ি দুধের খামার গড়ে উঠেছে। রাজু আহমেদ জামিরতা গ্রামের একজন খামারি। পাবনার সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের স্নাতকোত্তরের এ ছাত্র পড়াশোনার পাশাপাশি গাভী পালন করেন। তিনি জানান, মা-বাবা ও এক ভাইকে নিয়ে আগে থেকেই গবাদিপশু পালন করলেও তিন বছর ধরে নিজের খামার গড়ে তুলেছেন তিনি। খামারে উন্নত জাতের সাতটি গরুর তিনটি থেকে প্রতিদিন ৪০ লিটার দুধ পান তিনি। দুধ বিক্রি করে যে টাকা পান, তা থেকে সাতটি গরুর খাবার কেনার পর কিছু অর্থ তিনি ব্যাংকে সঞ্চয় করতে পারছেন। আর বাছুরগুলো বড় হলে বছর শেষে সেগুলো বিক্রি করে ভালো অঙ্কের টাকা পাওয়া যাবে। এটাই বাড়তি লাভ বলে মনে করেন এ সফল খামারি। তিনি জানান, আগে যেটা বড় একটা সমস্যা ছিল, সেটা হলোÑ দুধ বিক্রি করা যেত না। গোয়ালারা দুধ নিলেও দাম কম পাওয়া যেত; আবার সময়মতো টাকাও পাওয়া যেত না। এখন প্রাণের দুধ সংগ্রহ কেন্দ্রে দুধ দিলে সপ্তাহয়ান্তে টাকা পাওয়া যায়। রাজুর খামারের পাশেই প্রাণ ডেইরির দুধ সংগ্রহ ও শীতলীকরণ কেন্দ্র। এখানে দুধে ফ্যাট ও ননীর পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে প্রতি লিটার দুধ ৪০ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি করতে পারেন বলে জানান তিনি।
তার মতোই এ গ্রামের অনেক বাড়িতে খামার গড়ে উঠেছে। প্রাণ ডেইরির কর্মকর্তারা জানান, ডিজিটাল মেশিনে আটটি পরীক্ষার মাধ্যমে মান যাচাই করে খামারিদের থেকে সরাসরি দুধ সংগ্রহ করে থাকে প্রাণ ডেইরি লিমিটেড। পরে আধুনিক ল্যাবে এ দুধ আবারও পরীক্ষা করার পর গুণাগুণ বজায় থাকলে তা দিয়ে তৈরি বিভিন্ন দুগ্ধজাত পণ্য বাজারজাত করা হয়। প্রতিদিন সকাল ও বিকালে দুধ বিক্রি করেন খামারিরা। এসব দুধ সংগ্রহ করে প্রাণসহ দুধ প্রক্রিয়াকরণ কোম্পানিগুলো। দেখা গেছে, গ্রামে গ্রামে দুধ সংগ্রহ কেন্দ্র গড়ে তুলেছে প্রাণ ডেইরি। সংগ্রহ কেন্দ্র থেকে দুধ নেওয়া হয় শাহজাদপুরে প্রাণের ডেইরি কমপ্লেক্সে। সেখানে কিছু দুধ প্রক্রিয়া করা হয়। বাকিটা চলে যায় নরসিংদীতে প্রাণের কারখানায়। সেখানে তৈরি হয় প্রাণের ইউএইচটি ও পাস্তুরিত তরল দুধ, গুঁড়া দুধ, ঘি, মাখন, পনির, লাচ্ছি, দই, মাঠা, লাবাং ও বিভিন্ন স্বাদযুক্ত বা ফ্লেভার্ড মিল্ক। প্রাণের ম্যানেজার (কমিউনিকেশন্স) তৌহিদুজ্জামান জানান, শাহজাদপুর ছাড়া পাবনার চাটমোহর, নাটোরের গুরুদাসপুর, সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ি এবং রংপুরে প্রাণের মোট পাঁচটি ডেইরি হাব বা কেন্দ্র রয়েছে। প্রায় ১২ হাজার চুক্তিভিত্তিক খামারি প্রাণের জন্য দুধ উৎপাদন করে। প্রাণ জানিয়েছে, ২০০১ সাল থেকে তারা হাব প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম শুরু করে। ২০২৫ সাল নাগাদ তারা দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে আরও পাঁচটি হাব প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করছে। প্রাণের ডেইরি সম্প্রসারণের প্রধান কর্মকর্তা ডা. রাকিবুর রহমান বলেন, ‘উন্নতজাতের গাভী পালন করতে পারলে খামারিরা লাভবান বেশি হন। খামারিদের গাভীগুলোকে এখন উন্নতজাতের কৃত্রিম প্রজননের ব্যবস্থা করা দরকার। কিন্তু আমরা উন্নতজাত আমদানির অনুমতি পাচ্ছি না।’ খামারিদের সহযোগিতার বিষয়ে তিনি বলেন, গরু কেনা ও বাসস্থান তৈরির জন্য সোনালী, কর্মসংস্থান ও আইএফআইসি ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদে খামারিদের ঋণের ব্যবস্থা করে থাকে প্রাণ ডেইরি। এ ক্ষেত্রে প্রাণ ডেইরি জামিনদার হয় এবং প্রতি সপ্তাহে খামারির জোগান দেওয়া দুধের মূল্য থেকে একটি অংশ কেটে নেওয়া হয়, যাতে কৃষকের ওপর বাড়তি চাপ না পড়ে।