আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ৩১-০৫-২০১৯ তারিখে পত্রিকা

হাওরে শস্য বিমা নিয়ে ধোঁয়াশা

মৌসুমী ইসলাম
| শেষ পাতা

প্রতি বছরই প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষি উৎপাদন, সর্বস্বান্ত হন কৃষক। বিশেষ করে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় বেশি ক্ষতির মুখে হাওর এলাকার কৃষি উৎপাদন। তখন বোরো ধানের ঘাটতি তৈরি হয়, টান পড়ে জাতীয় উৎপাদনে। এমন অবস্থায় হাওরের কৃষি উৎপাদন ও কৃষক সুরক্ষায় শস্য বিমা চালু করার উদ্যোগ নেয় সরকার। খসড়া কাঠামোও তৈরি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। কিন্তু অর্থমন্ত্রী মনে করেন, বিমা সুবিধায় উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হবেন কৃষক। তাই আগামী বাজেটে শস্য বিমায় বরাদ্দ অথবা চালু করা নিয়ে ধোঁয়াশায় রয়েছে অর্থ বিভাগ।

হাওরের কৃষককে সুরক্ষায় শস্য বিমা ধারণাপত্র তৈরি করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত সাধারণ বিমা করপোরেশন। কিন্তু অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এক প্রাক-বাজেট আলোচনায় বলেছেন, শস্য বিমা সুরক্ষা দেওয়া হলে উৎপাদনে আগ্রহ হারাতে পারেন কৃষক। তাই বিষয়টি চিন্তার প্রয়োজন রয়েছে। তিনি বলেন, পোলট্রি খাতের জন্য বিমা সুবিধা চালু করা যেতে পারে। অর্থমন্ত্রীর এমন ধারণার পর আগামী বাজেটে শস্য বিমার জন্য বরাদ্দ রাখা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। এ ধারণা কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, তা নিয়েও হচ্ছে জল্পনা-কল্পনা। এরই মধ্যে গেল ২৩ মে প্রস্তাবিত হাওর বিমা প্রকল্প বাস্তবায়নে সুপারিশ ও সম্ভাব্য পদক্ষেপ পর্যালোচনায় বৈঠক করে অর্থ বিভাগ। সেখানে সার্বিক দিক উঠে আসে।

প্রত্যক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল দেশের প্রায় ৪৮ শতাংশ মানুষ। প্রতি বছরই বর্ষা মৌসুমে বা স্বাভাবিক বন্যায় হাওর প্লাবিত হয়। বছরের কয়েক মাস পানিতে নিমজ্জিত থাকে হাওরাঞ্চল। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে হাওরের সংখ্যা ৩৭৩টি। এর মধ্যে সাতটি জেলা ও ৬২টি উপজেলায় ১ কোটি ৯৩ লাখ লোক বসবাস করে। ২০১৭ সালে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ৩৭৩টি হাওরের ছয়টি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওই বছরে ৩৪৮ কোটি টাকার উৎপাদিত ফসল নষ্ট হয়। আর ২০০৪, ২০১০, ২০১৩ ও ২০১৭ সালে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ২৮ হাজার ৩৭টি পরিবার। পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় হাওর এলাকার কৃষকের বিভিন্ন সমস্যা প্রকট। এর মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তা একটি বড় সমস্যা। আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা অতিমাত্রায় ঋণ নিয়ে শোধ করতে না পেরে দেউলিয়া হয়ে পড়েন। এলাকার জনগোষ্ঠী ক্ষুধা ও অপুষ্টিসহ নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগে এবং সামাজিক অস্থিরতাসহ নানা সমস্যা দেখা দেয়। এ লক্ষ্যে ‘পরীক্ষামূলক হাওর শস্য বিমা প্রকল্প’ চালুর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের উদ্যোগে সরকারের অর্থায়নে সাধারণ বিমা করপোরেশন ও বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলো এটা বাস্তবায়নের চিন্তা করছে। 

শস্য বিমা চালুর ক্ষেত্রে করণীয় : প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হাওরের কৃষককে বিভিন্ন উপায়ে ভর্তুকি, ত্রাণ, নগদ সহায়তা ও প্রণোদনা দেয় সরকার। কিন্তু কৃষক সাময়িক আর্থিক সহায়তা পেলেও দীর্ঘমেয়াদে সরকারের রাজস্ব খাতে প্রভাব পড়ে। হাওর পরিবেষ্টিত সাতটি জেলা যথাক্রমে সুনামগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া কৃষকের জীবনযাত্রা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। এলাকার ঝুঁকির ধরন ও আকস্মিক বন্যার সম্ভাব্য সময়কাল, স্থায়িত্ব এবং পানির উচ্চতা ইত্যাদি বিষয়ে যাচাই প্রয়োজন। এমতাবস্তায় হাওরে ‘পরীক্ষামূলক শস্য বিমা প্রকল্প’ চালু করার প্রাথমিক ধাপ হিসেবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ও সাধারণ বিমা করপোরেশনের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি টিম গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। গঠিত টিম এলাকা সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করে কৃষি মন্ত্রণালয়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ড, আবহাওয়া অধিদপ্তর, হাওর ও জলাশয় উন্নয়ন অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বাস্তবসম্মত কাঠামো প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে পারে।
হাওরে শস্য বিমায় চ্যালেঞ্জ : শস্য বিমা চালুর প্রধান অন্তরায় জনসচেতনতা। কৃষকের বিমা সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যা মোকাবিলায় শস্য বিমা চালু করতে হলে যে অবকাঠামোর প্রয়োজন, তার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। আগের থেকে শস্য বিমার প্রচলন না থাকায় পর্যাপ্ত জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে বিমার প্রোডাক্ট ডিজাইন ও বাস্তবায়ন বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের প্রচলিত বিমা আইন মূলত অগ্নি, নৌ, মোটর ও জীবন বিমা পরিচালনার জন্য। কিন্তু মাইক্রো ইন্স্যুরেন্স বা কৃষি বিমার জন্য সুনির্দিষ্ট আইন বা বিধি বিধানের অভাব রয়েছে। সব ধরনের বিমা ব্যবসা শহরভিত্তিক শিল্প ও ব্যবসাকেন্দ্রিক। বিমা প্রতিষ্ঠানের দক্ষ ও পর্যাপ্ত জনবলের অভাব থাকায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে শস্য বিমা চালু করা চ্যালেঞ্জিং। সামগ্রিকভাবে কৃষকের অবস্থা নাজুক হওয়ায় আর্থিক সচ্ছলতার অভাবে বিমার প্রিমিয়াম তাদের কাছে বাড়তি বোঝা মনে হতে পারে।
তদারকি কাঠামো দরকার : কৃষককে শস্য বিমা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে অবগত করতে হবে। হাওর এলাকায় শস্য বিমার প্রধান ঝুঁকি পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যা। বন্যা মাত্রা পরিমাপের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড, আবহাওয়া অধিদপ্তর, স্পারসোসহ বিভিন্ন সংস্থার সম্পৃক্তায় অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় আবহাওয়া যন্ত্র স্থাপন প্রয়োজন। বিমা পলিসি ডিজাইন ও ক্ষতি নিরূপণের জন্য বিশেষ সহায়তা দরকার। বিমা পণ্য ডিজাইনের জন্য বিভিন্ন ধরনের এগ্রোনমিস্ট, মেট্রোলজিস্ট নিয়োগের সুপারিশ এসেছে। রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক, বিমা প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে সময়োপযোগী রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক গঠনের প্রয়োজন। প্রকল্প এলাকায় বিমা প্রতিষ্ঠানের শাখা বা লিয়াজো অফিস স্থাপন ও লোকবল সরবরাহ ও দক্ষ লোকবল সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা উঠেছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিমা অফিস না থাকায় বিকল্প হিসেবে কৃষি ব্যাংক, এনজিও, এমএফআই ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের শাখা অফিসগুলো ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেল হিসেবে ব্যবহার করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
প্রকল্প বাস্তবায়নে ১০টি সুপারিশ : রাষ্ট্রীয় বিমা প্রতিষ্ঠান সাধারণ বিমা করপোরেশন ও বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে পরীক্ষামূলক হাওর শস্য বিমা চালুর সম্ভাব্যতা রয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের তত্ত্বাবধানে একটি নীতি-নির্ধারণী কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হয়। আর্থিক সহায়তা হিসেবে প্রিমিয়ামে ভর্তুকি দেওয়াসহ বিভিন্ন ব্যয় নির্বাহে বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সাতটি জেলা হাওরের আওতায় থাকায় বাধ্যতামূলকভাবে পুরো এলাকাকে অন্তর্ভুক্ত করে নির্দিষ্ট মেয়াদে পরীক্ষামূলক প্রকল্প চালু করা যেতে পারে। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে প্রকল্পটি পরিচালিত হলে সফলতার সম্ভাবনা অনেক বেশি বলে খসড়ায় বলা হয়েছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সব বিভাগ, অধিদপ্তর, ব্যাংক, এনজিও ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ডিস্ট্রিবিউশন পার্টনার হিসেবে কার্যক্রমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সরকার পাইলটভিত্তিতে বিভিন্নভাবে কৃষক সুরক্ষায় বা কৃষি উৎপাদন বজায় রাখার জন্য অনেক কর্মসূচি নিয়েছে। সেক্ষেত্রে হাওরাঞ্চলে শস্য বিমার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এটা বাস্তবায়িত হলে বিভিন্ন সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগে উৎপাদন ব্যহত হয়ে কৃষক যে সর্বস্বান্ত হয়, সেটা থেকে বের হয়ে আসতে পারবে। তবে শস্য বিমা পরিচালনার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে। যারা বিমা সুবিধা দেবে এবং কৃষক পর্যায়ে যারা বিমা সুবিধা নেবেনÑ এ দুই পর্যায়ে বাণিজ্যিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। কৃষক কতটা জমিতে ফসল উৎপাদন করছেন, কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেনÑ উৎপাদন ব্যয় সব বিষয় তদারকির মধ্যে আনতে হবে। অন্যদিকে যারা বিমা সুবিধা দেবেন, তাদের খেয়াল রাখতে হবে; উচ্চ মাত্রায় প্রিমিয়াম যেন নির্ধারণ করা না হয়। এটি হলে কৃষক উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেন। ফলে উদ্যোগটির সফলতা মিলবে না।