বিশ্ববরেণ্য দরবেশ পীর মাওলানা জুলফিকার আহমদ নকশবন্দি মুজাদ্দিদি (হাফিযাহুল্লাহ) কে নতুন করে পরিচয় করে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। দুনিয়াজুড়ে রয়েছে তার এক কোটি মুরিদ, শিষ্য ও শুভানুধ্যায়ী। লেখক হিসেবেও রয়েছে তার যশ ও খ্যাতি। অধ্যাত্মসাধনা, আত্মার ব্যাধি ও প্রতিকার, কুদৃষ্টি, চরিত্র সংশোধন, আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কবিষয়ক তার লিখিত গ্রন্থের সংখ্যা দুই শতাধিক। বর্তমান বিশ্বের আধ্যাত্মিক জগতে তিনি গ্রহণযোগ্য এক সারস্বত ব্যক্তিত্ব। আলেম-ওলামার কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। সিনিয়র মুহাদ্দিস মাওলানা সালমান বিজনূরিসহ ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের বহু ওস্তাদ তার খলিফা। এ কারণে তিনি ‘মাহবুবুল ওলামা ওয়াস সুলাহা’ অভিধায় পরিচিত হয়ে ওঠেন।
২০১৭ সালে হজরত নকশবন্দি লিখিত ‘সালামত রহে তুমহারি নিসবত’ গ্রন্থটি আমাকে হাদিয়া দেন তারই খলিফা মালয়েশিয়া নিবাসী শায়খ মাওলানা মুহাম্মদ। আমি তখন কুয়ালালামপুরে। তিনি কষ্ট করে আমার হোটেলে আসেন এবং নকশন্দি-মুজাদ্দিদি তরিকা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। তার দেওয়া এ গ্রন্থটি অধ্যয়ন করে আমি অত্যন্ত প্রভাবিত হই। এরই মধ্যে হজরতের লিখিত আরও কিছু গ্রন্থ অধ্যয়নের সুযোগ লাভ করি।
ইসলামে নারীর মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে শায়খ নকশবন্দি লিখিত ‘খাওয়াতিনে ইসলামকে কারনামে’ গ্রন্থটি অধ্যয়ন করি। এতে এমন দুর্লভ তথ্য-উপাত্ত পাই, যা এ বিষয়ের অন্যান্য গ্রন্থে পাওয়া যায়নি। তখন থেকেই শায়খ নকশবন্দিকে দেখার ও সান্নিধ্যসৌরভ নেওয়ার তাগাদা অনুভব করি হৃদয় থেকে। অতঃপর ২০১৮-১৯ সালে শায়খ মাওলানা মুহাম্মদের দাওয়াতে মালয়েশিয়ায় হুলুলাংগাতে অনুষ্ঠিত ইসলামি ইজতেমায় শরিক হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করি। হজরত নকশবন্দির শান্ত, সৌম্য ও জ্যোতির্ময় অবয়ব দেখে বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হই। হজরতের হাতে হাত রেখে বায়াত গ্রহণ করি এবং তিনি আমার বক্ষদেশে হৃৎপিণ্ডের ওপর হাত রেখে তিনবার আল্লাহু আল্লাহু বলে ডাক দেন। আমি এখনও জ্যোতির্ময় এ সাধক পুরুষের পবিত্র হাতের শীতল স্পর্শ অনুভব করি।
মালয়েশিয়ায় ইসলামি ইজতেমার তিন দিনের কর্মসূচি ছিল অত্যন্ত পরিকল্পিত এবং সাজানো-গোছানো। রুটিন মাফিক অজু-গোসল নামাজ-জিকির, ওয়াজ-নসিহত, নাশতা-খাবার পরিচালিত ও পরিবেশিত হয়। মাগরিবের পর শায়েখের বয়ান। প্রতিটি বাক্য হীরকখণ্ডের মতো মূল্যবান। প্রতিটি কথা কোরআন, হাদিস ও ইতিহাসনির্ভর। মাঝেমধ্যে বিখ্যাত ফার্সি ও উর্র্দু কবিদের কবিতা পঙ্ক্তি আবৃত্তি করার কারণে মাহফিলের রওনক ও সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি পায়।
তার ওয়াজ-নসহিতের প্রকাশভঙ্গি বাগাড়ম্বরমুক্ত এবং সাদামাটা। উন্নত অথচ সহজ ও বোধগম্য ভাষায় উপস্থাপনার কারণে যে কোনো মানুষ বক্তব্য হৃদয়ঙ্গম করতে পারে। কথার জাদুকরী প্রভাব শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধের মতো সম্মোহিত করে রাখে। তার বক্তব্যে অন্তর বিগলিত হয় এবং অশ্রু ঝরে পড়ে বাধাহীনভাবে। নসিহত শেষে মুরাকাবা অনুষ্ঠান। আল্লাহর ধ্যানে তন্ময়তার এ দৃশ্য না দেখলে বোঝানো যাবে না। নকশবন্দি-মুজাদ্দিদি তরিকায় অন্যতম বৈশিষ্ট্য ‘মুরাকাবা’। শ্বেতশ্মশ্রু ও শুভ্র উষ্ণীষধারী এ বুজুর্গের প্রতিটি মুহূর্ত কাটে ইবাদত ও জিকির-আজকারে। সেমিনার অথবা ওয়াজ-নসিহত শুরু করার আগে তিনি হোমওয়ার্ক করেন এবং নোট দেখে বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এতে কথার ধারাবাহিকতা রক্ষা হয় এবং পরবর্তী সময়ে ওই নোট অবলম্বনে নির্ধারিত বিষয়ে গ্রন্থ রচনা সহজতর হয়।
সবুজ বীথিকা ও পাহাড়ঘেরা হুলুলাংগাতের ইসলামি ইজতেমায় দুবেলা খাবার ও দুবেলা নাশতা তৈরি এবং পরিবেশনায় স্বেচ্ছাসেবকদের এখলাস ও আন্তরিকতার ছোঁয়া স্পষ্ট। মালয়েশিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ভারতের বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে মেহমানদের আতিথ্য প্রদর্শন করেন। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, কোরিয়া, চীন, ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে কয়েক হাজার সালেক এ ইজতেমায় শরিক হন প্রতি বছর। তিন দিনের এ ইজতেমা বলতে গেলে আত্মসংশোধনে ব্রতীদের মিলন মেলায় পরিণত হয়।
মাওলানা পীর জুলফিকার নকশবন্দি ১৯৫৩ সালে পশ্চিম পাঞ্জাবের জং জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। কোরআন হিফজ সম্পন্ন করেন ১৯৬২ সালে। ১৯৬২ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ওস্তাদের কাছে ফার্সি, আরবি, নাহু, সারাফ, ফিকহ, উসুলে ফিকহ, তরজমা, তাফসির, উলুমুল কোরআন, হাদিস, উসুলে হাদিস, সিহাহ সিত্তা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ কিতাব অধ্যয়ন করেন। হাফিজুল হাদিস মাওলানা মুহাম্মদ জাফরের কাছ থেকে তিনি হাদিসের ইজাজতপ্রাপ্ত হন। জাহানিয়ামণ্ডির জামিয়া রহমানিয়া ও মুলতানের জামিয়া কাছেমুল উলুম তাকে দাওরায়ে হাদিসের সনদ প্রদান করেন। আরব বিশ্বের অনেক মুহাদ্দিসের কাছ থেকে তিনি হাদিসের ইজাজতপ্রাপ্ত হন।
পাঞ্জাবের জং জেলায় অবস্থিত দারুল উলুম, জামিয়া আয়েশা (মহিলা মাদ্রাসা) ও মাআহাদ আল ফকির আল ইসলামির মুহতামিম হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ফয়সালাবাদ, লাহোর, রাওয়ালপিন্ডি, ইসলামাবাদ, মালয়েশিয়া, লুসাকা ও জাম্বিয়ায় প্রতিষ্ঠিত দরসে নিজামি শিক্ষাধারার বহু মাদ্রাসা প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে তার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়।
মাওলানা পীর জুলফিকার নকশবন্দি ১৯৬৭ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক, ১৯৭৬ সালে প্রথম বিভাগে বিএসসি (ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং) ডিগ্রি লাভ করেন। এছাড়া তিনি কম্পিউটার ম্যানেজমেন্ট, হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট, লাইব্রেরি সায়েন্সে স্পেশাল কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৭৬ সালে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন এবং ১৯৭৭ সালে পাকিস্তান সোসাইটি ফর সুগার টেকনোলজিতে মেম্বার নির্বাচিত হন। ১৯৮২ সালে চিফ ইলেকট্র্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার পদে উন্নীত হন।
১৯৭১ সালে নকশবন্দিয়া-মুজাদ্দিদিয়া তরিকায় সবক ও বায়াত নেন। ১৯৮২ সালে প্রখ্যাত সাধক হজরত খাজা গোলাম হাবিব (রহ.) থেকে ইজাজত ও খেলাফত লাভ করেন। মাওলানা পীর জুলফিকার নকশবন্দি দাওয়াত ও তাবলিগের মহান দায়িত্ব পালনে পৃথিবীর ৭০টি দেশ সফর করেন। এর মধ্যে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কাতার, বাহরাইন, ওমান, সিরিয়া, মিশর, তুরস্ক, নেপাল ভারত, বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, মিয়ানমার, হংকং, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, আফগানিস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, দাগিস্তান, ডেনমার্ক, হাঙ্গেরি, জার্মান, নরওয়ে, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি, ফিনল্যান্ড, ফিজি, আফ্রিকা, জাম্বিয়া, রুশ ফেডারেশনের ৯টি স্টেট এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২২টি স্টেট অন্যতম। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তার ৩০০ জন খলিফা নকশবন্দি-মুজাদ্দিদি তরিকায় ইসলাহি খিদমত আঞ্জাম দিচ্ছেন।
তার লিখিত দুই শতাধিক উর্দু গ্রন্থ ইংরেজি, পশতু, হিন্দি, তামিল, তেলেগু, নেপালি, সিংহলি, বার্মিজ, রাশিয়ান, তুর্কিসহ পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বাংলায় ভাষান্তরিত হয়েছে তার সর্বাধিক গ্রন্থ প্রায় ১০০টি। বাংলাদেশে শায়েখের রয়েছে ১০ জন খলিফা।