আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ১৭-০১-২০২০ তারিখে পত্রিকা

সিরাতের গল্প

স্ত্রীদের সঙ্গে নবীজির অভিমান

| ইসলাম ও সমাজ

আর দশজন সহজ স্বাভাবিক দম্পতির মতোই আল্লাহর রাসুল (সা.) এর জীবনেও ছিল আনন্দ-বেদনার গল্প, ছিল বাদানুবাদ আর মান-অভিমানের উত্থান-পতন। একবার এমন হয়েছিল, স্ত্রীদের সঙ্গে অভিমান করে আল্লাহর রাসুল (সা.) দীর্ঘ এক মাস বাড়ির বাইরে কাটান। পুরো সময়ে তিনি তাঁর কোনো স্ত্রীর কাছেই যাননি। ঘটনাটা নবম হিজরির।
একদিন আবু বকর (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখলেন আরও অনেকেই রাসুলের ঘরের দরজায় অপেক্ষমাণ। কাউকেই ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। আবু বকর (রা.) ভেতরে প্রবেশের অনুমতি চাইলে তাকে অনুমতি দেওয়া হলো। এরপর ওমর (রা.) এলেন, তাকেও অনুমতি দেওয়া হলো। আল্লাহর রাসুল (সা.) নিচে বসে আছেন আর চারপাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর স্ত্রীরা। সবার মধ্যে বিষাদের ছাপ। পুরো পরিবেশ থমথমে হয়ে আছে। গুমোট ভাবটাকে হালকা করার জন্য ওমর (রা.) মজা করে বললেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমার টাকা-পয়সা নেই জেনেও যদি আমার বউ তার পেছনে খরচ করার জন্য আমাকে পীড়াপীড়ি করত, তাহলে আমি তার ঘাড় ভেঙে দিতাম!’ ওমরের কথা শুনে রাসুলুল্লাহ (সা.) হেসে দিলেন, বললেন, ‘এখানেও তা-ই হয়েছে! আমার চারপাশে যাদের দেখতে পাচ্ছ তারাও আমার কাছে ধন-সম্পদ চাইতে শুরু করেছে!’
এ কথা শুনেই আবু বকর (রা.) নিজ কন্যা আয়েশা (রা.) এর দিকে এগিয়ে গেলেন আর ওমর (রা.) এগিয়ে গেলেন নিজ কন্যা হাফসা (রা.) এর দিকে। দুজনই আল্লাহর রাসুলের দুই স্ত্রীর বাবা! ওমর (রা.) বললেন, ‘তোমরা নবীজির কাছে এমন কিছু দাবি করছ, যা তাঁর কাছে নেই!’ তারা উত্তর দিলেন, ‘আমরা কখনও এমন কিছু দাবি করব না যা আল্লাহর রাসুলের কাছে নেই।’ এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাসুল (সা.) স্ত্রীদের থেকে এক মাস আলাদা ছিলেন। আর সে সময় আল্লাহ তায়ালা কোরআনের এ আয়াত নাজিল করেন। ‘হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীদের বলে দিন, তোমরা যদি পার্থিব জীবনের ভোগ ও এর বিলাসিতা কামনা কর, তাহলে এসো, আমি তোমাদের ভোগ-বিলাসের ব্যবস্থা করে দিই এবং সৌজন্যের সঙ্গে তোমাদের বিদায় করি। আর যদি তোমরা আল্লাহ, তাঁর রাসুল ও পরকালকে কামনা কর তাহলে তোমাদের মধ্যে যারা সৎকর্মশীল, আল্লাহ তাদের জন্য মহাপ্রতিদান প্রস্তুত করে রেখেছেন।’ (সূরা আহজাব : ২৮-২৯)।
আল্লাহর রাসুল (সা.) এর লাইফস্টাইল আর দশজনের মতো সহজ আর স্বাচ্ছন্দ্যময় ছিল না, আরাম কী জিনিস তিনি জানতেন না। তিনি ছিলেন আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় বান্দা। নেতৃত্ব, খ্যাতি, ধন-সম্পদ তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছে। কিন্তু সে ডাককে তিনি কোনো পাত্তাই দেননি, এমনভাবে জীবন কাটিয়েছেন যেন দুনিয়ার চেয়ে সস্তা আর অর্থহীন বস্তু আর দ্বিতীয়টি নেই। মদিনায় আসার পর মসজিদে নববির পাশে আল্লাহর রাসুল (সা.) আর উম্মুল মুমেনিনদের জন্য ঘর তৈরি করা হয়। সে ঘর ছিল নিতান্তই সাধারণ। রাজা-বাদশাহদের প্রাসাদের মতো প্রকাণ্ড কিছু তো ছিলই না, বরং কাদামাটি আর পাথর দিয়ে তৈরি ছোট কয়েকটা মাথা গোঁজার ঠাঁই। সেগুলোকে বড়জোর কুঁড়েঘর বলা চলে। আরবের মরুভূমিতে সবচেয়ে সহজলভ্য খেজুরের ডাল ছিল সে ঘরের চালা। ঘরের ছাদগুলো এত নিচু ছিল যে ছোটখাটো লোকও নিমিষে হাত দিয়ে ছুঁতে পারত। ইমাম হাসান আল বসরি বলেন, ‘আমি আল্লাহর রাসুল (সা.) এর ঘর দেখেছি। হাত বাড়ালেই এর ছাদ ধরা যায়।’ 
আল্লাহর রাসুলের সেই ঘরে আলো জ্বালানোর মতো কুপিও ছিল না। মা আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সালাতের স্থানের সামনে ঘুমাতাম। রাতে যখন তিনি তাহাজ্জুদে দাঁড়াতেন, ঘরে আলো না থাকায় সিজদার সময় তাঁর কপাল আমার মাথায় এসে লাগত। সিজদায় যাওয়ার সময় আল্লাহর রাসুল (সা.) আমার পায়ে খোঁচা দিতেন। তখন আমি পা ভাঁজ করে নিতাম, যখন তিনি সিজদা থেকে উঠতেন আমি আবারও পা বিছিয়ে দিতাম।’
ঘরে কার্পেট বলে কিছু ছিল না। মেঝে বলতে ছিল বালু আর খেজুরের ছোবলা। আল্লাহর রাসুল সেখানেই ঘুমোতেন। তাঁর গায়ে এবড়োখেবড়ো ছোবলার দাগ পড়ে যেত। রকমারি আসবাবও ছিল না। মাথার নিচে দেওয়ার মতো একটা চামড়ার গদি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ত না ঘরে। তাঁর জীবন দেখলে মনে হতো প্রাচুর্য বলে এই পৃথিবীতে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। এই দৃশ্য দেখে একদিন ওমর (রা.) নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না, কেঁদেই ফেললেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আল্লাহর কাছে দোয়া করুন যেন তিনি এই উম্মতকে প্রাচুর্য দান করেন। পারস্য আর রোমের সম্রাটদের দেখুন, তারা তো আল্লাহর ইবাদত করে না, অথচ তারাই আজ ভোগবিলাসে আছে।’ তিনি বললেন, ‘ওমর! এটাই কি উত্তম নয় যে, তারা দুনিয়ার ভোগবিলাস পেল আর আমরা আখেরাতের অনন্ত জীবন পেলাম!’
আমরা জীবনের প্রাচুর্য দেখে দেখে আক্ষেপ করি কেন অন্য অনেকের সমান কিংবা তার চেয়েও বেশি পরিমাণ নেয়ামত আমার হলো না; কিন্তু আল্লাহর রাসুল (সা.)কে যেন এসব কিছু স্পর্শই করত না। দুনিয়ার ভোগবিলাস, আরাম-আয়েশ আর প্রাচুর্য ছিল তার কাছে একটা মশা কিংবা মাছির চেয়েও তুচ্ছ, কাছে এলেই হাত দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়ার মতোই তিনি বরাবর একে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছেন।
দারিদ্র্য ছিল আল্লাহর রাসুলের নিত্যসঙ্গী। মা আয়েশা (রা.) বলেন, ‘এমনও হয়েছে পরপর তিন চান্দ্রমাস অতিবাহিত হয়েছে; কিন্তু আল্লাহর রাসুলের ঘরে চুলায় আগুন জ্বলেনি।’ এ কথা শুনে তার ভাগ্নে উরওয়া ইবনে যুবাইর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাহলে সে সময় আপনারা কী খেতেন?’ আয়েশা (রা.) জবাব দিলেন, ‘আমরা শুধু পানি আর খেজুর খেয়ে থাকতাম!’ আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন, ‘মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আল্লাহর রাসুলকে কোনোদিন ভুনা গোশত দিয়ে পেটভরে এক টুকরো রুটি খেতে দেখিনি।’
এমন নয় যে, উম্মুল মুমেনিনরা আল্লাহর রাসুলের এ কঠোর আর অনাড়ম্বর জীবনের সঙ্গে অভ্যস্ত ছিলেন না। কিন্তু হিজরি নবম বর্ষে এসে আল্লাহ উম্মাহকে খায়বার, মক্কা বিজয়ের মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিজয় দান করেন। কোরআনের কিছু আয়াতও নাজিল হয়, যা সীমার মধ্যে থেকে দুনিয়ার নিয়ামত ভোগ করার অনুমতি প্রদান করে। আল্লাহ বলেন, ‘আপনি বলুন, আল্লাহর সাজ-সজ্জাকে, যা তিনি বান্দাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন এবং পবিত্র খাদ্যবস্তুগুলোকে হারাম করেছেন? আপনি বলুন, এসব নেয়ামত আসলে পার্থিব জীবনে মোমিনদের জন্য এবং কেয়ামতের দিন খাঁটিভাবে তাদেরই জন্য। এমনিভাবে আমি আয়াতগুলো বিস্তারিত বর্ণনা করি তাদের জন্য যারা বোঝে।’ (সূরা আরাফ : ৩২)।
আয়াতগুলো নাজিল হওয়ার পর উম্মুল মুমেনিনরা মনে করলেন, আল্লাহর নির্ধারিত সীমার মধ্যে থেকে আল্লাহ দুনিয়ায় মোমিনদের জন্য যা হালাল করেছেন, সে নিয়ামত ভোগ করায় দোষের কিছু নেই। আদতে এই আয়াতগুলো ছিল মূলত সাধারণ মানুষের জন্য। আল্লাহ তায়ালা চেয়েছেন তাঁর রাসুল (সা.) দুনিয়ার উপকরণ থেকে নিজেকে বিরত রাখবেন, বাকিদের মতো তিনি দুনিয়া উপভোগ করবেন না। ‘আমি (কাফেরদের) কিছু লোককে ভোগ-বিলাসের যে উপকরণ দিয়েছি, তার প্রতি আপনি চোখ তুলে তাকাবেন না। তাদের ব্যাপারে চিন্তিত হবেন না, বরং মোমিনদের প্রতিই ঝুঁকে থাকবেন।’ (সূরা হিজর : ৮৮)।
অনন্ত আখেরাত জীবনের উল্টো পিঠে অতি তুচ্ছ এই নশ্বর পৃথিবীর মায়ায় জড়িয়ে যাওয়া আল্লাহর রাসুলের জন্য কোনোভাবেই শোভনীয় নয়। সূরা আহযাবের উপরোল্লিখিত আয়াত নাজিল হওয়ার পর আল্লাহর রাসুল স্ত্রীদের দুটি রাস্তা খুলে দিলেনÑ হয় তারা দুনিয়ার ভোগবিলাস উপভোগ করবেন অথবা তারা আল্লাহর রাসুলের জীবনসঙ্গী হিসেবে থাকবেন। তারা যদি আল্লাহর রাসুলের সঙ্গে সংসার করেন, তবে বিনিময়ে কষ্ট হলেও লাভ করবেন সবচেয়ে মহান প্রাপ্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি আর আল্লাহর পক্ষ থেকে এক অসামান্য পুরস্কার। যে নারীরা এতদিন ভরণ-পোষণ বাড়ানোর জন্য চাপাচাপি করতে করতে নবীজিকে প্রায় বিরক্ত করে তুলেছিলেন, এই আয়াত শোনার পর, সেই তারাই প্রত্যেকে একবাক্যে বললেন, ‘আমরা আল্লাহ, আল্লাহর রাসুল (সা.) এবং আখেরাতের আবাসকেই বেছে নিলাম।’ আল্লাহ তাদের প্রত্যেকের ওপর সন্তুষ্ট হন।

মিুসা জিবরিল