আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ১৭-০১-২০২০ তারিখে পত্রিকা

সগিরা মোর্শেদ হত্যাকাণ্ড চার আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট

নিজস্ব প্রতিবেদক
| শেষ পাতা

৩০ বছর আগে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সামনে সগিরা মোর্শেদ সালাম হত্যার ঘটনায় তদন্ত শেষে বৃহস্পতিবার আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। 

পারিবারিক তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। হত্যার পরিকল্পনা করা হয় রাজধানীর রাজারবাগের একটি বাসায় ও ইস্কাটন রোডের যমুনা ফার্মেসিতে। এরই মধ্যে এ ঘটনায় নিহতের ভাসুর, জাসহ চার আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন; যা ঘটনার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনার সঙ্গে মিলে গেছে বলে জানিয়েছেন পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার।

চার্জশিট দাখিলের আগে বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডিতে পিবিআই সদরদপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, ওই হত্যাকাণ্ডে জড়িত চারজনকে আগেই গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের আসামি করে আদালতে ‘চার্জশিট’ দেওয়া হচ্ছে। তারা হলেন সগিরার ভাসুর ডা. 
হাসান আলী চৌধুরী, তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহিন, শাহিনের ভাই আনাছ মাহমুদ ওরফে রেজওয়ান ও কিলার মারুফ রেজা। তারা সবাই হত্যাকাণ্ডে নিজেদের সম্পৃক্ততার বিষয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
তিনি বলেন, আলোচিত এ হত্যা মামলাটি ডিএমপির ২৫ কর্মকর্তা তদন্ত করেছেন। একজন কর্মকর্তা গড়ে সন্দেহজনক হিসেবে ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। মো. জলিল মিন্টু ওরফে মিন্টু নামে একজনকে আসামি করে চার্জশিটও দেওয়া হয়েছিল। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে গেল বছরের ১৭ জুলাই মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই। তদন্তের শুরুতে আদালতে দীর্ঘদিন মামলাটি স্থগিত বা স্টে অর্ডার দাখিলকারী হিসেবে মারুফ রেজার নাম দেখে সন্দেহ শুরু হয়। কারণ ভিকটিম বা বাদীর নিকটাত্মীয় না হয়েও সে কেন স্টে অর্ডার করতে গেল। এ সন্দেহের জেরে মারুফ রেজাকে আটক করলে বেরিয়ে আসে আসল খুনিরা। 
বনজ কুমার বলেন, বড় জায়ের ঈর্ষার কারণে খুন হয়েছিলেন সগিরা মোর্শেদ। পিবিআই তদন্ত করে হত্যার পেছনে আটটি কারণ খুঁজে পেয়েছে। তা হলো সগিরা মোর্শেদের পরিবারের সঙ্গে আসামিদের পরিবারের সাংসারিক বিভিন্ন দ্বন্দ্ব, আসামিরা তৃতীয়তলা থেকে বিভিন্ন ময়লা-আবর্জনা নিচে ফেললে সগিরার রান্নাঘর ও বারান্দায় পড়া নিয়ে দ্বন্দ্ব, সগিরা মোর্শেদকে শাশুড়ির বেশি পছন্দ করা, আসামি শাহিনের চেয়ে সগিরার শিক্ষাগত যোগ্যতা বেশি থাকা, আসামিদের ফ্ল্যাট থেকে সগিরা মোর্শেদের ফ্ল্যাট সুন্দর ও গোছানো হওয়া, তিনতলা ভবনের ছাদ ব্যবহার করা নিয়ে দ্বন্দ্ব, আসামি শাহিনকে ‘তুমি’ বলা নিয়ে মনোমালিন্য ও সগিরা মোর্শেদের কাজের মেয়ে জাহানুরকে মারধর নিয়ে দ্বন্দ্ব।
পুলিশের এ কর্মকর্তা বলেন, এসব থেকে সগিরা মোর্শেদকে খুন করতে ওই সময় ২৫ হাজার টাকা দিয়ে আসামি মারুফ রেজাকে ভাড়া করে নিহতের ভাসুর ডা. হাসান আলী চৌধুরী। মারুফ রেজা হাসান আলীর রোগী ছিল। আসামিদের জবানবন্দি অনুযায়ী, ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই বিকালে স্কুল থেকে মেয়েকে আনতে রিকশায় করে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সামনে যাওয়া সগিরা মোর্শেদের পথ আটকায় মোটরসাইকেল আরোহী মারুফ ও রেজওয়ান। হাতব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার পর হাতের বালা নিতে উদ্যত হলে রেজওয়ানকে চিনে ফেলার কথা বলেন সগিরা। তারপরই তার বুকে গুলি চালিয়ে দেয় মারুফ রেজা। সগিরা মোর্শেদ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ছিলেন। 
এখন আবাসন ব্যবসায়ী ও বেইলি রোডের বাসিন্দা মারুফ রেজা এরশাদ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসানের ভাগ্নে। ওই সময়ই সে গ্রেপ্তার হলেও তার নাম বাদ দিয়ে মন্টু নামে একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছিল পুলিশ। এরপর বিচার শুরু হলেও সাক্ষ্যে মারুফ রেজার প্রসঙ্গ উঠে আসায় অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন বিচারিক আদালত; কিন্তু উচ্চ আদালতে গিয়ে মামলা আটকে যায়। মারুফের আবেদনে ১৯৯১ সালের ২ জুলাই হাইকোর্ট মামলাটির অধিকতর তদন্তের আদেশ ও বিচারকাজ ছয় মাসের জন্য স্থগিত করার পাশাপাশি অধিকতর তদন্তের আদেশ কেন বাতিল করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। পরের বছর ২৭ আগস্ট জারি করা ওই রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ওই মামলার বিচারকাজ স্থগিত থাকবে বলে আরেকটি আদেশ দেন হাইকোর্ট।
২৮ বছর আগের মারুফের ওই আবেদন গত বছর জুনে খারিজ করে দিয়ে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের বেঞ্চ পিবিআইকে তদন্তের দায়িত্ব দেন।
তদন্তের দায়িত্ব পেয়ে প্রথমে মামলার বাদী সগিরা মোর্শেদের স্বামী আবদুস সালাম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করে পিবিআই। অনেক চেষ্টার পর বের করা হয় সগিরাকে বহনকারী সেদিনের যুবক রিকশাচালককে। তার মাধ্যমে হত্যাকারীদের একজন ডা. হাসানের শ্যালক আনাছ মাহমুদ রেজওয়ানকে শনাক্তের পর গত বছরের ১০ নভেম্বর রামপুরা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে বাকি তিনজনকেও গ্রেপ্তার করা হয়। 
বনজ কুমার বলেন, পিবিআই গত বছরের ১৭ জুলাই মামলাটি তদন্ত শুরু করে। মামলার কিছু সবল দিকের পাশাপাশি কিছু দুর্বল দিকও রয়েছে। ১ হাজার ৩০৯ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন বৃহস্পতিবার আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। মামলার দুর্বল দিক বলতে গিয়ে তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল, রিভলবার, যে রিকশায় সগিরা মোর্শেদ যাচ্ছিলেন সে রিকশা এবং সগিরা মোর্শেদের পরিহিত শাড়ি, গহনা ও ব্যাগ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। শাড়ি ও গহনা আদালতের লকেটে ছিল; কিন্তু সেখানেও সেগুলো পাওয়া যায়নি। মামলাটি নষ্ট করতে প্রতারণামূলক কাজ করা হয়েছে। আমরা তদন্তকারী সংস্থা হিসেবে চারজনেরই ফাঁসি চাইব। সগিরা মোর্শেদের স্বামী আবদুস সালাম চৌধুরী ও সগিরা মোর্শেদের ছোট ভাই গাউসুল নেওয়াজ সাব্বির সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। তদন্তের অগ্রগতিতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে তারা বলেন, পিবিআই তদন্ত করে যাদেরকে আসামি হিসেবে শনাক্ত করেছে; আমাদের সন্দেহের তালিকায়ও তারা ছিল।