এ মুহূর্তে আতঙ্কের নাম করোনা ভাইরাস, যা নিয়ে শঙ্কায় আছে বিশ্ববাসী, কেননা করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি চীনে হলেও সম্প্রতি এটি ভারতীয় উপমহাদেশ ও ইউরোপসহ অন্যান দেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। সর্বশেষ ১৬টি দেশে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত লোকের দেখা মিলেছে। এরই মধ্যে চীন থেকে জাপান, যুক্তরাজ্য, ইউরোপসহ সারা দেশের নাগরিকদের বিশেষ সতর্কতায় ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। আর চীনগামী বিমান বা ফ্লাইট অনেক দেশ বন্ধ করে দিয়েছে। সর্বশেষ মরণঘাতী এই ভাইরাসে চীনে এখন পর্যন্ত ১৩২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে আর আক্রান্তের হার ২ হাজারের বেশি সংখ্যায় ছাড়িয়ে গেছে। আতঙ্কের বিষয় হলো, এই ভাইরাসের এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। ফলে বিশ্বজুড়ে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে এটি আরও আতঙ্কের। কেননা রাজধানী ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে গণবসতিপূর্ণ রাজধানীর একটা। আর চীন বাংলাদেশের সন্নিকটে চীনের সঙ্গে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বহুবিদ আদান-প্রদান রয়েছে। এছাড়া আমাদের সবচেয়ে বড় উন্নয়নের স্তম্ভ পদ্মা সেতুতে চীনা নাগরিকরা কাজ করেন এবং কাজে তাদের শিপটিংও রয়েছে। অবশ্য পদ্মা সেতুতে কাজ করা চীনা নাগরিকদের বিশেষ সতর্কতায় রাখা হয়েছে। শুধু চীনা নাগরিক নয়, করোনা ভাইরাস নিয়ে সরকারি ও বেসরকারিভাবে আমাদের সবারই সতর্ক থাকতে হবে। গত বছর সংক্রমণজনিত মশাবাহিত রোগ বা ডেঙ্গুজ্বর আমাদের দেশে মহামারি রূপ ধারণ করেছিল। ভুলে গেলে হবে না, ডেঙ্গু এখনও শেষ হয়ে যায়নি। শীত তো শেষ হয়ে যাচ্ছে। গরমের শুরুতেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে। তাই এখন থেকে বাড়তি সতর্কতা জরুরি।
শুধু ডেঙ্গু নয়, ভাইরাস-জনিত সব অসুখ সম্পর্কে আমাদের ধারণা থাকতে হবে। আমরা নিপাহ ভাইরাসের কথা শুনি, ইবোলা ভাইরাসের কথা শুনি আবার শোয়াইন ফ্লু’র কথা শুনি। কিন্তু এসব সম্পর্কে শোনা নয়, জানতে হবে। ভাইরাসজনিত রোগ (ঠরৎধষ ফরংবধংবং) বা ভাইরাস রোগ মানুষের প্রায় এক ডজন গুরুত্বপূর্ণ রোগের জন্য দায়ী। সচরাচর সংক্রমিত এসব রোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ডেঙ্গুজ্বর, ইয়েলো ফিভার (ুবষষড়ি ভবাবৎ), পোলিওমাইলিটিস (ঢ়ড়ষরড়সুবষরঃরং), জন্ডিস (যবঢ়ধঃরঃরং), রেবিস, ইনফ্লুয়েঞ্জা, মাম্পস, হাম (সবধংষবং), বসন্ত, হার্পিস (যবৎঢ়বং), রোটাভাইরাস ডায়রিয়া, ফিভার এবং কয়েক ধরনের এনসেফালাইটিস। এছাড়া ক্যান্সারও ভাইরাসজনিত বলে মনে করা হয়। আন্তজার্তিক ও জাতীয়ভাবে এসব রোগ সম্পর্কে যে গবেষণা নেই তা কিন্ত নয়। আসলে ভাইরাস রোগ সম্পর্কে আমাদের ব্যাপক সচেতনতা প্রয়োজন। ১৯৬৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ (ডঐঙ) সর্বপ্রথম সারা বিশ্বে গুটি বসন্ত নির্মূলের প্রচারণা চালায় এবং সফলভাবে এ কর্মসূচি বাস্তবায়িত করে। ফলে অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই পৃথিবী থেকে গুটি বসন্ত বিতাড়িত হয়। বাংলাদেশে সর্বশেষ গুটি বসন্তের ঘটনা লিপিবদ্ধ হয়েছে ১৯৭৫ সালে।
বাংলাদেশে সচরাচর ভাইরাসজনিত যেসব রোগ তা হচ্ছেÑ জন্ডিস, হাম, মাম্পস এবং জলবসন্ত (ঈযরপশবহঢ়ড়ী)। জলবসন্ত সংক্রমণের জন্য দায়ী ভাইরাসের সঙ্গে গুটিবসন্তের ভাইরাসের সম্পর্ক নেই। আশার কথা, হলোপোলিওমাইলিটিস ভাইরাসজনিত রোগটি বাংলাদেশে অনেক বছর আগে থেকেই নির্মূল করা হয়েছে। ওপরে উল্লিখিত রোগগুলো তাদের বৈশিষ্ট্যময় উপসর্গের মাধ্যমে এবং কতক ল্যাবরেটরি পরীক্ষার সহায়তায় চিকিৎসকরা শনাক্ত করতে পারেন। ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতে রোগ নির্ণয়ের জন্য এখন অনেক সুযোগ-সুবিধা গড়ে উঠেছে। মারাত্মক হেপাটাইটিস বি-ভাইরাস শনাক্তের জন্যও প্রয়োজনীয় পরীক্ষা পদ্ধতি এখন দেশেই সহজলভ্য। বাংলাদেশের জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৮৩ ভাগ লোক হেপাটাইটিস এ-ভাইরাসের এন্টিবডিজ (ধহঃরনড়ফরবং) বহন করে।
এতে বোঝা যায়, জীবনের কোনো এক পর্যায়ে তারা সম্ভবত এ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল। শতকরা প্রায় ৭.৫ ভাগ মানুষের হেপাটাইটিস বি-ভাইরাসের উপস্থিতির কথা জানা গেছে, অর্থাৎ দেশের প্রায় ১ কোটি মানুষের শরীরে বি-ভাইরাস রয়েছে। বাংলাদেশে অন্য হেপাটাইটিস ভাইরাসগুলোর উপস্থিতির সম্ভাব্য পরিমাণের কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি।
করোনা ভাইরাস সম্পর্কে কিছু ধারণা : করোনা ভাইরাস মূলত পশুর দেহ থেকে মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির থেকেও অন্য ব্যক্তির শরীরে এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির সংস্পর্শে এলে বা তার সঙ্গে হাত মেলালেও এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
করোনো ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ : এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণগুলো হলোÑ জ্বর, শ্বাসকষ্ট, কাশি। তবে অসুখের মাত্রা আরও বাড়লে কিডনি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। করোনা ভাইরাস মরণব্যাধি।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, এখনও এ ভাইরাস থেকে বাঁচার কোনো ওষুধ বা প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। তাই করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচতে যা করবেনÑ ১. বাইরে বের হওয়ার আগে সঙ্গে মাস্ক নিতে ভুলবেন না ২. বাস, ট্রেন বা এ জাতীয় গণপরিবহনগুলো এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন ৩. বাইরে থেকে ফিরে হ্যান্ডওয়াশ বা লিকুইড সোপ দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে নিন ৪. ডিম কিংবা মাংস রান্নার সময় চেষ্টা করুন পর্যাপ্ত সময় ধরে রান্না করতে; যাতে এগুলো অবশ্যই সিদ্ধ হয় ৫. ময়লা কাপড় দ্রুত ধুয়ে রাখার চেষ্টা করুন, দিন বা সপ্তাহ ধরে ফেলে রাখবেন না। ৬. ঘর পরিষ্কার রাখুন ও নিয়মিত আপনার থাকার ঘর এবং কাজের জায়গা পরিষ্কার করুন। ৭. এ সময়ে বিয়ে বাড়ি, বিপণিবিতান, মার্কেট প্লেস বা যেখানে লোকসমাগম বেশি হয় তা এড়িয়ে চলা উচিত।
অধ্যাপক (ডা.) মনজুর হোসেন
শিশুরোগ ও শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ
সাবেক পরিচালক, শিশু হাসপাতাল
ডা. মনজুরস চাইলডস কেয়ার সেন্টার
ধানমন্ডি, ঢাকা-১২০৯
মোবাইল-০১৭১১৪২৯৩৭৩