আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ৩-০২-২০২০ তারিখে পত্রিকা

ফরমালিন মানবদেহের নীরব ঘাতক

আফতাব চৌধুরী
| সম্পাদকীয়

খাদ্য, স্বাস্থ্য ও পুষ্টিÑ এ তিনটি শব্দ একটি আরেকটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সুস্বাস্থ্য ও সুস্থ মনের জন্য প্রতিদিন পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্যের প্রয়োজন। 
খাদ্যের কয়েকটি উপাদান যেমন শর্করা, আমিষ, ভিটামিন, খনিজ লবণ ও পানি শরীরের চাহিদা অনুযায়ী পরিমিত পরিমাণে গ্রহণ করাই হলো সুষম খাবার। শর্করা শরীরে শক্তি ও কার্যক্ষমতা জোগায়। চাল, গম, যব, আলু, মিষ্টি, কচু, চিনি, মধু, গুড় ইত্যাদিতে প্রচুর শর্করা পাওয়া যায়। প্রতি গ্রাম শর্করা থেকে ৪ কিলো-ক্যালোরি শক্তি পাওয়া যায়। প্রোটিন হলো দেহ গঠন ও ক্ষয় পূরণকারী খাদ্য। মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, বিভিন্ন ডাল, বরবটি, শিম, মটরশুঁটি ইত্যাদি দেহ গঠনে সহায়তা করে। প্রতি গ্রাম প্রোটিন থেকে ৪ কিলো-ক্যালোরি শক্তি পাওয়া যায়। চর্বি বা ফ্যাট দেহের কর্মদক্ষতা বজায় রাখে এবং ত্বক সুন্দর ও মসৃণ রাখে। সয়াবিন তেল, সরিষার তেল, তিলের তেল, ঘি, মাখন, চর্বিযুক্ত মাছ, মাংস, ডিমের কলিজা ইত্যাদি চর্বিযুক্ত খাদ্য। প্রতি গ্রাম চর্বি থেকে ৯ কিলো-ক্যালোরি শক্তি পাওয়া যায়। পানি শরীরকে পানিশূন্যতা থেকে রক্ষা করে এবং শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখে। দিনে কমপক্ষে ৮ থেকে ১০ গ্লাস পানি পান করা দরকার। এছাড়া বিভিন্ন ফলের রস, পানি জাতীয় খাবার গ্রহণ করা দরকার। আঁশ দেহের কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে ওজন নিয়ন্ত্রণ, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, অন্ত্রনালির সুস্থতা বজায় রাখে। খাদ্যের আঁশ উদ্ভিজ খাদ্য থেকে পাওয়া যায়। যেমনÑ লাল আটা, যব, ভুট্টা, যবের ছাতু, শিম, শিমের বিচি, ডাল ও ডালজাত খাদ্য, খোসাসহ ফল যেমনÑ কালোজাম, আঙুর, পেয়ারা, আপেল, নাশপাতি ও সব ধরনের শাকসবজি। 
খনিজ লবণ যেমনÑ ফসফরাস, লৌহ, আয়োডিন, জিংক যা দেহ গঠন, ক্ষয় পূরণ, পরিপোষণ, দেহের শরীরবৃত্তিয় কাজ করে। আয়োাডিন গলগণ্ড রোগ প্রতিরোধ করে। লৌহ রক্তস্বল্পতা দূর করে হাত ও দাঁতের গঠন মজবুত করে। জিংক মানসিক ও হাড়ের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, সবুজ ও রঙিন শাকসবজি, পাকা তেঁতুল, সামুদ্রিক মাছ, আয়োডিনযুক্ত লবণ ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে খনিজ লবণ পাওয়া যায়। ভিটামিন এ, ডি, ই, কে, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, সিÑ সব রকমের সবুজ ও রঙিন শাকসবজি, ফল, টক জাতীয় ফল, ডিম, দুধ, কলিজা, ছোট মাছ, লেবু চা ইত্যাদি রোগ প্রতিরোধকারী খাদ্য। ভিটামিন ‘এ’ রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করে। ভিটামিন ‘ডি’ রিকেট রোগ প্রতিরোধ করে। ভিটামিন ‘বি’ কমপ্লেক্স ত্বকের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করে। ভিটামিন ‘সি’ স্কার্ভি রোগ প্রতিরোধ করে। 
অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশু, মা ও বৃদ্ধরা পরিবারের জন্য অর্থনৈতিক ও মানসিক বিপর্যয় ডেকে আনে। শিশুমৃত্যুর কারণ হিসেবে পেটের অসুখ, হাম, নিউমোনিয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুর মধ্যে দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধি না ঘটার কারণে আত্মকেন্দ্রিকতা, অবসাদ, ব্যক্তিত্বহীনতা দেখা যায় এবং মেধাশক্তি বিকশিত হতে পারে না। ফলে এসব ছেলেমেয়ে অলস ও উদাসীন, পরনির্ভর নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে। আজকের শিশু আগামী দিনের নাগরিক। শিশুর জন্য জন্মের ৬ মাস পর্যন্ত মায়ের দুধই যথেষ্ট এবং ৬ মাস থেকে ২ বছর পর্যন্ত মায়ের দুধের পাশাপাশি আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী অধিক পুষ্টিকর পরিপূরক খাবার দিতে হবে। সেই সঙ্গে লক্ষ রাখতে হবে যাতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত পরিবেশে খাদ্য পরিবেশন করা হয়। তাছাড়া সঠিক রান্নার পদ্ধতি, নির্দিষ্ট সময়ে খাওয়া ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা সবই স্বাস্থ্য ও পুষ্টিকে প্রভাবিত করে। মারাত্মক পুষ্টিহীন শিশুদের শুধু ডাল, আলু, সবুজ তেল দিয়ে রান্না করা খিচুড়ি খাইয়ে অতি অল্প সময়ের মধ্যে স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটানো সম্ভব। শিশুর পুষ্টির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ন্ত ও কৈশোর বয়সের ছেলেমেয়েদের পুষ্টির দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। শারীরিক, মানসিক, সামাজিকÑ সব ক্ষেত্রেই পরিবর্তন চূড়ান্ত। তাই পুষ্টির চাহিদাও এ সময়ের পরিবর্তনের ওপর নির্ভরশীল। এ বয়সে মেয়েদের অপুষ্টি বেশি দেখা যায়। কিশোর-কিশোরীদের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন ও ক্যালোরির চাহিদা পূরণ করতে হয়। পরিমিত পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ, বিশুদ্ধ পানি, নিয়মিত শারীরিক শ্রম, বিশ্রাম, খেলাধুলা ইত্যাদি বিষয়ের ওপরও নজর দিতে হবে। 
মায়ের পুষ্টি শিশুর তুষ্টি। অর্থাৎ সুস্থ ও স্বাস্থ্যবতী মা-ই শুধু স্বাস্থ্যবান সন্তানের জন্ম দিতে পারে। পুষ্টিহীন মায়ের সন্তানের জন্মকালীন ওজন কম এবং অসুস্থ, হাবাগোবা, রুগ্্ণ হয়ে জন্মায়। পরবর্তী সময়ে নানা রোগে ভোগে। প্রসূতি মায়েদেরও নানা রকম জটিলতা দেখা যায়। গর্ভবতী ও স্তন্যদাত্রী অবস্থায় মায়েদের খাবারের প্রয়োজন সাধারণ অবস্থার চেয়ে বেশি থাকে। এ সময় প্রয়োজন অনুযায়ী ফলিক অ্যাসিড, আয়োডিন, ক্যালসিয়াম ও আয়রন, জিংকসমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। অনেক সময় পুষ্টি সম্পর্কে ধারণা না থাকার ফলে পুষ্টির অভাবে নিজের চাহিদার ঘাটতির সঙ্গে সন্তানও পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের ঘাটতি নিয়ে জন্মায়। মাকে মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, বিভিন্ন রঙিন শাকসবজি, ফল, টকজাতীয় ফল, পানি ও পানিজাতীয় খাবার প্রয়োজন অনুযায়ী খেতে হবে। তাছাড়া এ সময় চিন্তামুক্ত ও আনন্দভাব নিয়ে থাকতে হবে। অনেক সময় কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ধারণা মায়ের অপুষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
অন্যদিকে বৃদ্ধ বয়সেও স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য পুষ্টির চাহিদা রয়েছে। বয়স বাড়লে চাহিদা কমে যায়। হৃৎপিণ্ডের কার্যক্ষমতা কমে যায়, রেচনতন্ত্রের কার্যক্ষমতা কমে যায়, দাঁত-হাড়ের সমস্যা ও বাত-ব্যাধি দেখা দেয়, পরিপাকতন্ত্রের কার্যক্ষমতা কমে যায়, রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। এ বয়সে সাদা আটা, চাল, চিনি, ময়দা ইত্যাদি খাবার কম খেতে হবে। তেল, চর্বি, লবণ, মিষ্টি ক্যাফেন সমৃদ্ধ খাবারও কম খেতে হবে। এ সময়ে পানি ও পানি জাতীয় খাবার বেশি খেতে হবে। হজমে সহায়ক, কোষ্ঠকাঠিন্য রোধক, বাত ও ওজন নিয়ন্ত্রক খাবার খেতে হবে। লাল আটা, বিভিন্ন আঁশ জাতীয় শাকসবজি, ফল, চর্বিহীন মাছ-মাংস ইত্যাদি খাবার খেতে হবে। প্রয়োজনে হাঁটতে হবে। না হলে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, কিডনির সমস্যা, বাত, চোখের রোগ ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। 
আজকাল আমরা যেসব খাবার খাচ্ছি তার অধিকাংশই ভেজাল। নিত্যদিনের চাল, ডাল, তেল লবণসহ পানীয়দ্রব্য, ফলমূল এবং মিষ্টান্ন দ্রব্যে ভেজালের ছড়াছড়ি। যেমন কোকাকোলা, মিরান্ডা, পেপসি, ইত্যাদিতে ক্ষতিকারক রং এবং রাসায়নিক তরল পদার্থ ব্যবহার করে বাজারজাত করা হচ্ছে। মিষ্টান্ন দ্রব্য যেমনÑ জিলাপি, বুন্দিয়া, রসগোল্লা প্রভৃতি বানানোর জন্য ময়দা, আটা, সুজি ইত্যাদি ভালোভাবে মেখে দু-তিন দিন নিরাপদে রেখে পচানো হয় এবং তারপর নানা ধরনের পাউডার, রং মিশিয়ে হোটেল-রেস্টুরেন্টে সাজিয়ে রাখা হয়। মরিচ গুঁড়ো, হলুদ গুঁড়ো ঝকঝকে রঙিন করার জন্য ইটের গুঁড়াও মেশানো হয় বলে প্রায়ই শোনা যায়। বছরখানেক আগে ঢাকার এক মশলা ব্যবসায়ীকে পচা চালের গুঁড়া মশলায় মেশানোর দায়ে পুলিশ হাতেনাতে ধরেছিল, যা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আমরা দেখেছি। বিভিন্ন ধরনের ফলমূল যেমন আম, কলা, পেঁপে, নাসপাতি এবং শাকসবজি যেমন টমেটো, পটোল, আলু ইত্যাদি দীর্ঘমেয়াদি তাজা রাখতে এবং কৃত্রিম উপায়ে পাকাতে ইথোফেন, ক্যালসিয়াম, কার্বাইড নামক রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে। বিদেশ থেকে যেসব মাছ আমাদের দেশে আমদানি হচ্ছে সেগুলোতেও নাকি ফরমেলাইডিহাইড (ঋড়ৎসধষধফবযুফব) নামক এক ধরনের রাসায়নিক যৌগ ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঋড়ৎসধষধফবযুফব বা ফরমালিন প্লাস্টিক, পেপার, রং, কনস্ট্রাকশন বা মৃতদেহ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। মানবদেহে ক্যান্সার সংক্রমণের বেলায় এই ঋড়ৎসধষধফবযুফব যথেষ্ট সাহায্য করে। লন্ডনে ১৮৯০ সালে এক ল্যাবরেটরি পরীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী ‘ঊীঢ়ড়ংব ঃড় ঋড়ৎসধষধফবযুফব পড়ঁষফ পধঁংব হধংধষ পধহপবৎ রহ ৎধঃং, ১৯৮৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ঊঘঠওজঙঘগঊঘঞঅখ চজঙঞঊঈঞওঙঘ অএঅঘঈণ (ঊচঅ)-র রিপোর্টে বলা হয়েছে ‘ঋড়ৎসধষধফবযুফব বীঢ়ড়ংঁৎব রং ধংংড়পরধঃবফ রিঃয পবৎঃধরহ ঃুঢ়বং ড়ভ পধহপবৎ’ তাছাড়া ২০১৮ সালের ১০ জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল টক্সিকোলজি প্রোগ্রাম’ ফরমালিনকে মানুষের ক্যান্সার রোগ সৃষ্টিতে সরাসরি সম্পৃক্ত বলে জানায়। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ‘ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন’ খাদ্যদ্রব্যে ঋড়ৎসধষধফবযুফব বা ফরমালিনের ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। 
বাংলাদেশেও ফরমালিন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ফরমালিন মেশানোর অভিযোগে বিভিন্ন সময় ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে জরিমানাসহ নানা ধরনের শাস্তির ব্যবস্থা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে মিষ্টি খাদ্যদ্রব্যে কোনো ভেজাল বস্তুর অস্তিত্ব ধরা পড়লে জরিমানা অথবা হাজতবাসের বিধান চালু করেছে। 
অন্যদিকে বিভিন্ন ধরনের চকোলেট, আচার ইত্যাদির প্যাকেট লক্ষ্য করলে দেখা যায় প্রস্তুতের সময় মাস বা বছর লেখা থাকে; কিন্তু কবে মেয়াদোত্তীর্ণ হবে তা লেখা থাকে না। আবার কোনোটিতে লেখা থাকে তৈরির সময় থেকে ৬ মাস পর্যন্ত ভালো থাকবে; কিন্তু প্রস্তুতের সময় ও দিন-তারিখ লেখা থাকে না। এসব আমাদের ছোট ছোট বাচ্চারা বেশিরভাগেই খেয়ে থাকে। এতে তাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতি তো বটেই পেটেরও বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে।  আলোচ্য খাদ্যগুলো আমাদের স্বাস্থ্যকে মারাত্মক ঝুঁকির দিকে তো নিচ্ছেই, আয়ুও কমাচ্ছে। এগুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে থাকে এবং শরীরে বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ দেখা দেয় যেমনÑ পেটফোলা, বুকে ব্যথা অনুভব করা, শরীরে জ্বালাপোড়া করা, বমি হওয়া ইত্যাদি। পরবর্তী সময়ে ধরা পড়ে আলসার, পাকস্থলী ও লিভারের সমস্যা, কিডনি বিকল, জন্ডিস ইত্যাদি নানা ধরনের রোগ। 
সুতরাং এসব প্রতিরোধে জনসচেতনতার পাশাপাশি কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা একান্ত প্রয়োজন। গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-নগরে এ ব্যাপারে বিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ করে গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। মানুষ তো বাঁচার জন্য খায়, মরার জন্য নয়। আর খাদ্য যদি মরণের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাহলে তারাই তো এক ধরনের ভাগ্যবান যারা খাবার না পেয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। হ

আফতাব চৌধুরী 
সাংবাদিক কলামিস্ট