আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ৩-০২-২০২০ তারিখে পত্রিকা

অমুসলিমদের প্রতি শান্তি ও নিরাপত্তার বার্তা

গোলাম রাজ্জাক কাসেমী
| সভ্যতা ও সংস্কৃতি

 

মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধভাবে জীবনযাপন করতে গিয়ে তাকে নানা শ্রেণির নানা মত ও ধর্মের মানুষের সঙ্গে ওঠবস করতে হয়। চলাফেরা করতে হয় অমুসলিমদের সঙ্গেও। লেনদেন, চলাফেরা, সাহায্য-সহযোগিতা ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে একজন মুসলমানকেও মুখোমুখি হতে হয় অমুসলিমের।  কোনো মুসলিমপ্রধান দেশে অমুসলিমদের বসবাস কিংবা কোনো অমুসলিমপ্রধান দেশে মুসলমানদের বসবাস বর্তমান পৃথিবীতে বিচিত্র কিছু নয়। অমুসলিম ব্যক্তি হতে পারে কোনো মুসলমানের প্রতিবেশী। সেক্ষেত্রে অমুসলিমদের সঙ্গে আচরণে ভদ্রতা ও সৌজন্য রক্ষা করা প্রিয় নবীর শিক্ষা। নিচের হাদিসটি তার জ্বলন্ত প্রমাণ।
সাহল ইবনে হুনাইফ ও হজরত কায়েস ইবনে সাদ (রা.) একদিন বসা ছিলেন। পাশ দিয়ে একটি লাশ নেওয়া হচ্ছিল। তা দেখে তারা দুজনই দাঁড়ালেন। উপস্থিত লোকেরা তাদের জানাল, ‘এ এক অমুসলিমের লাশ।’ তারা তখন শোনালেন, রাসুলের পাশ দিয়েও একবার এক লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তিনি যখন তা দেখে দাঁড়ালেন, উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম তখন বললেন, এ তো ইহুদির লাশ। নবীজি তখন তাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘সে কি মানুষ নয়?’ (বোখারি : ১৩১২)।
মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষ সবার  জন্য দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণকামিতায় ব্যয়িত হয়েছে নবীজির পুরো জীবন। তিনি বলেছেন, ‘দ্বীন হলো কল্যাণকামিতার নাম।’ (আবু দাউদ : ৪৯৪৪)।
কীভাবে একজন জাহান্নামিকে জান্নাতের পথে আনা যায় সে চিন্তায় রাসুল (সা.) বিভোর থাকতেন রাত-দিন। এক ইহুদি বালক নবীজির খেদমত  করত, সে একবার অসুস্থ হয়ে পড়লে নবী তাকে দেখতে যান। তিনি তার মাথার কাছে বসে তাকে বললেন : তুমি ইসলাম গ্রহণ কর, সে তখন তার বাবার দিকে তাকাল, বাবা নিকটেই ছিলেন, বললেন, আবুল কাসেমের কথা মেনে নাও, খাদেম তখন ইসলাম গ্রহণ করে নেয়। একজন জাহান্নামিকে জান্নাতের পথে নিয়ে আসতে পারায় নবীজি (সা.) অনেক আনন্দিত হলেন। তাদের কাছ থেকে ফিরে আসার সময় নবী (সা.) শুকরিয়া জ্ঞাপন করে বলেন, যাবতীয় প্রশংসা সে আল্লাহর, যিনি তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিলেন। (বোখারি : ১৩৫৬)। একদা প্রিয় নবীজিকে মুশরিকদের বিরুদ্ধে বদদোয়া করতে বলা হলো। রাসুল (সা.) তখন বললেন, ‘আমি অভিশাপ নিয়ে আসেনি, এসেছি রহমত নিয়ে।’ (মুসলিম : ২৫৯৯)।
অমুসলিম প্রতিবেশীর সঙ্গে আচরণ কেমন হবে? সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে প্রতিবেশীর সঙ্গে সুন্দর আচরণ করা ইসলামের অন্যতম শিক্ষা। তাই সর্বাবস্থায় সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে ভদ্র আচরণ করা কর্তব্য। চাই সে মানুষটি যে পর্যায়েরই হোক না কেন। প্রতিবেশী কিংবা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ভালো আচরণ করা এবং তাদের অধিকার রক্ষা করার ওপর রাসুল (সা.) হাদিসে যথেষ্ট জোর দিয়েছেন। প্রতিবেশী বলতে মুসলিম, অমুসলিম, ভালো-মন্দ, শত্রু-মিত্র,  আত্মীয়-অনাত্মীয়Ñ সবাই অন্তর্ভুক্ত। তারা ঋণ চাইলে ঋণ দেওয়া, সহযোগিতা চাইলে সহযোগিতা করা, অসুস্থ হয়ে পড়লে খোঁজখবর নেওয়া, কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে তা দেওয়া, অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়লে তার খোঁজখবর নেওয়া, কোনো ভালো খাবার রান্না করলে তাকে এর ঘ্রাণ ছড়িয়ে কষ্ট না দেওয়া, বরং তার ঘরেও সে খাবার থেকে কিছু পৌঁছে দেওয়া। বাজার থেকে কোনো ফল কিনে এনে হাদিয়াস্বরূপ তাকে সেখান থেকে কিছু দেওয়া। মুসলমান হলে তার জনাজায় অংশগ্রহণ করাÑ এ সব কিছু প্রিয়নবীর দিকনির্দেশনা। এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন প্রতিবেশীর সঙ্গে সদাচরণ করে। (মুসলিম : ১৮৫)। অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়। (মুসলিম : ১৮৩)।
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ওই ব্যক্তি মোমিন নয় যে পেটপুরে খায় অথচ তার পাশের প্রতিবেশী না খেয়ে থাকে।’ (আল আদাবুল মুফরাদ : ১১২)। এক প্রতিবেশী আরেক প্রতিবেশীকে হাদিয়া দেওয়ার ব্যাপারে  উদ্বুদ্ধ করেছেন। আল্লাহর রাসুল (সা.) হজরত আবু জর (রা.) কে বলেন, হে আবু জর, তুমি তরকারি রান্না করলে তার ঝোল বাড়িয়ে দিও এবং তোমার প্রতিবেশীকে তাতে শরিক করো। (আল আদাবুল মুফরাদ : ১১৩)। আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখার বিষয়ে নির্দেশনা তো আরও স্পষ্ট। রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘যে আল্লাহ ও পরকালে ঈমান এনেছে সে যেন তার আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখে।’ (বোখারি : ৬১৩৮)।
প্রতিবেশী ও আত্মীয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলার এই যে নির্দেশনা, তাতে মুসলিম-অমুসলিমের মাঝে কোনো পার্থক্য করা হয়নি। এমনটি বলা হয়নিÑ তোমার প্রতিবেশী কিংবা আত্মীয় যদি মুসলমান হয়, ধার্মিক হয়, ভালো মানুষ হয়, তাহলে তার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলবে। বরং প্রতিবেশী ও আত্মীয় যেমনই হোক, মুসলমান হোক কিংবা না হোক, তার অধিকার অকাট্য ও অনস্বীকার্য। একজন মুসলমানকে এ অধিকার রক্ষা করেই জীবনযাপন করতে হবে।