আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ৩-০২-২০২০ তারিখে পত্রিকা

দেশে ডিজেল মজুত মাত্র ২০ দিনের

সাইফুদ্দিন তুহিন, চট্টগ্রাম
| শেষ পাতা

- কেপিসির ডিজেল সরবরাহ  হ্রাস
- সংকট ভয়াবহ রূপ নেওয়ার শঙ্কা 
- বিপিসি বলছে কোনো সংকট নেই

ভরা মৌসুমে ভয়াবহ ডিজেল সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। রোববার দেশের সব ডিপো মিলিয়ে ডিজেল মজুত ছিল ২ লাখ ৭ হাজার টন। যা দিয়ে বর্তমান দৈনিক চাহিদা অনুযায়ী ২০ দিন চলবে। প্রতিদিন গড়ে এখন ডিজেল বিক্রি হচ্ছে ১৪ হাজার ৫০০ টন থেকে ১৫ হাজার টন। কিন্তু বিদেশ থেকে চাহিদার সমান সরবরাহ আসছে না ডিজেলের। এতে যে কোনো সময় ডিজেল সংকটে বিপর্যয়কর পরিস্থিতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। সংকট এড়াতে দেশের একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডে (ইআরএল) উৎপাদন বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। দৈনিক ১ হাজার ৪০০ টনের স্থলে এখন ২ হাজার ২০০ টন করে ডিজেল উৎপাদন হচ্ছে। এরপরও সংকট এড়ানো যাবে কি না তা নিয়ে কাটছে না শঙ্কা। তবে বিপিসি বরাবরের মতো বলে আসছে দেশের ডিপোগুলোতে পর্যাপ্ত ডিজেল মজুত আছে। বিদেশ থেকে আরও ডিজেল ভর্তি অয়েল ট্যাঙ্কার ভিড়ছে চট্টগ্রাম বন্দরে। তাই বড় ধরনের সংকটের কোনো আশঙ্কা নেই।

বিপিসির সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতি বছরের ডিসেম্বর মাসে শুরু হয় সেচ মৌসুম। আর এ সেচ মৌসুম শেষ হবে চলতি বছরের মে মাসে। সেচ মৌসুমে ডিজেলের চাহিদা প্রতিদিন বাড়তে থাকে। বিশেষ করে জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের পুরো সময়জুড়ে চাহিদা থাকে বেশি। বোরো মৌসুমে ধানের চারা রোপণ শুরু হয়ে যায় এ সময়। দেশে বিদ্যুৎনির্ভর সেচ যন্ত্রের সংখ্যা বাড়লেও ডিজেলনির্ভর সেচ যন্ত্রের চাহিদা কমেনি। অর্থাৎ এখনও বোরো মৌসুমে সেচের জন্য ডিজেলনির্ভর সেচ যন্ত্রই ভরসা কৃষকের। তাই পুরো বোরো মৌসুমজুড়েই থাকে ডিজেলের চাহিদা। প্রতি বছর চাষাবাদযোগ্য জমির পরিমাণ নির্ধারণ করে বছরের জুন-জুলাই মাসে বিদেশ থেকে জ্বালানি তেল বিশেষ করে ডিজেল আমদানির পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়। যাতে সেচ মৌসুমে ডিজেলের চাহিদা বাড়লে সরবরাহের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা না হয়। কোনো কারণে আমদানি চালানের সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিলেই ডিপোতে ডিজেল সংকট দেখা দেয়। শুধু সেচের ক্ষেত্রে নয় পেট্রোলপাম্পগুলোতেও সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেয়। এতে যানবাহনের চাহিদা পূরণ করাও কঠিন হয়ে পড়ে। 

বিপিসির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, অন্যতম বড় সরবরাহকারী কুয়েত পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের  (কেপিসি) জ্বালানি তেল সরবরাহ চুক্তি রয়েছেদেশে ডিজেল মজুত 

বিপিসির। এরপর বড় সরবরাহকারী মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস ট্রেডিং করপোরেশন (পেটকো)। এছাড়াও মিসরের মিডলইস্ট অয়েল রিফানারি (মাইডোর), সংযুক্ত আরব আমিরাতের অ্যাডনকসহ বিভিন্ন সরবরাহকারী কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি রয়েছে। গেল ডিসেম্বরে কেপিসির সঙ্গে বিপিসির জ্বালানি তেল সরবরাহ চুক্তি নবায়ন হয়নি। এতে কেপিসি জ্বালানি তেল সরবরাহ আপাতত স্থগিত রেখেছে। এরই মধ্যে কেপিসিরি পক্ষ থেকে বিপিসির কাছে প্রতিশ্রুত কয়েকটি ডিজেলের চালান পৌঁছেনি। মূলত এরপর থেকে সারা দেশের ডিপোতে ডিজেলের মজুত কমতে থাকে। তাই বিপিসির ডিপোগুলোতে রোববার পর্যন্ত ডিজেলের মজুত ২ লাখ মেট্রিক টনে পৌঁছে যায়। অথচ এ সময় ডিপোগুলোতে ডিজেলের মজুত থাকার কথা অন্তত ৬ লাখ টন। তবে বিপিসির অন্য সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর আমদানি চালান নিয়মিত আসছে চট্টগ্রাম বন্দরে। রোববার চট্টগ্রাম বন্দর বহির্নোঙরে ভিড়েছে ৩৩ হাজার টন ডিজেলবাহী একটি জাহাজ। ৪ ফেব্রুয়ারি দুটি ডিজেলবাহী জাহাজ ভিড়বে চট্টগ্রাম বন্দর বহির্নোঙরে। দুটি জাহাজে মোট ৬৫ হাজার টন ডিজেল থাকবে। 
তেল কোম্পানি যমুনার এক কর্মকর্তা জানান, ডিপোতে ডিজেলের মজুত হঠাৎ কমে যাওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে। এরমধ্যে আছে কেপিসি থেকে সরবরাহ হ্রাস পাওয়া, ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধের কারণে দাম বৃদ্ধির আশঙ্কায় মজুত বেড়ে যাওয়া, কিছু কিছু ক্ষেত্রে সীমান্তে পাচার হওয়াকেও বর্তমান সংকটের জন্য দায়ী করা হচ্ছে। এদিকে চলমান পরিস্থিতির কারণে বিপিসি জানিয়েছে কোনো ধরনের সংকট নেই। বুধবার (২৯ জানুয়ারি) দুপুরে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান সামছুর রহমান ঢাকায় প্রেস ব্রিফিংয়ে কোনো ধরনের সংকটের কথা নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি জানান, কেউ ডিজেলের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি কিংবা অতিরিক্ত মজুত করে পরিস্থিতি ঘোলা করার চেষ্টা করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে সরকার। দেশে সেচ মৌসুম ঘিরে ডিজেলের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। এ সময় তিনি বলেন, দেশের কোথাও জ্বালানি তেলের সংকট নেই। তিনি বলেন, আগামী মার্চে দেশে ১ মাসের ডিজেল মজুদের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে ডিজেলের আদৌ কোনো সংকট নেই। অতিরিক্ত ডিজেল বিক্রির বিষয়টিও আমাদের কাছে একটু অস্বাভাবিক মনে হয়েছে এজন্য যে, কারণ আগের বছরগুলোতে এ সময় এত পরিমাণ ডিজেল সাধারণত বিক্রি হতো না। ফেব্রুয়ারি মাসে মোট ১৬টি জাহাজে প্রায় ৫ লাখ ২০ হাজার মেট্রিকটন ডিজেল আমরা আমদানি করব। যদি  কোনো কারণে অতিরিক্ত মজুদ করে কেউ ক্রাইসিস তৈরি করার চেষ্টা করে সে ক্ষেত্রে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিপিসির এক কর্মকর্তা জানান, বিপিসির গুরুত্বপূর্ণ তেল সরবরাহকারী কেপিসি। অন্য বিদেশি সরবরাহকারী সংস্থাগুলো সময়মতো তেলের চালান পৌঁছাতে পারে না। কেপিসির জ্বালানি তেল সরবরাহ সাময়িক বন্ধ হওয়ায় মূলত পুরো সরবরাহ ব্যবস্থা এলোমেলো হয়ে গেছে। বিপিসির পুরো সেচ মৌসুমের আমদানি পরিকল্পনাও এখন ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম। খুব দ্রুত কেপিসির কাছ থেকে জ্বালানি তেল বিশেষ করে ডিজেল আমদানি শুরু করা জরুরি। অন্যথায় দেশের ডিপোগুলোতে মজুত আরও কমবে। তখন সারা দেশে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নেবে।