প্রতিনিয়তই ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা। ঝরছে তরতাজা শত শত প্রাণ, কাঁদছে মানুষ। আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় সর্বদা মানুষ মৃত্যুর শিকার হচ্ছে। দুর্ঘটনা একটি অনাকাক্সিক্ষত বিষয়। অনেক সময় অজান্তেই সামনে চলে আসে আর ধ্বংস করে দেয় জীবন বা জীবনের ভবিষ্যৎ। দুর্ঘটনা জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না। প্রতিদিন পাখির মতো মানুষের জীবন নাশ হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনায় অস্বাভাবিক মৃত্যু আমাদের কপালে নিত্য লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা খণ্ডন করার উপায় কারও জানা নেই। সড়ক দুর্ঘটনা আস্তে আস্তে মুমূর্ষু রূপ ধারণ করেছে, যেখান থেকে উত্তরণের কোনো সন্তোষজনক ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু যার যা করণীয়টুকু নিয়ে যদি দুর্ঘটনার আগেই কিছু ভাবা যায় তাহলে কেমন হয়! এক কথায় সচেতনতা। একটু সচেতনতা হয়তো আপনাকে বাঁচাতে পারে অনাকাক্সিক্ষত এসব দুর্ঘটনার হাত থেকে।
অনিরাপদ সড়ক ব্যবস্থায় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে মৃত্যু ঝুঁকি। দৈনিক পত্রিকাগুলোতে আলোচ্য বিষয় হিসেবে রূপ নিয়েছে সড়ক দুর্ঘটনা। বর্তমানে বাংলাদেশে দৈনিক মৃত্যুর হার গণনা করলে যা দাঁড়ায়, তার বড় একটি অংশ আছে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু। ১৮ জানুয়ারি রাজধানীর উত্তরায় বেপরোয়া বাসের ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী দুই ভাইয়ের মর্মান্তিক মৃত্যু। একই দিন চট্টগ্রামের পটিয়ায় দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে দম্পতিসহ তিনজন নিহত। এ ছাড়া দেশের অন্য স্থানে আলাদা সড়ক দুর্ঘটনায় আরও ৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এ নিয়ে গেল ২৬১ দিনে সড়কে ২১০৯ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে ১৯ জানুয়ারি যশোরে দুই প্রাইভেট কার দুর্ঘটনায় একই পরিবারের তিন নারী এবং সিলেটে দুই শিক্ষার্থী নিহত। ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে, সারা দেশে গেল বছর ৫ হাজার ৫১৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৮৫৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে ১৩ হাজার ৩৩০ জন। ২০১৯ সালের সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল আগের বছর ২০১৮ সালের প্রায় সমান। ২০১৮ সালের তুলনায় গেল বছর প্রাণহানির সংখ্যা ৮ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৯ সালে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা হয় ১৫ জুন। এ দিনে ৩১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৭ জন নিহত ও ১২১ জন আহত হয়। এ বছর সবচেয়ে কম সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে ১৪ জুলাই। এ দিন দুটি সড়ক দুর্ঘটনায় দুজন নিহত হয়। (তথসূত্র : আমাদের সময়-১২.০১.২০)।
অন্যদিকে ঢাকার শিপিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন রিপোর্টার্স ফোরাম (এসসিআরএফ) এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০১৯ সালে চার হাজার ২১৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৮৫ নারী ও ৭৫৪ শিশুসহ চার হাজার ৬২৮ জন নিহত ও আট হাজার ৬১২ জন আহত হয়েছেন। ওই বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মহাসড়ক, জাতীয় মহাসড়ক, আন্তঃজেলা সড়ক ও আঞ্চলিক সড়কসহ সারাদেশে এসব দুর্ঘটনা ঘটে। ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনা ও আহতের সংখ্যা ২০১৮ সালের তুলনায় কম হলেও প্রাণহানির সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৮ সালে চার হাজার ৩১৭টি দুর্ঘটনায় চার হাজার ৫৮০ জন নিহত ও ১০ হাজার ৮২৮ জন আহত হয়েছিল। (তথসূত্র : সমকাল- ০৩.০১.২০)।
প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে, কমছে না; বরং অকালে ঝরছে অসংখ্য প্রাণ, নিঃস্ব হচ্ছে অনেক পরিবার। এ অস্বাভাবিক সড়ক মৃত্যুর শেষ কোথায়? আর কত প্রাণ ক্ষয় হলে আমাদের বোধোদয় হবে, সড়কে ফিরে আসবে শৃঙ্খলা।
মনে প্রশ্ন আসতে পারে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার এত বেশি কেন? এর প্রধান কারণ হতে পারে অনিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা। যেখানে সড়ক পথে ট্রাফিক আইন তোয়াক্কা না করে অনেকেই বেপরোয়াভাবে দূরপাল্লার যান চালানো। ট্রাফিক আইন না মানলে চালকদের জন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা রাখা আছে। সেখানে গাড়িচালকরা কীভাবে ট্রাফিক আইন উপেক্ষা করে গাড়ি চালাতে পারে! নাকি কিছু লোকের ক্ষেত্রে সে বিচার ব্যবস্থা শিথিলযোগ্য? বাংলাদেশ পুলিশের কর্মতৎপরতা ও আইন ব্যবস্থার ওপর আমরা যথেষ্ট সন্তুষ্ট। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের দরুন আমরা আগের তুলনায় বর্তমানে একটু বেশিই ভালো আছি। তবুও তাদের প্রতি অনুরোধ, আপনারা সড়ক ব্যবস্থায় যদি আরও একটু নজরদারি করেন তাহলে হয়তো সড়ক দুর্ঘটনা অনেকটাই কমে আসবে। আপনাদের বাড়তি সচেতনতাই হতে পারে সড়ক দুর্ঘটনা থেকে মুক্তির পথ।
বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সড়কপথগুলো দিন দিন দুর্গম রূপ ধারণ করছে। চলাচল করা আমাদের জনসাধারণের জন্য সত্যিই খুব কষ্টকর ব্যাপার। বিশেষ করে ঢাকা ও এর আশপাশের বেশ কিছু সড়ক ও মহাসড়কের বেহালদশা আমাদের সবার কাছেই পরিলক্ষিত। এসব সড়কে গাড়ি চালানো তো দূরের কথা, জনসাধারণের চলাচলই অনেকটা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। আর যেখানে-সেখানে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি তো এখন সারা বছরের একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে যাত্রাপথে যুক্ত হচ্ছে আরও বাড়তি দুর্ভোগ। যত্রতত্র ভাঙা সড়কও কম দায়ী নয় সড়ক দুর্ঘটনার জন্য। পাশাপাশি সড়কে আনফিট গাড়ি আজকাল হরহামেশাই চোখে পড়ছে। তদারকির অভাবে দিন দিন বাড়ছে এরকম গাড়ির সংখ্যা। সাধারণ যাত্রীরা অনেকটা বাধ্য হয়েই এসব গাড়িতে যাত্রা করছেন। আপনাদের একটু শুভদৃষ্টি সড়ক ও পরিবহনের এ পঙ্গুত্ব থেকে মুক্তি দিতে পারে। আমাদের যারা সড়কের যাত্রী। সড়কে চলি পায়ে হেঁটে কিংবা গাড়িতে। রাস্তা পারাপারে, চলাচলে আমাদের চাই বাড়তি সচেতনতা। গাড়িতে ওঠা-নামাও যেন হয় ন্যূনতম ধৈর্য সহকারে। চলাচল নিরাপত্তায় প্রস্তুতকৃত ওভারব্রিজ ব্যবহার না করে মানুষ দৌড়ে কিংবা অন্য কোনো উপায়ে রাস্তা অতিক্রম করছে, এমন চিত্র মাঝে মাঝে পত্রিকায় ছাপা হয়। তাই সর্বদা যেন খেয়াল রাখি কোনো দুর্ঘটনাই যেন আমাকে পৌঁছে না দেয় অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কাছে। সড়ক দুর্ঘটনায় অসময়ের যাত্রী হওয়া জীবনগুলোকে রক্ষা করতে হবে। এ জন্য সরকারের বিশেষ মনোযোগ অবশ্যই জরুরি। সড়ক অব্যবস্থাপনার চিহ্নিত সমস্যাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে তা সংস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে। জনসচেতনতাই অনেকাংশে রোধ করতে পারে সড়ক দুর্ঘটনা। আসুন সড়কপথে নিজে সচেতন হই অন্যকে সচেতন করি।