আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ৫-০২-২০২০ তারিখে পত্রিকা

স্বাস্থ্য

করোনা ভাইরাস : আতঙ্ক নয় সতর্ক থাকুন

করোনা ভাইরাস প্রাণঘাতী এবং এর কোনো চিকিৎসা না থাকলেও আশার কথা হলো, যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন আক্রমণ থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারে। শীতের সময়গুলোতে এর সংক্রমণ দ্রুত ছড়ালেও গরম পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সংক্রমণ হার হ্রাস পাবে। ব্যাপক জনসচেতনতা, সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ ও সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এই রোগের হাত থেকে রক্ষা পেতে আমরা সফল হবো এমন প্রত্যাশা সবার

ডা. একেএম ফরহাদ হোসাইন
| সম্পাদকীয়

সম্প্রতি নতুন একটি ভাইরাসের খবরে বিশ্ববাসী উদ্বিগ্ন। উদ্বিগ্ন বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। অবাধ তথ্যপ্রবাহ বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে সুদূর চীন দেশে সংক্রমিত এ ভাইরাসের খবর এদেশের গ্রামগঞ্জের মানুষের মাঝেও ছড়িয়ে পড়েছে। ভাইরাসের সংক্রমণের চেয়ে হাজারগুণ দ্রুত ছড়াচ্ছে এর খবর। আতঙ্কিত হচ্ছে মানুষ, ছুটছে দিগি¦দিক, চলছে আলোচনা, পর্যালোচনা এবং একই সঙ্গে বিভিন্ন সমালোচনা।
বাংলাদেশে এ ভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনা কতটুকু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। এর আগে এ ভাইরাসের স্বরূপ বিশ্লেষণের দিকে একটু নজর দেওয়া যাক। ভাইরাসটির নাম করোনা ভাইরাস। এর আরেক নাম 2019 NOCV, এর অনেক প্রজাতি আছে, তবে মানুষের দেহে সংক্রমিত হতে পারে এর সাতটি প্রজাতি। এর ছয়টি প্রজাতি আগে থেকে পরিচিত থাকলেও এখন যে ভাইরাসটির দ্বারা মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে তা সম্পূর্ণ নতুন। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভাইরাসটি হয়তো এরই মধ্যে মানুষের দেহকোষের ভেতরে ঢুকে মিউটেশন ঘটাচ্ছে, অর্থাৎ গঠন পরিবর্তন করে সংখ্যাবৃদ্ধি করছে, যার ফলে এটি আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞদের ধারণা এর উৎস কোনো প্রাণী। মানুষের দেহে সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে চীনের উহান শহরে যেখানে সামুদ্রিক মাছ পাইকারি বিক্রি হয় এমন একটি বাজারে। বেশিরভাগ করোনা ভাইরাসই বিপজ্জনক তবে অপরিচিত এই ভাইরাসটি ভাইরাল নিউমোনিয়াকে মহামারির দিকে ঠেলে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জ্বর, কাশি, শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যাই মূলত এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার প্রধান লক্ষণ। এ ভাইরাস মানুষের ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায় এবং শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে একজনের দেহ থেকে আরেকজনের দেহে ছাড়ায়। সাধারণ ফ্লু বা ঠান্ডা-কাশির মতোই এ ভাইরাস ছড়ায় হাঁচি-কাশির মাধ্যমে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভাইরাসটি শরীরে ঢোকার পর সংক্রমণের লক্ষণ দেখা দিতে প্রায় পাঁচ দিন সময় লাগে। প্রথম লক্ষণ জ্বর, এরপর দেখা যাবে শুকনো কাশি, নিউমোনিয়া, অরগ্যান ফেইলিওর বা দেহের বিভিন্ন অঙ্গ বিকল হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। এক সপ্তাহের মধ্যে দেখা দেয় শ্বাসকষ্ট এবং তখন কোনো কোনো রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। এখন পর্যন্ত আক্রান্তের মধ্যে ২ শতাংশ মারা গেছে। হয়তো মৃত্যু হতে পারে আরও। তাছাড়া এমন মৃত্যুও হয়ে থাকতে পারে, যা শনাক্ত করা হয়নি। তাই এই ভাইরাস কতটা ভয়ঙ্কর তা এখনও স্পষ্ট নয়। 
এই ভাইরাস খুব দ্রুত ছড়াতে পারে এবং বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত হয়েছেন যে, এ ভাইরাস একজন মানুষের দেহ থেকে আরেকজন মানুষের দেহে ছড়াতে পারে। এরই মধ্যে চীনে মহামারির রূপ নিয়েছে করোনা ভাইরাস। উহান শহর থেকে ছড়িয়ে পড়া এ ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৪০০-এর কাছাকাছি। চীন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, সারাবিশ্বে এখন পর্যন্ত এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ১৭ হাজার জন। চীনের বাইরেও থাইল্যান্ড, জাপান, তাইওয়ান, আমেরিকা, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, হংকং, ম্যাকাও, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, ফিনল্যান্ড এবং দক্ষিণ কোরিয়াসহ ২৩ দেশে এ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। লুনার নিউ ইয়ার বা চন্দ্র নববর্ষ উপলক্ষে যখন লাখ লাখ মানুষ চীন ভ্রমণ করে তখন এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা কত হতে পারে তা যথেষ্ট উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ভাইরাস যেন দ্রুত না ছড়াতে পারে তার জন্য বিশ্বের অনেক বিমানবন্দরেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। 
ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও নেওয়া হয়েছে বিশেষ সতর্কতা। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার কোনো খবর পাওয়া যায়নি। তবে ঝুঁকি রয়েছে বলে জানিয়েছে Institute of Epidemiology, Disease Control and Research (IEDCR)। স্বাস্থ্যকর্মীদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বিমানবন্দরে স্থাপিত হেলথ ডেস্কে এসব কর্মীকে পাঠানো হচ্ছে। যেসব ফ্লাইট চীন থেকে আসছে, সেসব যাত্রীদের স্ক্যান করা হচ্ছে। এছাড়া বিমানবন্দরের এভিয়েশন, ইমিগ্রেশন ও এয়ারলাইনসের কর্মীদের সচেতন করছে স্বাস্থ্যকর্মীরা। IEDCR চারটি হটলাইনও খুলেছে। হটলাইনের নম্বরগুলো : (+৮৮) ০১৯৩৭০০০০১১, ০১৯৩৭১১০০১১, ০১৯২৭৭১১৭৮৪ এবং ০১৯২৭৭১১৭৮৫। দেশের বিভিন্ন স্থল, নৌ এবং বিমানবন্দরগুলোয় ইমিগ্রেশন স্বাস্থ্য ডেস্কগুলোয় সতর্কতা ও নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের বিভিন্ন প্রবেশ পথে করোনা ভাইরাস স্ক্রিনিং কার্যক্রম জোরদার করতে ডিজিটাল থার্মাল স্ক্যানারের মাধ্যমে বিদেশ থেকে আগত যাত্রীদের পরীক্ষা করা হচ্ছে। স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যবহারের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশেষ পোশাক (Personal Protection Equipment, PPE)) মজুদ রাখা হয়েছে। 
ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এরই মধ্যে এ ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দেশের সব জেলার জেলা প্রশাসক এবং সিভিল সার্জনকে সতর্কতা অবলম্বন ও সম্ভাব্য সংক্রমণে চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত থাকতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। উল্লেখ্য, IEDCR-এর নিজস্ব ল্যাবরেটরিতে এ ভাইরাস শনাক্তকরণের ব্যবস্থা রয়েছে। বিমানবন্দরে যে LED মঞ্চটি রয়েছে তাতে এ রোগের লক্ষণগুলো জানানো হচ্ছে এবং কারও যদি এ লক্ষণগুলো দেখা যায় তবে হেলথ ডেস্কে যোগাযোগের জন্য বলা হচ্ছে। চীনের উহান শহর এবং অন্যান্য স্থানে অবস্থানরত বাংলাদেশি নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে ৩১২ জন বাংলাদেশিকে বাংলাদেশ বিমানের একটি বিশেষ ফ্লাইটের মাধ্যমে চীনের উহান শহর থেকে ফেরত আনা হয়েছে। এদের মধ্যে শরীরের তাপমাত্রা বেশি থাকায় সাতজনকে ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও একজনকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বাকিদের আশকোনা হজক্যাম্পে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী চীন ফেরত এসব বাংলাদেশি নাগরিকদের সবাই সুস্থ রয়েছে।
যেহেতু এ ভাইরাসটি নতুন তাই এর চিকিৎসার জন্য কোনো টিকা/ভ্যাকসিন নেই এবং এমন কোনো চিকিৎসা নেই যা এ রোগ ঠেকাতে পারে। তাই এ ভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় যারা এরই মধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন বা এই ভাইরাস বহন করছেন তাদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা। বারবার ঘরের বাইরে গেলে মাস্ক পরা এবং বাইরে থেকে এসে সাবান দিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নিতে হবে। জীবিত বা মৃত গৃহপালিত কিংবা বন্য প্রাণী থেকে দূরে থাকতে হবে। হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় অবশ্যই মুখে গামছা বা রুমাল ব্যবহার করতে হবে। এক কথায় করোনা ভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় অন্যের সঙ্গে (মানুষ বা অন্য কোনো প্রাণী) সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা এবং পরিচ্ছন্ন থাকা। 
করোনা ভাইরাস প্রাণঘাতী এবং এর কোনো চিকিৎসা না থাকলেও আশার কথা হলো, যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন আক্রমণ থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারে। শীতের সময়গুলোতে এর সংক্রমণ দ্রুত ছড়ালেও গরম পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সংক্রমণ হার হ্রাস পাবে। ব্যাপক জনসচেনতা, সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ ও সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এই রোগের হাত থেকে রক্ষা পেতে আমরা সফল হবোÑ এমন প্রত্যাশা সবার। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। এদেশে করোনা ভাইরাসের মতো যে কোনো ফ্লু মহামারির রূপ ধারণ করতে পারে। কিন্তু সরকার যথাসময়ে সঠিক পদক্ষেপ ও প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করেছে। এ মুহূর্তে এদেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কোনো সম্ভাবনা নেই এবং এতে আতঙ্কিত হওয়ারও কিছু নেই। প্রয়োজনীয় সতর্কতা, সচেতনতা এবং পরিচ্ছন্ন পরিবেশ করোনা ভাইরাসের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার অন্যতম উপায়। তাই আমাদের সবার উচিত আতঙ্কিত না হয়ে এর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গৃহীত পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করা। 

পিআইডি ফিচার