আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ৫-০২-২০২০ তারিখে পত্রিকা

মাস্কের দাম বেড়েছে

সবার মাস্ক পরার দরকার নেই

করোনা ভাইরাস আতঙ্ক

নেসার উদ্দিন আহাম্মদ
| প্রথম পাতা

দেশে এখন পর্যন্ত কারও মধ্যে নভেল করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়নি। তবে এ ভাইরাসের বিষয় সর্বোচ্চ সর্তক থাকতে হবে। এ নিয়ে আতঙ্ক ছড়ানো যাবে না। এদিকে চীনের উহানের করোনা ভাইরাসের কারণে দেশে মাস্কের দাম অনেক বেড়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে এখনও এ ভাইরাস শনাক্ত হয়নি। তাই এ ভাইরাসের জন্য মাস্ক ব্যবহার করতে হবে না। করোনা ভাইরাসের জন্য সবার মাস্ক পরার দরকার নেই। যদি কারও সর্দি, কাশি এবং জ্বর হয়ে থাকে শুধু তারা মাস্ক ব্যবহার করতে পারেন। সম্প্রতি চীন থেকে আসা ৩৯ জনের নমুনা পরীক্ষা করে কারও শরীরে করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি পায়নি রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)।
আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত কোনো করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়নি। আমরা ৩৯ জনের নমুনা পরীক্ষা করেছি। কিন্তু কারও নমুনায় এ ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। করোনা ভাইরাস নিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভীতি তৈরি হয়েছে। আইইডিসিআরের করোনা ভাইরাস কন্ট্রোল রুমে আগে ৮ থেকে ১০টি ফোন কল এলেও এখন ১২০ থেকে ১৩০টি  ফোন কল আসছে।
তিনি বলেন, নভেল করোনা ভাইরাস সাধারণ ফ্লুর মতো হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়াতে পারে, ছড়াতে পারে মানুষ থেকে মানুষে। করোনা ভাইরাস মূলত শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণ ঘটায়। এর লক্ষণ শুরু হয় জ্বর দিয়ে, সঙ্গে থাকতে পারে সর্দি, শুকনো কাশি, মাথাব্যথা, গলাব্যথা ও শরীর ব্যথা। সপ্তাহখানেকের মধ্যে দেখা দিতে পারে শ্বাসকষ্ট। উপসর্গগুলো হয় অনেকটা নিউমোনিয়ার মতো। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো হলে এ রোগ কিছুদিন পর এমনিতেই সেরে যেতে পারে। তবে ডায়াবেটিস, কিডনি, হৃদযন্ত্র বা ফুসফুসের পুরোনো রোগীদের ক্ষেত্রে ডেকে আনতে পারে মৃত্যু।
নভেল করোনা ভাইরাসের গুজবে আতঙ্কিত না হয়ে ব্যক্তিগত সচেতনতার উপর জোর দেওয়ার জন্য গুরুত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএসএমএমইউর মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, সর্দি, কাশি এবং জ্বর হলেই যে করোনা ভাইরাস তা নয়। তবে আমাদের সর্তক থাকতে হবে। এ জন্য মাস্ক পরার দরকার নেই। দেশে সবাই যদি মাস্ক পরে রাস্তায় ঘুরে তা হলে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে যাবে। এ ভাইরাসের জন্য মাস্ক পরা, শুধু টাকার অপচয়। অধ্যাপক এবিএম আবদুল্লাহ আরও জানান, এরমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, এখন বাংলাদেশ থেকে কেউ চীনে যাবে না এবং চীন থেকে দেশে কেউ আসবে না। তাহলে এ ভাইরাস আসার সম্ভাবনা অনেকটা কমে যাবে। তিনি বলেন, আমাদের দেশের চিকিৎসকরা অনেক দক্ষ। তাই চিন্তার কিছুই নেই। আমরা সবাই সচেতন। একসঙ্গে কাজ করলে অবশ্যই জয়ী হব ইনশাআল্লাহ। এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে ঝুঁকি আছে। যাদের আশকোনা হজক্যাম্পে কোয়ারেন্টাইন করে রাখা হয়েছে, তাদের মধ্যে কেউ আক্রান্ত কি না, তা ১৪ দিনের মধ্যে বোঝা যাবে। অন্যদিকে এখনও নতুন অনেকেই চীন থেকে আসছেন। তাদের কেউ আক্রান্ত কি না, তা জানা নেই। সুতরাং সর্বোচ্চ সতর্কতাই কাম্য।
এদিকে রাজধানীর কয়েকটি ফার্মেসি ও অনলাইন শপিং ওয়েবে গিয়ে দেখা গেছে, ডিস্পোজেবল নন ওভেন ফ্যাব্রিক মাস্ক বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকায়, কটন মাস্ক ১২০ টাকা, স্পঞ্জ অ্যান্টি ডাস্ট মাস্ক ৫০ টাকা, এন-৯৫ (৮২১০) মাস্ক ২৫০ টাকা, এন-৯৫ (৮১১০এস) ১৮০ টাকা, পিএম-২.৫ মাউথ মাস্ক ১২০ টাকা, সাওমি এয়ারপপ থ্রি-সিক্সটি ডিগ্রি অ্যান্টি ফগ মাস্ক ৩৫০ টাকা, সাওমি স্মার্টলি ফিল্টার মাস্ক ৪৫০ টাকা এবং সাওমি পিএম-২.৫ লাইট ওয়েট মাস্ক বিক্রি হচ্ছে ১৭৫০ টাকা।
পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাস্কের চাহিদা বেড়ে যাওয়া, অতি লাভের আশায় মজুদ এবং চীনা নাগরিকসহ অনেকের বেশি পরিমাণে মাস্ক কেনায় মজুদে সংকট দেখা দিয়েছে। এ কারণে দাম বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, যদিও বাংলাদেশে বেশিরভাগ মাস্কের উৎস চীন, কিন্তু এখন উল্টো চীনে পাঠাতে চীনা নাগরিকসহ অনেকে বাজার থেকে প্রচুর মাস্ক কিনেছেন।
রাজধানীর তোপখানা রোডের বিএমএ ভবনের মেডিকেল যন্ত্রপাতির বাজারে গিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ দোকানে মাস্কের খোঁজ করছেন ক্রেতারা। ৫০টি ডিসপোজেবল মাস্কের এক প্যাকেট ৪৮০ টাকা করে পড়েছে বলে জানান তিনি। দেখা যাচ্ছে, আগের যেটা ১ থেকে ৫ টাকা ছিল, সেটা এখন ১০ থেকে ১১ টাকা হয়েছে।
বিএমএ ভবন দোকান মালিক সমিতির সহকারী সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস লস্কর সাংবাদিকদের জানান, ৫০টি মাস্কের প্রতি বাক্স আগে তারা ৬০ টাকা বিক্রি করতেন, এখন সেটা বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায়। তিনি জানান, ‘পিএম ২.৫’ মডেলের যে মাস্ক প্রতিটির দাম আগে ছিল ১৮ থেকে ২০ টাকা, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। দাম বাড়ার বিষয়ে ইলিয়াস বলেন, চীনে পাঠানোর আশায় অনেকে মাস্ক কিনেছে, আবার অনেকে মাস্ক মজুদ করেছেÑ এ কারণে দাম বেড়ে গেছে।
এদিকে ৩০ জানুয়ারি বিদেশে ‘রপ্তানির জন্য’ মাস্ক বিক্রি বন্ধ করতে জরুরি নোটিশ দেয় বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ভবন দোকান মালিক সমিতি। ‘বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসে উদ্ভুত পরিস্থিতির কারণে ফেইস মাস্ক কোনো অবস্থায় মজুদ এবং বেশি মূল্যে বিক্রি করা যাবে না। নোটিশে আরও বলা হয়, দেশি কাস্টমারের কাছে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিক্রয়ের জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে। বিদেশে রপ্তানির জন্য কোনো অবস্থায় বিক্রি করা যাবে না।’
সম্প্রতি করোনা ভাইরাস নিয়ে এক সেমিনারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, চীনে যেসব বিমান প্রবেশ করছে সেই বিমান, পাইলটসহ ক্রুদের অন্য দেশে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। ৩১২ জন যাত্রীকে বিমানে করে ফেরত আনতে খরচ হয়েছে প্রায় আড়াই কোটি টাকা। খরচ ও অনান্য বিষয় বিবেচনা করে ১৭১ জন বাংলাদেশিকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না। তবে তারা যদি ‘স্বাস্থ্য সনদ’ নিয়ে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় দেশে ফেরে তবে আমরা তাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করব। গেল ১০ দিনে পাঁচ হাজার চীনা নাগরিক বাংলাদেশে এসেছে।
জানা গেছে, চীনের উহান শহরে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর করোনা ভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত করা হয়। এরপর এক মাসে ৪২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে, আক্রান্তের সংখ্যা ২০ হাজার ছড়িয়েছে।
মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক সময়ে চীন থেকে আসা ৩৯ জনের নমুনা পরীক্ষা করে কারও শরীরে করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। 
তিনি  জানান, চীনে নতুন ধরনের করোনা ভাইরাসে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকায় দেশটি থেকে যারা ফিরছেন, তাদের সবার ‘হেলথ স্ক্রিনিং’ হচ্ছে বিমানবন্দরে। তাতে জ্বর-সর্দির মতো উপসর্গ যাদের থাকছে তাদের পরীক্ষা করছে আইইডিসিআর। এছাড়া সারা দেশ থেকে কোনো সন্দেহজনক সংক্রমণের তথ্য পেলে তাদেরও পরীক্ষা করা হচ্ছে। 
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ ধরনের ক্ষেত্রে তারা পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (পিসিআর) পরীক্ষা করে নিশ্চিত হচ্ছেন। তারপর নিয়ম অনুযায়ী ওই নমুনা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় পাঠানো হচ্ছে পুনঃপরীক্ষার জন্য। বাংলাদেশে পিসিআর পরীক্ষার সুযোগ আছে কেবল আইইডিসিআরে। সে কারণে কারও মধ্যে সংক্রমণের সন্দেহ দেখা গেলে আইইডিসিআরে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এরমধ্যে ৩১২ জনকে চীনের উহান শহর থেকে ফিরিয়ে এনে ঢাকায় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। এ ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করার পর উপসর্গ প্রকাশ পেতে দুই থেকে ১৪ দিন সময় লাগতে পারে। সে কারণে উহানফেরতদের অন্তত ১৪ দিন পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। 
তাদের মধ্যে দুজনকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে রাখা হয়েছে জানিয়ে অধ্যাপক মীরজাদী ফ্লোরা বলেন, দুজনের মধ্যে একজনের জ্বর। আরেকজনের মাথাব্যথা থাকায় তাকেও সোমবার কুর্মিটোলা হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। যদিও করোনা ভাইরাসের লক্ষণ বা উপসর্গের মধ্যে পড়ে না, তারপরও আমরা সতর্কতা হিসেবে তাকে এখানে রেখেছি। দুজন এখন ভালো আছেন, তাদের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা চলছে।
গেল শনিবার দেশে ফেরা ওই বাংলাদেশিদের মধ্যে তিন পরিবারের আটজন আছেন সিএমএইচে। বাকিদের আশকোনা হজ ক্যাম্পে রেখে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে এবং তারা সবাই ‘ভালো আছেন’ বলে জানান আইইডিসিআরের পরিচালক। তিনি বলেন, করোনা ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কেউ আক্রান্ত হলে আইইডিসিআর তাকে দ্রুত অন্যদের থেকে আলাদা করে ফেলার কৌশল নিয়েছে, যাতে তার কাছ থেকে ভাইরাসটি অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে না পড়ে। এর অংশ হিসেবেই চীনফেরতদের ক্যাম্পে রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশে অবস্থান করা চীনের নাগরিকদের বিষয়ে তথ্য জানাতে ২৯ জানুয়ারি জেলা প্রশাসকদের কাছে একটি নির্দেশনা পাঠিয়েছিল আইইডিসিআর। তাতে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে প্রায় ১০ হাজার চীনা নাগরিক কর্মরত থাকার প্রাথমিক তথ্য পাওয়া গেছে।