কোরআন ও হাদিসের ঘোষণা অনুযায়ী মানবজাতির গোনাহের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মহামারি আপতিত হয়। আল্লাহ তায়ালার আদেশ-নিষেধ লঙ্ঘনের শাস্তিস্বরূপ পৃথিবীতে জীবনবিনাশী শাস্তি ও ধ্বংসাত্মক তা-ব বর্ষণ হয়। ঘোষিত হয়েছে, ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন স্থলে ও জলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে তাদেরকে তাদের কোনো কোনো কর্মের শাস্তি তিনি আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে।’ (সূরা রুম : ৪১)।
নির্দিষ্ট দু-এক ধরনের গোনাহের কারণে শাস্তি হয় বিষয়টি এমন নয়, বরং জীবনধারণের শাখাগত অন্যান্য বিষয়েও আল্লাহর আইনের বিরুদ্ধাচরণ হলে বিপর্যয় ঘটে। যেমন, আমাদের খাদ্য তালিকায় জীবজন্তুর অনেক বড় দখল। সে ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশ হলো, ‘তোমাদের প্রতি হারাম করা হয়েছে মৃত জন্তু, রক্ত, শূকরের গোশত... এবং সেসব পশু যাতে আল্লাহর নাম ব্যতীত অন্য কারও নাম উচ্চারিত হয়েছে।’ (সূরা মায়িদা : ৩)।
উপর্যুক্ত আয়াতে আল্লাহ তায়ালা হালাল-হারাম জন্তু সম্পর্কিত মাসআলা বর্ণনা করেছেন। যেসব জন্তুর মাংস মানুষের জন্য শারীরিক দিক দিয়ে ক্ষতিকর, যেমন দেহে রোগ সৃষ্টি হতে পারে অথবা আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে ক্ষতিকর, যেমন চরিত্র বিনষ্ট হতে পারে; কোরআন সেগুলোকে অশুচি আখ্যা দিয়ে হারাম করেছে। পক্ষান্তরে যেসব জন্তুর মাংসে শারীরিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষতি নেই সেগুলোকে হালাল করেছে। (মাআরিফুল কোরআন, পৃ. ৩০৭)।
আমরা যদি ওই নির্দেশের বিপরীত করি, তাহলে যে কোনো ধরনের ক্ষতি ও শাস্তি আমাদের ওপর নেমে আসতে পারে। সম্প্রতি করোনা ভাইরাসসহ আরও যেসব ভাইরাসের কথা শোনা যাচ্ছে, তার কারণ উল্লেখ করা হয়েছেÑ শূকর, কুকুর, সাপ, বাদুড়, ইঁদুর ইত্যাদি ভক্ষণ। ফলে দেখা যাচ্ছে, কোরআনের জন্তুভক্ষণ নীতি না মানার কারণে এসব নিত্য মহামারি সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে। কোরআনের আদেশ মান্য করার মাধ্যমে আমরা সহজে জীবনহন্তারক এসব মহামারি থেকে পরিত্রাণ পেতে পারি।
অন্য আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘এ সম্পর্কে (কোরআন) যদি তোমাদের কোনো সন্দেহ থাকে, যা আমি আমার বান্দার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, তাহলে এর মতো একটি সূরা রচনা করে নিয়ে এসো। তোমাদের সেসব সাহায্যকারীদেরও সঙ্গে নাও, এক আল্লাহ ছাড়া, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক।’ (সূরা বাকারা : ২৩)।
এই আয়াতে প্রমাণ দেওয়া হচ্ছে, কোরআন আল্লাহ তায়ালার সত্য গ্রন্থ। যারা কোরআনকে আল্লাহ তায়ালার কালাম ও নবি করিম (সা.) এর ওপর অবতীর্ণ সত্য গ্রন্থ বলে বিশ্বাস করতে চায় না, কোরআন সংস্কার করতে চায়, নিজেদের মতবাদ কোরআনে সংযোজন করতে চায়, তাদের প্রতি আল্লাহ তায়ালা নিজেই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই চ্যালেঞ্জে পরাজিত হলে পরিণতি শুভ হয় না। অতীতে কোরআনের প্রতি ঔদ্ধত্যের শাস্তি হয়েছে ভয়ঙ্কর। অতি সম্প্রতি মূলধারার গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, চীনের রাষ্ট্রীয় সংস্থা কর্তৃক কোরআন সংস্কারের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে! এটা মহাশক্তিধর আল্লাহর সঙ্গে ভয়াবহ রকমের ঔদ্ধত্য। এর শাাস্তিস্বরূপ শুধু করোনা ভাইরাস কেন, এর চেয়ে ভয়াবহ আজাবও যদি নেমে আসে, আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। পৃথিবীর যেখানেই এমন অপরাধ সংঘটিত হবে, সেখানেই মহাদুর্যোগ আঘাত হানতে পারে। একথা যত তাড়াতাড়ি আমরা বুঝব, ততই মানবজাতির মঙ্গল হবে।
আবু মালেক আশআরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমার উম্মতের এক শ্রেণির লোক মদের নাম পরিবর্তন করে মদ পান করবে। তাদের মাথার ওপর বাদ্যযন্ত্রের বাজনা বাজতে থাকবে। তাদের শাস্তিস্বরূপ আল্লাহ তায়ালা জমিন ধসিয়ে দেবেন। তাদের বানর ও শূকরে পরিণত করবেন।’ (ইবনে মাজাহ : ৪০২০)।
বোঝা গেল, মানবজাতি যখন অধিক হারে মাদকে ডুবে যাবে, গান-বাজনা ও অশ্লীল কথাবার্তাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দান করবে, তখন আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসতে থাকবে। ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির আগুন, ভাইরাস, মানব বিকৃতির মতো নিত্যনতুন মহাদুর্যোগ আমাদের গোনাহ ও নাফরমানিরই ফল। আস্ট্রেলিয়ার আগুন, ইরান-সিরায়ায় ভূমিকম্প, চীনের ভাইরাস হলো আল্লাহ প্রদত্ত সতর্ক সংকেত। এসব আজাব থেকে পরিত্রাণের একটাই উপায়, গোনাহ ও নাফরমানি ত্যাগ করা। আজ আস্ট্রেলিয়া ও চীন আক্রান্ত হয়েছে, আগামীকাল যে আমরা আক্রান্ত হবো না, সে নিশ্চয়তা কে দেবে? আমাদের দেশে কি গোনাহ কোনো অংশে কম হচ্ছে?
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবি করিম (সা.) আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, ‘হে মুহাজিররা! তোমরা পাঁচটি বিষয়ে পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। তবে আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যেন তোমরা তার সম্মুখীন না হও। যখন কোনো জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে তখন সেখানে মহামারি আকারে প্লেগ রোগের (ইঁদুরের মাধ্যমে) প্রাদুর্ভাব হয়। তাছাড়া এমন সব ব্যাধির উদ্ভব হয়, যা আগেকার লোকদের মধ্যে কখনও দেখা যায়নি। যখন কোনো জাতি ওজন ও পরিমাপে কারচুপি করে, তখন তাদের ওপর নেমে আসে দুর্ভিক্ষ, কঠিন বিপদ মুসিবত এবং যখন জাকাত আদায় না করে, তখন আসমান থেকে বৃষ্টিবর্ষণ বন্ধ করে দেওয়া হয়। যদি ভূপৃষ্ঠে চতুষ্পদ জন্তু ও নির্বাক প্রাণী না থাকত তাহলে আর কখনও বৃষ্টিপাত হতো না।’ (ইবনে মাজাহ : ৪০১৯)। অন্য হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘গোনাহের কারণে মানুষের রিজিক কমে যায়।’ (ইবনে মাজাহ : ৪০২২)।
ফলে আমাদের আত্ম-উপলব্ধি করার সময় এসেছে যে, আল্লাহ প্রদত্ত আদেশ-নিষেধের তোয়াক্কা না করে আমরা কি ইচ্ছামতো মাদক, বেপর্দা, ফরজ বিধান লঙ্ঘন, অশ্লীলতা, গানবাজনা ইত্যাদি জঘন্য গোনাহের ভেতরে ডুবে থাকব, নাকি বর্জন করব? যদি এসব অপকর্মে লিপ্ত থাকি, তাহলে আমাদের অবশ্যই আসমান থেকে বর্ষিত জীবনবিনাশী বিভিন্ন আজাব, দুর্যোগ ও মহামারিতে আক্রান্ত হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। যদি আজাব মোকাবিলার সাহস ও সক্ষমতা আমাদের না থাকে, তাহলে সব ধরনের গোনাহ ও নাফরমানি বর্জন করে আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী জীবনযাপন করাই হবে মানবজাতির জন্য সত্যিকার বুদ্ধিমান ও কল্যাণকর কাজ।