নিজের উচাটান মনকে বাগে আনতে আর আত্মাকে সুদ্ধি করতেই আত্মসুদ্ধির প্রতীক একতারাতেই গানের সুর বাঁধতেন বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁই। ফকির লালন শাহের গান ও একতারার সুর যেন অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই ফকিরিবাদে আর বাউল মতে বাউল গানের মূল মন্ত্রের সুর ও লালন সংগীতের অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে একতারা। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অবশেষে ওই একতারার ভাস্কর্য স্থান পেল কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় লালন সাঁইয়ের আখড়াবাড়ি তার মাজারের সামনে। কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসন ও লালন একাডেমির উদ্যোগে ছেঁউড়িয়া লালন আখড়াবাড়িতে নির্মাণ করা হয়েছে একটি সুবিশাল দৃষ্টিনন্দন একতারা।
‘এখনও একতারায় লালন কথা কয়, অনেকে অনেক বলে, সব কথা কি রাখা যায়; লালন ছিল জ্ঞানের পাখি, গান শুনিয়ে করত সুখী’Ñ একতারা হাতে শিল্পীর এমন গানই বলে দেয় ফকির লালনের কাছে একতারা কত প্রিয় ছিল। একতারা হাতে তিনি দরাজ কণ্ঠে গানে সুর তুলতেন। মাজারের ঠিক সামনে বিশাল আকৃতির এ একতারা নির্মাণের ফলে মাজারের সৌন্দর্য যেমন বেড়েছে, তেমনি দর্শনার্থীর কাছেও বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে।
লালন একাডেমি সূত্র জানিয়েছে, জেলা প্রশাসক ও লালন একাডেমির সভাপতি মো. আসলাম হোসেনের পরিকল্পনায় একতারা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী মাজারের সামনে জায়গা চিহ্নিত করে গেল ডিসেম্বরে শুরু হয় একতারা নির্মাণের কাজ। মাজারের ঠিক সামনেই তৈরি করা হয়েছে বিশালাকৃতির একতারাটি। কুষ্টিয়ার ছেলে জাকারিয়া ইসলাম মিতুল এটি নির্মাণ করেন। পুরো কাঠামো কংক্রিটের ঢালাই দিয়ে তৈরি। ভূমি থেকে কাঠামোসহ একতারাটি ১৬ ফুট লম্বা। লাউ পাকলে যে রং হয়, সেই রং দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে একতারা। এক হাত দিয়ে ধরা একতারা, এক আঙুল তারে রাখা।
লালন একাডেমির অ্যাডহক কমিটির সদস্য সেলিম হক জানান, একতারাটি তৈরি করতে সময় লেগেছে প্রায় ১৫ দিন। লালন একাডেমির সদস্য সচিব সহকারী কমিশনার এবিএম আরিফুল ইসলামের তত্ত্বাবধানেই কাজটি হয়েছে।
আরিফুল ইসলাম বলেন, একতারা বাউল গানের প্রধান অনুষঙ্গ। আর লালন তার গানে একতারায় সুর তুলতেন। একতারা হাতে তিনি গানের মজমা বসাতেন। তাই লালনের সেই স্মৃতিকে ধরে রাখতেই মাজার প্রাঙ্গণে একটি একতারা নির্মাণ করা হয়েছে। এতে সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি দর্শনার্থীরা ঘুরতে এসে আনন্দ পাবেন। একতারা নির্মাণের পর দূর-দূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীরা একতারার সঙ্গে নিজেদের ছবি তুলছেন। মাজারে ঢোকার পরই চোখে পড়ছে দৃষ্টিনন্দন একতারাটি। কয়েকজন দর্শনার্থী বলেন, লালন আখড়ায় এত দিন এ ধরনের কোনো নিদর্শন না থাকায় অনেকটা ফাঁকা ফাঁকা দেখা যেত। একতারাটি লালনকে আরও বেশি করে মনে করিয়ে দিচ্ছে। প্রবীণ বাউল ও লালন অনুসারী বজলু শাহ বলেন, মূলত একতারা দিয়েই গানে সুর তুলতেন লালন। আখড়াবাড়িতে একতারা নির্মাণ করার মধ্য দিয়ে লালন ফকিরের স্মৃতিকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যাবে। লালন একাডেমির সভাপতি জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেন বলেন, ফকির লালন শাহ ও একতারা একে অপরের পরিপূরক। লালনের গানের প্রধান হাতিয়ার ছিল একতারা। এখনও লালন অনুসারীরা একতারা হাতেই গান পরিবেশন করেন। লালনের স্মৃতিকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতেই আখড়াবাড়ি প্রাঙ্গণে একতারা নির্মাণ করা হয়েছে।