আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ৭-০২-২০২০ তারিখে পত্রিকা

রাজশাহীতে পদ্মায় নামতে পারছেন না জেলেরা

রিমন রহমান, রাজশাহী
| শেষ পাতা

নৌ পুলিশের ভয়ে নদীতে নামছেন না জেলেরা। তাই পদ্মাপাড়ে বাঁধা সারি সারি নৌকা। বৃহস্পতিবার নগরীর শ্রীরামপুর এলাকা থেকে তোলা ছবি- আলোকিত বাংলাদেশ

সারি সারি নৌকা তীরে বাঁধা। নৌকার ওপর গুটিয়ে রাখা হয়েছে জাল। কিন্তু জাল-নৌকা নিয়ে নদীতে নামতে পারছেন না রাজশাহীর জেলেরা। তারা জানান, নদীতে নানা রকম ‘অত্যাচার’ শুরু করেছে নৌ পুলিশ। বাছবিচার ছাড়াই পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে জাল। আর নৌকা ধরে আদায় করা হচ্ছে টাকা। নৌ পুলিশের এমন ‘অত্যাচারে’ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন পদ্মার জেলেরা। তাই নদী থেকে ওঠে গেছেন অনেকে। পদ্মা পাড়ে বসে নদীর দিকে তাকিয়ে তারা দীর্ঘশ^াস ফেলেছেন। এ অবস্থায় বন্ধ হয়ে গেছে তাদের আয়-রোজগার। সমাধান পেতে গেল প্রায় ১০ দিন ধরে জেলেরা দল বেঁধে ছুটছেন এখানে-ওখানে।
রাজশাহী নগরীর টি-বাঁধ সংলগ্ন এলাকায় বুধবার সকালে নদীপাড়ে বসেছিলেন কয়েকজন জেলে। তাদের একজন মনোয়ার আলী। তিনি জানান, আগে নদীতে দাপট দেখাত ভারতের বিএসএফ। বিজিবিও গিয়ে মারধর করত। এখন গায়ের জোর দেখাচ্ছে নৌপুলিশ। এতে আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি। আরেক জেলে জাহাঙ্গীর আলম জানান, ভারতের জেলেরা কারেন্ট জাল দিয়েই মাছ মেরে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা সুতি জাল দিয়েও মাছ ধরতে পারছি না। নৌ পুলিশ যা পাচ্ছে, তাই ধরে আনছে।
রাজশাহীতে নৌ পুলিশের যাত্রা শুরু হয়েছে, গেল বছরের জুনে। এরপর থেকে তারা নদীতে অভিযান চালাচ্ছে। সম্প্রতি অভিযান জোরদার করা হয়েছে। গেল ২৮ জানুয়ারি প্রায় ৯৫ লাখ টাকা মূল্যের ৩ লাখ ২০ হাজার মিটার জাল জব্দ করে পুড়িয়ে দেওয়া হয় ভ্রাম্যমাণ আদালতে। ৩১ জানুয়ারি প্রায় দেড় কোটি টাকা মূল্যের ৫ লাখ মিটার জাল জব্দ করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। নৌ পুলিশ বলছে, এসব জাল নিষিদ্ধ। তবে জেলেরা বলেন, শুধু কারেন্ট জাল নিষিদ্ধ। কিন্তু নৌ পুলিশ যা পাচ্ছে, তাই জব্দ করে পুড়িয়ে দিচ্ছে।
রাজশাহীর পদ্মা নদীর উপকূলীয় কার্ডধারী ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি বেনু হালদার বলেন, নৌ পুলিশ আসার পর থেকে অনেক জেলে নদী থেকে ওঠে গেছে। তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এখনও যে কিছু জেলে মাছ ধরছেন তাদের কাছে নৌ পুলিশ গিয়ে বলছে, শেয়ার করো, সম্পর্ক ভালো করো। তিনি বলেন, সারা দিন-সারারাত মাছ ধরে ৪০০ টাকার মাছ হয়। এর মধ্যে আবার জেলেরা শেয়ার করবে কী! আর নিজেদের সংসারই বা চালাবে কী করে! আমরা খুব বিপদে পড়েছি।
নবগঙা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আয়নাল হক নৌ পুলিশের বিরুদ্ধে শোনালেন আরও বড় অভিযোগ। তার দাবি, জালসহ নৌকাও জব্দ করে নৌ পুলিশ। এরপর নৌকা ছেড়ে দেওয়ার জন্য আদায় করা হয় টাকা। সম্প্রতি নৌকা ছাড়ার জন্য নবগঙা এলাকার জেলে দেলোয়ার হোসেনের কাছ থেকে ৭ হাজার, পবা উপজেলার বেড়পাড়া এলাকার রুবেল হোসেনের কাছ থেকে ৪ হাজার এবং একই এলাকার জেলে সাজদার আলীর কাছ থেকে ৭ হাজার টাকা আদায় করা হয়েছে। আর টাকার জন্য নবগঙার জেলে বরজাহান আলীকে তিন দিন ঘোরানো হয়েছে। কিন্তু বরজাহান টাকা দিতে পারেননি। তিন দিন পর অবশ্য টাকা ছাড়াই বরজাহান আলীর নৌকা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
নগরীর শ্রীরামপুর এলাকার জেলে পাতান আলী বলেন, কারেন্ট জালে মাছ ধরা নিষেধ। এ কারণে বেশিরভাগ জেলেই কারেন্ট জাল ব্যবহার করা বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন সুতি জালের ব্যবহার চলছে। কিন্তু নৌ পুলিশ গেলে কোনো বাছবিচার নেই। নৌকায় যে জালই পান না কেন, নৌ পুলিশের সদস্যরা নিয়ে এসে পুড়িয়ে দিচ্ছেন। তাহলে জেলেরা মাছ ধরবেন কী দিয়ে? সংসার চলবে কীভাবে!
একই এলাকার জেলে উত্তম কুমার দাস নদীর পাড়ে বসে সুতি জাল বোনাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, এটা সুতি জাল। কিন্তু নৌ পুলিশ এসে বলবেÑ এর ফাঁদ এত ছোট কেন? কোনো জালই তাদের কাছে বৈধ না। তিনি বলেন, শীতে পদ্মায় পিয়ালি, বাসপাতা, খয়রা ও বাছা মাছ পাওয়া যায়। এসব মাছ বড় হয় না। এগুলো ধরতে হলে জালের ফাঁদ ২ ইঞ্চির ভেতরে থাকতে হয়। কিন্তু সুতি জালেও এগুলো ধরতে পারছেন না তারা। উত্তম অভিযোগ করেন, কারেন্ট জালের পাশাপাশি সুতি জালও ধরে পুড়িয়ে দেওয়া হলেও মশারির মতো কারেন্ট জাল দিয়ে তৈরি বেড় জাল নদীতে আছেই। অভিযান শুরুর আগে বেড় জালের জেলেদের ফোন করে সরে যেতে বলা হয়। এদের ধরা হয় না। বেড় জালে একসঙ্গে অনেক মাছ ধরা পড়ে। বেড় জালের জেলেদের সঙ্গে নৌ পুলিশের সম্পর্ক ভালো বলেও দাবি করেন তিনি।
শ্রীরামপুর ঘাটে বেঁধে রাখা নৌকা দেখিয়ে বহরমপুর এলাকার জেলে চাহার উদ্দিন বলেন, এই যে তিন মাস ধরে নৌকা বেঁধে রেখেছি। নদীতে নামছি না। মা বলেছেন, একটাই ছেলে আমার। পুলিশ ধরে জেল-জরিমানা করবে। মাছ ধরার কোনো দরকার নাই। অন্য কাজ কর। আমি এখন চিংড়ি মাছ ধরার চাঁই বানাচ্ছি। আমার মতো রাজশাহীর প্রায় ২ হাজার জেলে এখন আতঙ্কে। ভয়ে তারা নদীতে নামছে না।
জেলেরা জানিয়েছেন, নৌ পুলিশের এমন অভিযান শিথিল করার দাবিতে তারা রাজশাহী মহানগর পুলিশের কমিশনারের কাছে লিখিতভাবে আবেদন করেছেন। বিষয়টি পবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকেও লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও বিষয়টি জানিয়ে সমাধান করে দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। এছাড়া অভিযোগ জানাতে বৃহস্পতিবার তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছিলেন প্রায় অর্ধশত জেলে। মন্ত্রী এ দিন জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে দলীয় একটি সভায় যোগ দিয়েছিলেন। সেখানেই যান জেলেরা। তবে মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়নি।
বিষয়টি নিশ্চিত করে নবগঙা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আয়নাল হক বলেন, আমরা জেলেরা তো অসহায় হয়ে পড়েছি। কারেন্ট জাল পোড়ালে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু সুতি জালও পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে কেন? আর নৌ পুলিশ সম্পর্ক ভালো করতে বলছে। এ কথার অর্থ কী? তিনি বলেন, আমাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। এমন ‘অত্যাচার’ আর কত দিন! আমরা তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছিলাম। দেখা হয়নি। শুক্রবার আমরা সভা করে করণীয় ঠিক করব। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী নৌ পুলিশের পরিদর্শক মেহেদী মাসুদ বলেন, জেলেরা ১৬ ধরনের জাল ব্যবহার করতে পারবেন না। জালে তাদের ফাঁদের আকার হতে হবে দেড় ইঞ্চির বেশি। তাও আমরা ১ ইঞ্চি পর্যন্ত ছাড় দিই। এর কম হলে জব্দ করা হয়। তিনি দাবি করেন, জালসহ নৌকা ধরা হলে সেটা জব্দ করারই নিয়ম। ‘মানবিক’ দিক বিবেচনায় নৌকা তারা ছেড়ে দেন। এক্ষেত্রে কোনো টাকা-পয়সা আদায় করা হয় না। জেলেদের এমন অভিযোগ মিথ্যা বলেও দাবি করেন তিনি। জেলা প্রশাসক হামিদুল হক বলেন, অভিযোগের বিষয়টি তিনিও শুনেছেন। জাল পোড়ানোর সময় যেন নিশ্চিত হয় এটা কারেন্ট জাল তার জন্য অভিযানে মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তাকে নেওয়ার জন্য তিনি নৌ পুলিশকে নির্দেশনা দিয়েছেন। আর জেলেরা তার সঙ্গেও দেখা করতে পারেন। মানবিক দিক বিবেচনায় তিনি বিষয়টি দেখবেন।