আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ৯-০২-২০২০ তারিখে পত্রিকা

বই মানুষকে জ্ঞানী করে, সমৃদ্ধ করে

আফতাব চৌধুরী
| সম্পাদকীয়

একটি বই জীবনে চলার পথের জ্ঞান ভাণ্ডারের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সাত রাজার ধন মানিক। শৈশবে পড়া যে কোনো বইয়ের মাধ্যমে ভবিষ্যতে কেউ বা অদৃশ্য মন্ত্র বলে আলাদিনের প্রদীপের সন্ধানও পেয়ে যেতে পারেন। বই পড়ার সঠিক সময় ছেলেবেলাই। তখন থেকেই পাঠক মানসিকতা হাঁটি হাঁটি পায়ে পায়ে এগোয়। স্পষ্টভাবে বলা যায়, প্রতিটি মানুষের অভাবিত সাফল্যের পেছনে থাকে শৈশবে পড়া কোনো বই। বলা যায়, প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে পাকানোর কাজ করে দেয়, কখনও আত্মস্থ করে নেওয়া বিশ্বসাহিত্য সম্ভারের অসংখ্য গ্রন্থ।
অক্ষরের সঙ্গে পরিচিতির পর মানুষ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নয়া তথ্য আবিষ্কারে উৎসাহী হয়ে এক সময়ে গ্রন্থকীট বা বইপোকা হয়ে ওঠে। বর্তমানে প্রতিটি মানুষ কম-বেশি বইয়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। জীবশ্রেষ্ঠ মানুষের বই পড়ার স্পৃহা থেকেই অসংখ্য বইয়ের জন্ম হচ্ছে। 
বই মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গী। বই মানুষকে হাসায়, বই মানুষকে কাঁদায়ও। বই অনেকের অবসরের সঙ্গী হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অবশ্য সব মানুষ যে বই পড়েন, তাও নয়। অনেক শিক্ষিত মানুষ আছেন যারা বই পড়া কষ্টকর বলে মনে করেন। বই পড়ার হ্যাপা পোহাতে চান না। বই পড়ে সময় নষ্ট না করে অনেকেই অবহেলায় গান শুনে বা টিভি দেখে সময় নষ্ট করেন। তারা বলেন, বই পড়া কঠিন কাজ। কেউ কেউ আবার বই নিজে না পড়লেও অন্যকে পড়ার মতো সুপরামর্শ দিয়ে থাকেন। 
বইয়ের ক্ষমতা অসীম। একটি বই মানুষের সুখ-দুঃখ ভাগ-বাটোয়ারা করে নিতে পারে। নিঃসঙ্গ মুহূর্তে একটি বই হাতে তুলে নিয়ে অসংখ্য তথ্য জীবন্তরূপে সামনে ধরা দেয়।
বহু ছাত্রছাত্রী বিএ, এমএ প্রভৃতি চূড়ান্ত পরীক্ষা দেওয়ার জন্যই বই পড়ে। কিন্তু অনেক সময় পরীক্ষার পরও বইয়ের জাদুকরী আকর্ষণী শক্তির কাছে হার মেনে যায়। নিজের অজান্তেই মনের খোরাক জোগাতে হাতে তুলে নেয় বই।
বইকে দুই ভাগে ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে। মনোরঞ্জক-জ্ঞানদায়ক। স্কুল-কলেজের পাঠক্রমের বই মানুষ সব সময় পড়ে না। কারণ রসিক পাঠক এতে চাহিদা অনুযায়ী রস খুঁজে পান না। এতে থাকে তত্ত্বকথা। এ তত্ত্বকথা আয়ত্ত করে নিতে হলে গভীর মনোসংযোগের প্রয়োজন। অন্যদিকে মনোরঞ্জনধর্মী বই অক্ষরের সঙ্গে পরিচিত সবাই পড়তে পারে। মানুষের রুচির ওপর নির্ভর করে তার বই পড়ার পছন্দ। অবশ্য কিছুসংখ্যক মানুষ আছে, যারা সব ধরনের বই পড়েন। 
বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে থাকা মানুষের সংখ্যাও খুব একটা কম নয়। বইপড়াও এক ধরনের নেশা। বইপোকা ধরনের কিছুসংখ্যক পাঠক আছে, যারা পরিত্যক্ত কাগজের টুকরোও না পড়ে ফেলে দেয় না। কী জানি এ বর্জ্য কাগজের টুকরো থেকে নতুন কোনো তথ্য আবিষ্কার করা যায় কিনা, তাই!
বই যে শুধু নিঃসঙ্গতার বোঝা-বেদনাকে কম করে তা নয়, মানুষের ব্যাপ্তি বাড়ায়। অন্যদিকে অধ্যয়নে ব্যস্ত থাকার ফলে মানুষ পরনিন্দা, পরচর্চা, হিংসা-দ্বেষ থেকে সরে এক সময় সমাজের প্রিয়পাত্র হয়ে পড়ে। বইপড়া মানুষের বইয়ে অমনোযোগী ব্যক্তি থেকে জ্ঞান বিস্তৃত ও গভীর হয়। কী ধরনের বই পড়া প্রয়োজন এ সম্পর্কে শার্লক হোমস বলে গেছেন,  ‘It is a great thing to start life with a small number of really good books which are your very own.Õ
এছাড়াও কী ধরনের বই মগজে সংরক্ষণ করে রাখতে হয় বা কী বই ওপরে ওপরে পড়লেও চলে, সে প্রসঙ্গে বেকনের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য, ‘Some books are to be tasted, others to be swallowed and some few to be chewed and digested.’  স্যামুয়েল জনসন বলে গেছেন, মনকে যে বই আকর্ষণ করবে, তা-ই পাঠের দরকার। কারণ কোনো বই বাধ্যতামূলকভাবে পড়তে দিলে তা থেকে রসাস্বাদন করা যায় না।
বইয়ের প্রেমে পড়ায় যেমন আনন্দ আছে, তেমনি আছে দুঃখ। পছন্দমতো বই হাতের মুঠোয় এলে মন আনন্দে মেতে ওঠে। বইপড়া প্রসঙ্গে একটি কথা বলা যেতে পারে, বইং পড়তে নিয়ে ফেরত না দেওয়া মানুষের সংখ্যা কিন্তু কম নয়, আমিও কিন্তু এ থেকে বাদ নই। এই মনোবৃত্তির মানুষের মধ্যে কিন্তু বহু কিছু উচ্চশিক্ষিত মানুষ আছেন। সেজন্য বিভিন্ন সময়ে মনীষীরা বলেছেন, বই ধার দেওয়া মানুষ বই চোর থেকেও বেশি মূর্খ। কারণ নিজের বোকামির জন্য অনেক সময় দুষ্প্রাপ্য বহু মূল্যের বই হাতছাড়া হয়ে যায়। কোনো কোনো মানুষের ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার সরকারি কোনো লাইব্রেরি বা কোনো ব্যক্তিবিশেষের বইয়ে ভর্তি থাকে। 
আবার অভিজাত শ্রেণির কোনো বাড়িতে সুদৃশ্য কাচের দেয়ালে সুশোভিত থাকে বিভিন্ন বইয়ের স্তূপ অন্য কারণে। বৈঠকখানাকে মহার্ঘ্য করে তুলতে তাদের কাছে বইয়ের জুড়ি নেই। বই তাদের কাছে দামি পেইন্টিং, আসবাবপত্রের মতো। বই ড্রইংরুমের শোভাবর্ধক। অবশ্য এর একটা ইতিবাচক দিক রয়েছে। বিভিন্ন ভল্যুমের বই কিনে তারা প্রকারান্তরে লেখক, প্রকাশক তথা গ্রন্থপিপাসুদের কল্যাণ সাধন করছেন।
বইয়ের জগৎ বিশাল বিস্তৃত। এ জগতে রাজত্ব চালিয়ে যাওয়া চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। বইয়ের ব্যাপারে প্রবল উৎসাহী মানুষ কিছু ভালো বই আত্মস্থ করে নেয়। আজকাল বাজারে প্রচুর বই কিনতে পাওয়া যায়। মাতৃভাষা ছাড়াও বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন প্রকাশকের বই বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। অনূদিত বই অনেক সময় মনের জগতের ব্যাপ্তি বাড়িয়ে তোলে। সাহিত্যের জন্মলগ্ন থেকে কত শত বই প্রকাশের আলো দেখছে।
বিশ্ব সাহিত্যের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রাংশ পড়তে হলেও এক জীবন যথেষ্ট নয়। কারণ মানুষ তার মৌলিক প্রয়োজন ছেড়ে শুধু বই পড়া নিয়ে বসে থাকতে পারে না। তাই জীবনের ক্ষণস্থায়িত্বের কথা বিচারে সময়ের সদ্ব্যবহার করেই বই পড়া একান্ত প্রয়োজন। 
উল্লেখ্য, বর্তমান প্রজন্ম ধীরে ধীরে বই থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। কোনো এক মনীষী বলেছিলেন, সক্রিয় অভ্যাসকে উৎসাহ দিতে হবে, নিষ্ক্রিয়কে নয়। ছেলেমেয়ের জীবন গড়ার ক্ষেত্রে অভিভাবকের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। এসব অভিভাবকের উদ্দেশ্যে বারবারা বুশ বলেছেন, ছেলেবেলা থেকে শিশুদের যে কোনো ভালো কিছু পড়ে শোনাতে হবে। তখনই একজন স্বার্থক অভিভাবকের দায়িত্ব পূরণ হবে। অভিভাবকরা এভাবেই ছেলেমেয়ের শিশুকাল থেকে অধ্যয়নমুখী করে গড়ে তুলতে পারেন; এতে ভবিষ্যতে এরা সহপাঠীদের ছাড়িয়ে অনেক দূর চলে যাবে।
অভিভাবকদেরই পড়ার প্রকৃত পরিবেশ গড়ে তুলতে হয়। অসংখ্য মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তের বাজেটের দিকে লক্ষ্য রেখে বলা যায়, শুধু ইচ্ছা থাকলে প্রত্যেক অভিভাবক বইয়ের জন্য মাসে ৪০ থেকে ৫০ টাকা খরচ করতে পারেন। অত্যাধুনিক চাল-চলনে-বলনে আগ্রহী ছেলেমেয়েদেরও বইপড়ার জন্য নিজস্ব এক জগৎ গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য তাদের অভিভাবকদেরও এগিয়ে আসতে হবে। শিশুর চরিত্র গঠনে মায়ের আঁচলে মুখ গুঁজে একটি শিশু আগ্রহের সঙ্গে বিশ্বের অনেক কিছু শিখে নেয়। তাই মায়ের কোলের উৎকর্ষতায়ই শুরু হয়ে যাক জীবনের চলার পথ মসৃণ করে তোলার প্রাক-পঠন। হ

 আফতাব চৌধুরী
সাংবাদিক কলামিস্ট