আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ১১-০২-২০২০ তারিখে পত্রিকা

শিশুদের স্ক্রিন আসক্তি ও প্রতিরোধে করণীয়

অধ্যাপক (ডা.) মনজুর হোসেন
| সুস্থ থাকুন

 

বর্তমান প্রযুক্তির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও আধুনিক অনুষঙ্গ মোবাইল ও ভিডিও গেমস। কিন্ত সম্প্রতি প্রযুক্তির এই উন্নয়ন শিশুদের জন্য কল্যাণকর না হয়ে অনেক ক্ষেত্রে শিশুদের মারাত্মক আসক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আর এ আসক্তির কারণে কিছু ক্ষতিকর দিকও ইদানীং উন্মোচিত হচ্ছে বড় আকারে। শিশুদের মোবাইল ও মোবাইলের গেমসের প্রতি প্রচণ্ড আসক্তির কারণে কোমলমতি শিশুদের মানুসিক অবস্থা বা আচরণগত বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিচ্ছে। অবশ্য এর অনেক কারণও আছে। সন্তানদের প্রতি বাবা-মায়ের সময় না দেওয়া। বাবা-মা ব্যস্ত থাকেন চাকরি বা ব্যবসার কাজে। কিছু বাবা-মা তার চঞ্চল শিশুকে অন্য কোনো উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে অগত্যা মোবাইল দিয়ে বসিয়ে দেন। আবার অনেক মা তার সন্তান খেতে না চাওয়ায় মোবাইল ফোন দেখতে দেন। তারা ইউটিউবে গান শুনতে শুনতে, কার্টুন দেখতে দেখতে খায়। সুতরাং অভিভাবক নিশ্চিন্ত হন অর্থাৎ বিনা ঝামেলায় বাচ্চারা এখন পেটপুরে খায়।
এভাবেই বাবা-মায়েরা সন্তানকে শান্ত রাখতে তাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন স্মার্টফোনসহ নানা ধরনের দামি ট্যাব। এতে একদিকে যেমন বাবা-মায়েরা নিশ্চিন্ত হচ্ছেন, অন্যদিকে তেমনি তারা এটাকে আভিজাত্যের অংশ মনে করেন। আবার অনেকেই আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন কারণ তার সন্তান ইন্টারনেট থেকে সব তথ্য, অ্যাপস ডাউনলোড করতে পারে এবং খুব ভালো গেইম খেলতে পারে।
তবে চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে ভিন্ন কথা। বিজ্ঞানের দাবি, শিশুদের হাতে মোবাইল ফোনসহ কোনো ইলেকট্রনিক্স ট্যাব বা গেজেট দেওয়া উচিত নয়। এতে নানা রোগের জন্ম হয় শিশুদের শরীরে।
 আধুনিক বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ প্রযুক্তি মোবাইল ফোন যতটা মানব সভ্যতাকে বিকশিত ও সহজতর করেছে তার চেয়ে কেড়েও নিয়েছে কিছু। মোবাইলে প্রচুর কথা বলার কারণে কানের নানা সমস্যা হচ্ছে। শিশুরা মোবাইলে আসক্তি হওয়ার কারণে চোখের সমস্যা হচ্ছে। মোবাইল শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। মোবাইল ফোন থেকে নির্গত রশ্মি শিশুদের দৃষ্টিশক্তির ভীষণ ক্ষতি করে। যেসব শিশুরা দৈনিক পাঁচ-ছয় ঘণ্টা মোবাইল ফোনে ভিডিও গেম খেলে, খুব অল্প বয়সে তারা চোখের সমস্যায় পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক গবেষণায় দেখা যায়, ১১ বছর বয়সি শিশুদের প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৭০ জন মোবাইল ফোন নিয়মিত ব্যবহার করে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ÔWe are socialÕ I ÔHut Suit নামক প্রতিষ্ঠানের করা এক গবেষণা প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, ‘ভারত ও তার আশপাশের রাষ্ট্রগুলোতে মোবাইল ফোন ব্যবহারের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। চীনের মতো প্রযুক্তিবান্ধব রাষ্ট্রে যেখানে শিশুরা দৈনিক ২ ঘণ্টা মোবাইল ফোনে ব্যবহার করে, সেখানে ভারত ও তার আশপাশের রাষ্ট্রগুলোতে শিশুরা গড়ে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে।
বাংলাদেশেও শিশুরা প্রচণ্ডভাবে মোবাইলের প্রতি আসক্তি হয়ে পড়েছে। এতে শিশুদের সামাজিক আচার-আচরনের ছন্দপতন হওয়া ছাড়াও তৈরি হচ্ছে শিশুদের নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা। এছাড়া প্রযুক্তির এ আসক্তি শিশুদের জীবনে বড় ধরনের দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাবও ফেলছে। আবার দীর্ঘ সময় বসে থাকতে শিশুর স্থূলতাও বেড়ে যাচ্ছে, কমে যাচ্ছে শিশুর কল্পনাশক্তিও।’
শিশুদের অতিরিক্ত ফোন আসক্তির কারণে শিশু পরিবারের সঙ্গে গল্প-গুজব করা, সাহায্যের প্রয়োজনে এগিয়ে যাওয়া, সবার সঙ্গে মিশতে পারার দক্ষতা ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলে। এই চিত্র  শহরে বেশ লক্ষ্যণীয়।
তবে এই ক্ষেত্রে গ্রামীণ শিশুরাও পিছিয়ে নেই; যদিও সেখানে ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক তেমন সক্রিয় না থাকায় শিশুরা অ্যাপস ডাউনলোড সবসময় না করতে পারলেও মোবাইলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গেইম খেলা, গান শোনা, কার্টুন দেখার প্রতি আসক্তি দেখা যায়। ফোনে নিত্যনতুন ভিডিও গেইম পাওয়ার ফলে মাঠে খেলার প্রতি আগ্রহ তেমন দেখা যায় না।
এর ফলে তাদের মধ্যে একঘেয়েমিতা লক্ষ্য করা যায় এবং সামাজিকতা তেমন বৃদ্ধি পায় না। কিন্তু শিশুর জন্য খেলাধুলা খুবই জরুরি। খেলাধুলার মাধ্যমেই শিশুদের দৈহিক বৃদ্ধি ও গঠন সৃজনশীলতা, ভাষার দক্ষতা, সামাজিকতা, কল্পনাশক্তি বাড়ে এবং সমবয়সিদের সঙ্গে মেলামেশার ক্ষমতা এর মাধ্যমে সক্রিয় হয়ে ওঠে। এছাড়া শিশু মাঠে বা পরিবারের খেলার মাধ্যমে যেমনÑ আনন্দ, আরাম পাবে এবং অনুমান ক্ষমতা বাড়বে; সেসঙ্গে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে হৃদ্যতা, সহমর্মিতা, সহানুভূতি বাড়বে এবং সহপাঠীদের সঙ্গে খেলার মাধ্যমে মতবিনিময়, মতামত, অন্যের কথাকে শ্রদ্ধা, সম্মান দিতে শিখবে।
শহরে খেলার মাঠের সংকট। তাই শহরে শিশুরা প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে যায়। তবে এ ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। সৃজনশীল নানা ধরনের খেলার মাধ্যমে শিশুর খেলার সঙ্গী হতে পারে। এতে শিশু এবং পরিবারের একে অপরের প্রতি মমত্ববোধ অধিকতর দৃঢ় হবে। এ ব্যাপারে বাবা-মায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। পরিশেষে আজকের শিশুরা আগামী দিনের বাংলাদেশ গড়ার কারিগর হয়ে উঠবে এ প্রত্যাশা করি।

অধ্যাপক (ডা.) মনজুর হোসেন
শিশুরোগ ও শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ
সাবেক পরিচালক, শিশু হাসপাতাল
ডা. মনজুরস চাইলডস কেয়ার সেন্টার
ধানমন্ডি, ঢাকা-১২০৯
মোবাইল-০১৭১১৪২৯৩৭৩