২০০৭ সালের পাহাড় ধসে ১২৭ জনের মৃত্যুর পর গঠিত কমিটির ৩৬টি সুপারিশ প্রয়োজনে আলাদা সেল গঠন করে অনতিবিলম্বে বাস্তবায়ন করতে হবে। সরকারের নির্দিষ্ট সংস্থার দায়িত্ব পাহাড়ের কোলে আশ্রয় নেওয়া মানুষের জীবন রক্ষা তথা পরিবেশ রক্ষাকারী পাহাড় ও
পাহাড় এলাকাকে সংরক্ষণ করা
চারদিকে পরিবেশ বিধ্বংসী নানা কর্মকাণ্ডের মাঝে পাহাড় কাটা আবার আলোচনায় এসেছে। সম্প্রতি পাহাড় কাটার আয়োজনের অভিযোগ উঠেছে খোদ চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। সিডিএ একটি সড়কের জন্য অন্তত ১৫টি পাহাড় নিধনের আয়োজন করেছে বলে জানা গেছে। এর আগেও চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের পার্বত্য এলাকায় একশ্রেণির প্রভাবশালী মহল প্রতিনিয়ত পাহাড় কেটে চলেছে সব আইন-কানুন উপেক্ষা করে। পাহাড় কেটে মাটি লুট করা হচ্ছে। কাটা পাহাড়ের গায়ে গড়ে তোলা হচ্ছে হাজার হাজার অবৈধ বাড়িঘর। এর আগে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের আবাসিক হোটেল-মোটেল জোনসংলগ্ন কলাতলী সৈকতপাড়ায় সরকারি পাহাড় কেটেও বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। শহরের লাইটহাউস পাহাড়, আদর্শ গ্রাম, পাহাড়তলী, জাদিরাম পাহাড় এবং হিলটপ সার্কিট হাউস পাহাড় কেটেও তোলা হয়েছে অসংখ্য ঘরবাড়ি। চট্টগ্রামের পাহাড়তলী এবং ষোলশহর এলাকার ১৫০ একর পাহাড়ের জমি কেটে নির্মিত হয়েছে আধুনিক ভবন। বন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, শহরের প্রায় ৭০০ একরের ছোট-বড় ১২টি পাহাড়ে বর্তমানে ২০ হাজারের বেশি অবৈধ বাড়িঘর রয়েছে এবং সেখানে কমপক্ষে আড়াই লাখ মানুষ বাস করছে। শহরের শান্তিনগর পাহাড় এলাকায় ৫০০ একর জমি কেটে নির্মাণ করা হয়েছে ঘরবাড়ি। নাসিরাবাদ এলাকা থেকে সীতাকুণ্ডু পর্যন্ত ৭ থেকে ৮ কিলোমিটার এলাকা পাহাড়শূন্য হয়ে পড়েছে। সীতাকুণ্ডে পাহাড় কেটে প্রায় ৯০০ একর জমিতে বস্তি ও বাড়িঘর তৈরি করা হয়েছে। ২০১৩ সালের জরিপ অনুযায়ী, রাঙ্গামাটি শহরের ৩২ স্পটে পাহাড়ের ঢালে প্রায় অর্ধলাখের মতো মানুষ অপরিকল্পিতভাবে বাড়িঘর নির্মাণ করে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করছে। গেল ২০ বছরে চট্টগ্রামে ২ হাজার একরেরও অধিক ভূমির পাহাড় কেটে ফেলা হয়েছে। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের প্রতীক পাহাড় আজ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
পাহাড় কাটার ফলে জীববৈচিত্র্য হচ্ছে হুমকির সম্মুখীন, বন্যপ্রাণী হারাচ্ছে আবাসস্থল। প্রকৃতি হয়ে পড়ছে ভারসাম্যহীন। এর আগে বান্দরবানে সেনা রিজিয়নের পাশেই নির্বিচারে পাহাড় কাটা হয়েছে। কখনও ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে পাহাড় ও টিলা লিজ দেওয়া হয়েছে। বিগত কয়েক যুগ ধরে পাহাড় কাটার পাশাপাশি পাহাড়ের গায়ে বেড়ে ওঠা নানা প্রজাতির বৃক্ষরাজিকে নির্বিচারে ধ্বংস করে সমতল ভূমিতে মুনফালোভী সিন্ডিকেট গড়ে তুলছে আবাসিক প্লট ও অভিজাত ফ্ল্যাট। নিম্নআয়ের হতদরিদ্র, ছিন্নমূল জনগোষ্ঠীর জন্য পাহাড়ের গায়ে গড়ে তুলছে বস্তি। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার পরিবারকে টাকার বিনিময়ে সেখানে ঠাঁই দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘকাল ধরে পাহাড় কাটা এবং পাহাড়ের গায়ে বেড়ে ওঠা গাছপালা উজাড়ের ফলে পাহাড়ের অবশিষ্ট মাটি আলগা হয়ে যায়। বৃষ্টি হলে পাহাড়ের গা বেয়ে তীব্রবেগে নেমে আসা ঢল আলগা মাটি ধুয়ে নিয়ে নিচে নামার ফলে পাহাড় হয়ে পড়ে দুর্বল, জীর্ণশীর্ণ। পাহাড় কাটার ফলে ভূমিধস ছাড়াও মাটির অনুজীব বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ধীরে ধীরে হারাতে থাকে প্রাকৃতিক পরিবেশ ভারসাম্য। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত পাহাড়ের মালিকানা ভূমি মন্ত্রণালয়ের। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় বনজসম্পদ রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত। পাহাড় এলাকায় বাড়িঘর নির্মাণের নিয়ন্ত্রণ পূর্ত মন্ত্রণালয়ের ওপর ন্যস্ত। এদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা সুযোগ করে দিয়েছে নির্বিচারে পাহাড় কাটা, পাহাড়ের গায়ে বেড়ে ওঠা গাছপালা উজাড় করে দালানকোঠা, বস্তি নির্মাণের ক্ষেত্র। পাহাড় কাটা, পাহাড় কেটে অবৈধ বাড়িঘর নির্মাণ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধি ১৯৯৫-এর ১৫ ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং এর জন্য রয়েছে শাস্তির বিধান। কিন্তু পাহাড়খেকোরা বরাবর রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। নেওয়া হয়নি তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। তাই পাহাড় কাটা, বসতি স্থাপনও থেমে থাকেনি। পাহাড় ধসে মৃত্যু যেন হয়ে গেছে এক স্বাভাবিক ঘটনা।
পাহাড় কাটার ফলে পাহাড় ধসে মৃত্যুও কিছুতে ঠেকানো যাচ্ছে না। বর্ষকাল এলেই চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, কক্সবাজার ও বান্দরবানের মতো পাহাড় এলাকায় মৃত্যু-বিভীষিকা নেমে আসে। প্রবল বর্ষণে প্রায়ই ঘটে পাহাড় ধসের মতো ঘটনা। আর পাহাড়ের মাটি চাপা পড়ে ঢালে বসবাসকারী মানুষের করুণ মৃত্যু ঘটে। ২০১৭ সালে প্রবল বর্ষণের ফলে পাহাড় ধসে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, রাঙ্গুনিয়া, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, কক্সবাজার, বান্দরবান ও সিলেটের মৌলভীবাজারে দফায় দফায় পাহাড় ধসে পড়ে শতাধিক মানুষ মারা যান। ২০১৫ সালে পাহাড়ের মাটি ধসে পড়ে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও রামুতে নারী ও শিশুসহ ৩০ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০০৭ সালের ভারী বর্ষণে বন্দর নগরী চট্টগ্রামের হাটহাজারি, পাহাড়তলি, বায়জিদ বোস্তামি, খুলসী এলাকায় পাহাড়ের মাটিচাপায় ১২৭ জন মানুষ নিহত হন। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, চট্টগ্রাম মহানগরী এবং এর পাশের এলাকায় পাহাড় ধসে ২০০৮ সালে ১৪ জন, ২০১১ সালে ১৭ জন, ২০১২ সালে ২৮ জন মানুষ মৃত্যুবরণ করে। গেল চার দশকে পাহাড় ধসে ৬ শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। পাহাড় ধসের ফলে মানুষের মৃত্যু ছাড়াও জীববৈচিত্র্য হয় হুমকির সম্মুখীন, বন্যপ্রাণী হারায় আবাসস্থল।
বর্ষাকালে মাইকিং করে পাহাড়ের ঢালে বসবাসকারী মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বলা হয়। কখনও পাহাড় ধস শুরু হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থান থেকে বাসিন্দাদের অন্যত্র সরিয়েও নেওয়া হয়। পাহাড় ধসের আশঙ্কায় প্রতিবার পুলিশ দিয়ে মাইকিং করে লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হলেও কিছুসংখ্যক পাহাড়বাসী জোর করে পাহাড়ে থেকে যান। তাদের জন্য স্থায়ী কোনো আবাসস্থল না থাকায় কিছুদিন যেতে না যেতেই মানুষগুলো আবার সেখানে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। কখনও তাদের বস্তি থেকে অমানবিকভাবে উচ্ছেদও করা হয়। তারপরও পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি বন্ধ হয় না। বর্ষাকালে পাহাড় ধসের আশঙ্কায় পাহাড়ের গায়ে গড়ে ওঠা বস্তি উচ্ছেদ পাহাড় ধসে মৃত্যুরোধের কোনো স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। প্রবল বর্ষণে পাহাড় ধসের সম্ভাবনা দেখা দিলে পাহাড়ে বসবাসকারীদের নিরাপদে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হতে পারে মৃত্যু কমিয়ে আনার একটি সাময়িক ব্যবস্থা। তাই পাহাড়ের গায়ে অবৈধ বস্তি নির্মাণ করে অর্থ উপার্জন করা এবং পাহাড়ে বাসকারী আশ্রয়হীন মানুষকে মৃত্যুঝুঁকির মুখে ঠেলে দেওয়া বন্ধ করতে হবে। উন্নয়নের নামে প্রভাবশালী মহলের পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে নিতে হবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। পাহাড় ধসে মৃত্যু রোধ করতে হলে পাহাড় কাটা বন্ধের পাশাপাশি ন্যাড়া পাহাড়ে গাছপালা লাগিয়ে সবুজ আচ্ছাদনে ছেয়ে দিতে হবে। পাহাড়ের ওপরে এবং নিচে বসতি স্থাপন সম্পূর্ণ বন্ধ করতে স্থানীয় প্রশাসন ও সিটি করপোরেশনকে দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ নিতে হবে। পাহাড় অঞ্চলে বসবাসকারী পরিবারগুলোর জন্য নিরাপদ পুনর্বাসন ও আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। ২০০৭ সালের পাহাড় ধসে ১২৭ জনের মৃত্যুর পর গঠিত কমিটির ৩৬টি সুপারিশ প্রয়োজনে আলাদা সেল গঠন করে অনতিবিলম্বে বাস্তবায়ন করতে হবে। সরকারের নির্দিষ্ট সংস্থার দায়িত্ব পাহাড়ের কোলে আশ্রয় নেওয়া মানুষের জীবন রক্ষা তথা পরিবেশ রক্ষাকারী পাহাড় ও পাহাড় এলাকাকে সংরক্ষণ করা। সেই সংস্থাই রক্ষক হয়ে যদি ভক্ষকের ভূমিকা পালন করে তবে পরিবেশের রক্ষাকবচ পাহাড়কে টিকিয়ে রাখবে কে! পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী মানুষকেই বা বাঁচাবে কে? হ
মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ
প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক