তিউনিসিয়ান অন্ধ যুবক হাইসাম হাদ্দাদ। জন্ম ১৯৮৩। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য আবিষ্কার করেছেন অভিনব এক যন্ত্র, যা বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে সাহায্য করবে। তিনি প্রতিবন্ধী হিসেবে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হন। বিশেষ করে রাস্তাঘাটে চলাফেরার সময়। অনেক সময় সঙ্গি খুঁজে পেতেন না বা লাঠি দিয়ে ভর করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না। যদিও লাঠি গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু তার ভূমিকা নিতান্তই সীমিত পরিসরে। তাই তিনি এ বিশেষ যন্ত্রটি আবিষ্কার করেন।
‘নিউ অ্যারাব’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হাইসাম বলেন, ২১ বছর বয়সে আমি মারাত্মক চোখের সমস্যায় আক্রান্ত হই, যা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। পরিশেষে পূর্ণ দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলি। কিন্তু আমার সঙ্গে কৃত আচরণ মেনে নিতে পারিনি। ফলে আমার কষ্ট দূরীকরণের উপায় হিসেবে কোনো কিছু আবিষ্কারের জন্য সব প্রচেষ্টা ব্যয় করি।
হাইসাম দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, বর্তমানে ইউরোপে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য যেসব যন্ত্র পাওয়া যায় তা ব্যয়বহুল। আরব যুবকদের জন্য তা সহজে সংগ্রহ করা কঠিন। ছোটবেলা থেকে ইলেকট্রনিক বিষয়ের সঙ্গে সখ্য ছিল হাইসামের। ফলে তার প্রতিভা বিকশিত করা সহজ হয়েছে। তার আবিষ্কার পূর্ণ করার কাজে তা সহযোগী হয়েছে। যদিও তার দৃষ্টিশক্তি নেই; কিন্তু প্রতিটি পার্টসের উপাদান সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত। তার ওয়ার্কশপে তিনি নিজেই কাজ করেন। তার ওয়ার্কশপ হলো বাড়ির রান্নাঘরের একটি কোণ।
হাইসাম বলেন, তিনি কারও সহযোগিতা ছাড়া একাই কয়েক ঘণ্টা কাজ করেন। তার অনুমান ক্ষমতা ও প্রতিভাই এ শিল্পের প্রতি পথপ্রদর্শন করেছে। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, কাজটি অনেক কঠিন ও কষ্টসাধ্য, তথাপিও তা উপভোগ্য। তার প্রকল্প অব্যাহত রাখতে কোনো কিছুই তাকে বাধা দিতে পারেনি। তিনি পার্টসগুলোর পরিচয় ও পরবর্তী সময়ে সেগুলো জায়গা মতো ফিট করতে সহযোগিতামূলক কিছু উপকরণও পেয়ে যান।
নব আবিষ্কৃৃত যন্ত্রটি দেখতে মোবাইল ফোনের মতো। রাস্তায় সামনের প্রতিবন্ধকতা নির্ণয়ে সহযোগিতা করবে। কেউ নিকটবর্তী হলে সতর্কবার্তা দেবে। ৪ মিটার দূর থেকে কাজ করতে পারবে। লাঠিতে স্থাপনযোগ্য। আলাদাও ব্যবহার করা যাবে। এ ক্ষেত্রে যে যন্ত্রাদি বর্তমানে বাজারে পাওয়া যায় সবগুলো থেকে তা আলাদা। তাতে অডিও নির্দেশিকা যুক্ত করা হয়েছে। প্রতিটি যন্ত্র ক্রয় করতে ব্যয় হবে ৩০০ তিউনিসিয়ান দিনার (যা প্রায় ১০০ ডলার)। মোবাইলের চার্জার দিয়ে চার্জ দেওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘তিউনিসিয়ার আশা’ সংস্থা (যা কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী যুবকের দ্বারা পরিচালিত, তারা প্রতিবন্ধীদের মানবিক ও সামাজিক বিকাশের লক্ষ্যে কয়েকটি প্রচারাভিযান চালিয়েছে। এর মধ্যে একটা হলো, তাদের সহযোগিতার জন্য বোতলের ছিপি একত্রীকরণ ও বিক্রি করা) তাকে সহযোগিতা করে ও অনেকগুলো ডিভাইস তৈরি ও প্রতিবন্ধীদের মাঝে তা বিলি করার ক্ষেত্রে উৎসাহিত করে।
হাইসাম তার উদ্ভাবনীর উন্নয়নের স্বপ্ন নিয়ে কথা বলেন। তিনি বর্তমানে একটি স্মার্ট ডিভাইস তৈরি করছেন। এটাও রাস্তার প্রতিবন্ধকতা দূর করবে। তবে তা আগেরটার তুলনায় বেশি উন্নতমানের হবে। তাতে ক্যামেরা ও অডিও সতর্কবার্তা ফিট করা থাকবে। ব্যবহারকারীর সামনে যদি কোনো দেহবিশিষ্ট বস্তু আসে তাহলে সে ব্যবহারকারীকে সংবাদ দিয়ে দেবেÑ তা কোন ধরনের বস্তু। যেমন দরজা, দেয়াল ইত্যাদি। সে কোন দিকে যাচ্ছে তাও বলে দেবে। তিনি বলেন, তার ডিভাইস অনেক প্রতিবন্ধীর জন্য আরও বেশি আত্মনির্ভরশীল হতে সহায়ক হয়েছে। তার সামনে ভয়ের দেওয়াল ভেঙে দিয়েছে। যে ভয় তাদের পাবলিক পরিবহনে চড়তে বা একাকী চলতে বাধা হয়ে দাঁড়াত। তিনি বলেন, এ ডিভাইসটি অনেক প্রতিবন্ধীর জীবনকে সহজ করে তুলবে। আরও ভালোভাবে জীবনকে উপভোগ করার সুযোগ তৈরি করবে।
হাইসাম বলেন, তাতে সংযুক্ত প্রোগ্রামের সাহায্যে একজন অন্ধ ব্যক্তি তা নিজে নিজেই চালাতে পারবে। এটা তার সামনের দূরত্ব সম্পর্কেও বলে দেবে। তিনি আরও জানান, এ ডিভাইসটি প্রায় সব বয়সি প্রতিবন্ধীই ব্যবহার করতে পারবে। বাচ্চারাও ব্যবহার করতে পারবে। পক্ষান্তরে বাজারে বিদ্যমান ডিভাইসগুলো সবার উপযুক্ত নয়। যেগুলোতে ব্যক্তির দৈর্ঘ্যরে প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়নি। আর তা সবসময় একই আকারের হয়ে থাকে। শুধু লাঠিতেই লাগানো থাকে।
তিনি বলেন, লাঠি ছাড়া চলাফেরার দিন এসেছে। লাঠি যুগের উন্নতির সঙ্গে ও প্রতিবন্ধীদের প্রয়োজনের তুলনায় কোনো কার্যকরী পন্থা নয়। তাই তা ছেড়ে সাধারণ জীবনযাপন শুরু করা উচিত। বিশেষ করে অন্ধ ব্যক্তি যখন রাস্তায় চলাচল করবে কিন্তু কোনো ধরনের সমস্যা অনুভব করবে না, বা কোনো কিছুর সঙ্গে ধাক্কা লাগা বা চলার পথে হোঁচট খাওয়ার মতো কোনো আশঙ্কা থাকবে নাÑ তখন তো লাঠির কোনো প্রয়োজন নেই।
হাইসাম অনেক হুমকির সম্মুখীন হয়েছেনÑ তবুও ভয় পাননি। তিনি অন্ধ হওয়া ও তার ডিভাইসের গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও কেউ তার দায়িত্ব নেয়নি। তার ডিভাইসটি অধিক সংখ্যক প্রতিবন্ধীর কাছে পৌঁছানো ও তা থেকে উপকৃত হওয়ার লক্ষ্যে তা উৎপাদনের জন্য কোনো কোম্পানি বা সংস্থা থেকে কার্যকরী কোনো প্রস্তাবনাও পাওয়া যায়নি। বর্তমানে তিনি গ্রাহকের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু ডিভাইস তৈরির কাজ করেন। তার উৎপাদনে দিন দিন উন্নতিকল্পে তিউনিসিয়া সরকার বা শিল্পপতিদের পক্ষ থেকে উৎসাহ পাবেন বলে আশা করছেন। হাইসাম বলেন, কিছু প্রতিবন্ধী কোনো কাজ করে না। তারা নামমাত্র মূল্যের এ ডিভাইসটিও সংগ্রহ করতে পারছে না টাকার অভাবে। কেউ কেউ জানিয়েছে, এমন একটি ডিভাইস তাদের দরকার। কেননা তা জীবনযাত্রা সহজ করবে। চলাফেরায় সাহায্য করবে। কিন্তু আফসোসের বিষয়, তাদের আর্থিক জোগান তার চেয়েও কম। হাইসাম মনে করেন, যেসব সংস্থা বা ব্যক্তি প্রতিবন্ধীদের সাহায্যের ব্যাপারে গুরুত্ব দেয় তাদের উচিত জীবনযাত্রাকে সহজকারী এ ডিভাইসটি প্রত্যেকের জন্য ব্যবস্থা করা।
হ সূত্র : নিউ অ্যারাব