আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ১১-০২-২০২০ তারিখে পত্রিকা

টম অ্যান্ড জেরি ইঁদুর-বিড়াল খেলার ৮০ বছর

| প্রথম পাতা

আলোকিত ডেস্ক : কার্টুন ছবির এক বিড়াল, যে তার বাড়িতে থাকা এক ইঁদুরের যন্ত্রণায় ত্যক্তবিরক্ত, ইঁদুর ধরার ফাঁদে পনির রেখে তার শত্রুকে কাবু করার ছক কষে। বুদ্ধিমান ইঁদুরটি কিন্তু বিড়ালের পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে সফলভাবেই ফাঁদ থেকে তার প্রিয় খাবার সরিয়ে নিয়ে ভরপেটে হেলতে দুলতে সরে পড়ে। আপনি হয়তো অনুমান করতে পারছেন যে, এরপর কী হবে। প্রায় প্রতিবারের মতো একই পরিণতি বিড়ালের পরিকল্পনারÑ আবারও একটি পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়ে যাওয়ার হতাশায় নিষ্ফল আক্রোশে চিৎকার করতে থাকে বেচারা বিড়াল। গল্পের পটভূমি পরিচিত হলেও এর পেছনের কাহিনীটা কিন্তু সবসময় একরকম নয়। অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড জয় থেকে শুরু করে স্নায়ুযুদ্ধের সময়কার বিতর্কিত এলাকায় ইঁদুর-বিড়াল খেলার 
ষ ১ম পৃষ্ঠার পর
গোপনে কার্টুন তৈরির কাজ- সবই এ সপ্তাহে ৮০-তে পা দিতে যাওয়া টম অ্যান্ড জেরিকে বিশ্বের সর্বকালের সবচেয়ে পরিচিত ডুয়েটের একটি হিসেবে পরিচিতি পেতে ভূমিকা রেখেছে। এই ইঁদুর-বিড়াল যুগলের কাহিনী তৈরির চিন্তাটি আসে যখন এর নির্মাতারা একেবারে খাদের কিনারায় ছিলেন তখন। এ কার্টুনের নির্মাতা বিল হ্যান্না ও জো বারবেরা কাজ করতেন প্রযোজক সংস্থা এমজিএম এর অ্যানিমেশন বিভাগে। অন্যান্য অ্যানিমেশন স্টুডিও পর্কি পিগ ও মিকি মাউসের মতো সফল কার্টুন তৈরি করতে পারলেও এমজিএম তখনও সাফল্যের মুখ দেখেনি।
অনেকটা বিরক্ত হয়েই দুই নির্মাতা, যাদের দুজনের বয়সই তখন ত্রিশের নিচে ছিল, ভিন্ন কিছু করার চিন্তা করতে থাকেন। বারবেরা প্রস্তাব করেন ইঁদুর ও বিড়ালের প্রতিদিনের খুনসুটির কাহিনী নিয়ে অ্যানিমেশন তৈরি করার, যদিও তার আগে অসংখ্যবার এ পটভূমিতে কার্টুন তৈরি হয়েছে।
১৯৪০ সালে তারা প্রথমবার প্রকাশ করেন ‘পুস গেটস দ্য বুটস।’ অভিষেক ছবিটি সফলতা পায় এবং নির্মাতা স্টুডিও সেরা অ্যানিমেটেড শর্টফিল্ম বিভাগে অস্কার মনোনয়ন পায়। তবে যেই দুজন অ্যানিমেটর ছবিটি তৈরি করেন তাদের কোনো কৃতিত্ব দেওয়া হয়নি।
দুই অ্যানিমেটরকে স্টুডিওর ম্যানেজাররা বলেন, যেন তারা নিজেরা সব কৃতিত্ব নেওয়ার জন্য উদগ্রীব না হন। তাদের মানসিকতার পরিবর্তন হয় টেক্সাসের এক প্রভাবশালী শিল্পপতির চিঠিতে। চিঠিতে ওই ব্যক্তি জানতে চান ‘ইঁদুর-বিড়ালের চমৎকার কার্টুনটি আবার কবে দেখতে পাবা।’
প্রথম পর্বে তাদের নাম ছিল জ্যাসপার ও জিঙ্কস, পরে যা পরিবর্তিত হয় টম ও জেরিতে। বারবেরার মতে, কার্টুনের চরিত্রগুলো কথা বলবে কি না, তা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি নিজেদের মধ্যে। তবে চার্লি চ্যাপলিনের মত নীরব চলচ্চিত্র দেখে বড় হওয়া নির্মাতারা জানতেন যে কোনো ডায়লগ না থাকলেও একটি চলচ্চিত্রকে যথেষ্ট হাস্যরসাত্মক হিসেবে উপস্থাপন করা যায়।
কার্টুনের চরিত্রদের সব কার্যকলাপকে ফুটিয়ে তোলে স্কট ব্র্যাডলির আবহ সঙ্গীত আর টমের প্রায় মানুষের মতো চিৎকারের পেছনে কণ্ঠ দেন হ্যান্না নিজে।
পরের দুই দশকে প্রায় ১০০টি ছোট পরিসরের কার্টুন তৈরির পেছনে ছিলেন হ্যান্না ও বারবেরা। প্রতিটি পর্ব তৈরি করতে কয়েক সপ্তাহ লাগত এবং প্রায় ৫০ হাজার ডলার খরচ হতো। কাজেই প্রতিবছর হাতেগোনা কয়েকটি পর্বই তৈরি করা সম্ভব হতো।
সমৃদ্ধ হাতে আঁকা অ্যানিমেশন ও সূক্ষ্ম খুঁটিনাটিসহ দৃশ্যপট থাকায় সারা বিশ্বেই এ টম অ্যান্ড জেরির সর্বশ্রেষ্ঠ কার্টুন চিত্র। হলিউড ফিচার ফিল্ম ক্যাটাগরিতে সাতটি অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড পায় এ ফিল্মগুলো।
কার্টুন ইতিহাসবিদ জেরি বেক, যিনি কার্টুন চলচ্চিত্র তৈরির বিভিন্ন ধাপে কাজ করেছেন, বলেন, ‘কার্টুনগুলো আপনি এখনই দেখেন অথবা শিশু অবস্থাতেই দেখে থাকেন, কোনো সময়ে এগুলো তৈরি করা হয়েছে জানলে আপনি অবাক হবেন, সে নিশ্চয়তা আমি দিতে পারি। অ্যানিমেশনগুলোতে বিশেষ কিছু আছে, এগুলো চিরসবুজ। এটি কখনোই পুরোনো হয় না।’
‘যে কোনো হাতে আঁকা ছবি যেমন একটা নির্দিষ্ট সময়ের গল্প বলে, সেটা যে সময়েই আঁকা হোক না কেন, এ কার্টুনগুলোও সেরকমই। এগুলো কখনও বিনোদন দেওয়া বন্ধ করে না।’
১৯৫০-এর মাঝামাঝি সময়ে যখন প্রযোজক ফ্রেড কুইম্বি অবসরে যান, হ্যান্না ও বারবেরা এমজিএম এর কার্টুন বিভাগের দায়িত্ব নেন।
সে সময় টেলিভিশনের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকায় স্টুডিও মালিকরা মনে করতে থাকেন যে, পুরোনো অ্যানিমেশনগুলোকে নতুনভাবে প্রকাশ করে আর্থিকভাবে যতটা লাভবান হবেন, নতুন অ্যানিমেশন বানিয়েও মোটামুটি একই অঙ্কের লাভ করতে পারবেন।
১৯৫৭ সালে এমজিএম এর অ্যানিমেশন বিভাগ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর হ্যান্না ও বারবেরা নিজেদের প্রযোজনা সংস্থা চালু করেন।
কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই আসল নির্মাতাদের ছাড়াই টম অ্যান্ড জেরি পুনর্নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেয় এমজিএম। ১৯৬১ সালে খরচ বাঁচাতে প্রাগে একটি স্টুডিওকে দিয়ে কাজ করানোর সিদ্ধান্ত নেয় তারা। শিকাগোতে জন্ম নেওয়া অ্যানিমেটর জিন ডাইচ পুনর্নির্মাণের দায়িত্ব পান। তবে বাজেট স্বল্পতার কারণে কম লোকবল নিয়ে কাজ করতে বেশ ঝক্কি পোহাতে হয় তাকে। পাশাপাশি টম অ্যান্ড জেরির পুরোনো পর্বগুলো সম্পর্কে ধারণা না থাকার কারণেও সমস্যায় পড়ে তার দল।
ওই স্টুডিওতে পপাইয়ের মতো জনপ্রিয় বেশ কিছু কার্টুনের পর্বও পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল। নির্মাতাদের চেক নামগুলোকে অ্যামেরিকানদের মতো করে লেখা হয়, যেন দর্শকরা কার্টুনগুলোকে কমিউনিজমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মনে না করে।
ক্লাসিক কার্টুনগুলোকে প্রথমবার পুনর্নির্মাণ করেন ডাইচ, আর তিনি জানতেন এর জন্য ফ্যানদের রোষানলে পড়বেন তিনি। তার তৈরি করা ১২টি কার্টুনকে টম অ্যান্ড জেরির ইতিহাসের নিকৃষ্টতম পর্ব হিসেবে গণ্য করা হয়।
সাক্ষাৎকারের সময় নিজেদের নেতিবাচক ভাবমূর্তি নিয়ে সৎ স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন ডাইচ। এমনকি তিনি এও জানান যে, সে সব পর্ব তৈরি করা নিয়ে মৃত্যুর হুমকিও পেয়েছিলেন তিনি।
ডাইচের পরে টম অ্যান্ড জেরি নতুন করে বানানোর দায়িত্ব পড়ে চাক  জোনসের হাতে, যিনি ওয়ার্নার ব্রাদার্স স্টুডিওতে লুনি টিউনসের সঙ্গে কাজ করার জন্য পরিচিত ছিলেন।
এমজিএম স্টুডিওতে টেলিভিশনকে বেশ নেতিবাচকভাবে দেখা হলেও হ্যান্না ও বারবেরা নিজেরা যখন অ্যানিমেশন তৈরি করতে শুরু করেন, তখন টেলিভিশনের জন্য পর্ব বানাতে শুরু করেন। সময় ও খরচ বাঁচাতে অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ আকৃতির পর্ব তৈরি করেন তারা নিজেদের অ্যানিমেশন স্টাইলে।
কয়েক দশক ধরে তাদের কার্টুন শিশুদের টেলিভিশনে আধিপত্য চালায়। ১৯৬০-এর দশকের শুরুর দিকে হাকলবেরি হাউন্ড ও ইয়োগি বেয়ারের মতো চরিত্র দিয়ে সাফল্য লাভ করেন তারা। পরে একে একে আসে ফ্লিন্টস্টোনস, টপ ক্যাট এবং স্কুবি ডু’র মতো চরিত্র।
৭০-এর দর্শকে এ জুটি আবারও টম অ্যান্ড জেরি তৈরিতে মনোযোগ  দেয়। ততদিনে শুরুর দিকের অনেক পর্বকেই সে সময়কার নতুন টেলিভিশন নীতিমালা অনুযায়ী ‘অতিরিক্ত সহিংস’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
নতুন পর্বগুলো, যেখানে টম ও জেরিকে একে অপরের বন্ধু হিসেবে দেখা যায়, কখনোই আদি পর্বগুলোর মতো সাফল্য পায়নি।
সে সময়কার অন্য কার্টুনের মতো টম অ্যান্ড জেরির ঐতিহ্যও কিছুটা সমালোচিত হয় নির্দিষ্ট জাতিসত্তাকে খাটো করে উপস্থাপন করার অভিযোগে। বিশেষ করে ‘ম্যামি টু শুজ’ চরিত্রটির- এক কৃষ্ণাঙ্গ গৃহকর্মী, যার বাচনভঙ্গিতে দক্ষিণাঞ্চলের প্রভাব ছিল অতিরিক্ত স্পষ্ট এবং যার  কোমড়ের নিচের অংশই কেবল কার্টুনে দেখা যেত- উপস্থাপক জাতি বৈষম্যকে আপত্তিকরভাবে প্রকাশ করে বলে অভিযোগ ছিল।
ওই পর্বগুলোর কয়েকটিতে কৃষ্ণাঙ্গ চেহারা ব্যবহার করে হাস্যরস তৈরি করা এবং এশিয়ান বা জন্মগতভাবে অ্যামেরিকানদের চরিত্র উপস্থাপনের  ক্ষেত্রেও মর্যাদা হানিকর চিত্রায়ন করা হয়।
ষাটের দশকে যুক্তরাষ্ট্রের টেলিভিশনে মূল পর্বগুলো যখন প্রকাশ করা হয়, কিছু দৃশ্যে ম্যামির চরিত্র প্রতিস্থাপন করা হয় নতুন চরিত্র দিয়ে, যেগুলোর অনেকগুলো চাক জোনসের তৈরি করা ছিল।
আপাতদৃষ্টিতে সহিংস কিছু কাহিনীর চিত্রায়ন ও ইঙ্গিতপূর্ণ হাস্যরসাত্মক দৃশ্যপট থাকলেও বিশ্বজুড়ে এখনও দারুণ জনপ্রিয় টম অ্যান্ড জেরি। জাপান থেকে পাকিস্তান পর্যন্ত পৃথিবীর সবখানেই শিশুদের টেলিভিশনে এ কার্টুন দেখতে পাওয়া যায়। চীনে টম অ্যান্ড জেরির একটি নতুন মোবাইল  ফোন গেম ১০ কোটির বেশি মানুষ ব্যবহার করে।
এর পাশাপাশি এ যুগে এসেও টম অ্যান্ড জেরি আশ্চার্যজনকভাবে নতুন নতুন হেডলাইন তেরি করতে সক্ষম হয়েছে। ২০১৬ সালে মিসরের শীর্ষ এক কর্মকর্তা অভিযোগ করেন যে, মধ্যপ্রাচ্যে সহিংসতা ছডানোর পেছনে ভূমিকা রাখছে এ কার্টুন। ইরানের শীর্ষ নেতা অন্তত দুইবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে তুলনা করেন টম ও জেরির মধ্যকার সম্পর্কের মাধ্যমে।
প্রথম তৈরি হওয়ার পর থেকে ৮০ বছরে বহুল পরিচিত ইঁদুর ও বিড়ালের খুনসুটির কাহিনী নিয়ে শিশুদের কাছে জনপ্রিয় কার্টুনের পাশাপাশি গীতিনাট্যভিত্তিক একটি চলচ্চিত্রও তৈরি করা হয়। ওই ছবিতে চরিত্রগুলো গান গাইত এবং কথাও বলত।
বিল হ্যান্না মারা যান ২০০১ সালে এবং জো বারবেরার মৃত্যু হয় ২০০৬ সালে। মারা যাওয়ার এক বছর আগে জো বারবেরা শেষবারের মতো টম অ্যান্ড জেরির একটি পর্ব তৈরি করেন, যেটি ছিল সঙ্গী বিল হ্যান্নাকে ছাড়া তার তৈরি করা টম অ্যান্ড জেরির প্রথম পর্ব।
টম অ্যান্ড জেরির বর্তমান স্বত্বাধিকারী ওয়ার্নার ব্রাদার্স এ বছরের বড়দিনের আগে নতুন একটি লাইভ-অ্যাকশন ফিল্ম বাজারে ছাড়বে। ক্লো গ্রেস মোরেৎজ ও কেন জেওং এ ফিল্মে কাজ করবেন, এছাড়া এ সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায়নি। সূত্র : বিবিসিবাংলা