আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ১২-০২-২০২০ তারিখে পত্রিকা

ধূমপান নিষিদ্ধ : এতে গুরুতর গোনাহ হয়

বিড়ি বা সিগারেটের প্যাকেটের গায়েই লেখা থাকে, ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’, ‘ধূমপান মৃত্যু ঘটায়’ ও ‘ধূমপান ক্যান্সারের কারণ’ ইত্যাদি। পৃথিবীতে এটিই একমাত্র পণ্য, যে পণ্যের প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য ভোগ করতে প্রত্যক্ষভাবে নিষেধ করে। নিরুৎসাহিত করে নিজেদের পণ্য ক্ষতিকর বলে ঘোষণা করে। আর যারা ধূমপান করে, তারা নিজেরাও বলে বা স্বীকার করে যে, ধূমপান করা ক্ষতিকর। আর বান্দার জন্য যে কোনো ক্ষতিকর বিষয়কে মহান আল্লাহ নিষিদ্ধ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘তিনি তোমাদের জন্য হালাল করে দেন ভালো ও উত্তম বস্তু আর হারাম করে দেন খারাপ ও ক্ষতিকর বস্তু।’ (সূরা আরাফ : ১৫৭)।

মো. মাসুদুর রহমান
| প্রকৃতি ও পরিবেশ

তামাক বা তামাকজাতীয় দ্রব্যাদি বিশেষ পদ্ধতিতে প্রক্রিয়াজাত করত আগুন দিয়ে পুড়িয়ে শ্বাসের মাধ্যমে ধোঁয়া গ্রহণের নামই ধূমপান। এ ধূমপান আপাতদৃষ্টিতে ‘মাত্র একটি’ অপরাধ মনে হলেও এর ভেতরে কয়েকটি অপরাধ নিহিত। অর্থাৎ ধূমপান করলে একই সঙ্গে ধূমপায়ী ব্যক্তি কয়েকটি অপরাধে অপরাধী হয়। যেসব অপরাধের প্রতিটি ইসলামে নিষিদ্ধ বা হারাম। ধূমপানে যেসব গোনাহ বা অপরাধ নিহিত যথা-
নেশা করার গোনাহ : শরিয়তের দৃষ্টিতে ‘যে জিনিস নেশার উদ্রেক করে সে জিনিসই নিষিদ্ধ।’ এ নীতিমালা অনুযায়ী ধূমপান নিষিদ্ধ। কারণ ধূমপানের আসল উপাদান হলো তামাক। যে তামাকে নিকোটিন নামে একটি উপাদান থাকে, যা আসক্তি সৃষ্টির জন্য দায়ী। যে আসক্তি মানুষকে নেশা পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। আর রাসুল (সা.) সব নেশাজাতীয় বস্তুর ব্যাপারে বলেছেন, ‘নেশা জাতীয় যে কোন দ্রব্যই মাদক, আর যাবতীয় মাদকদ্রব্য হারাম।’ (মুসলিম)।
তবে অনেক ধূমপায়ী বলতে পারে, ধূমপানের কারণে তো মস্তিষ্কের বিকৃতি ঘটার মতো তেমন নেশা হয় না। এ ধরনের বক্তব্যের ব্যাপারে রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে বস্তু অধিক পরিমাণে গ্রহণ নেশা সৃষ্টি করে, তা সামান্য পরিমাণে গ্রহণও নিষিদ্ধ।’ (নাসাঈ, ইবনে হিব্বান)।
নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত করার গোনাহ  হয় : বিড়ি বা সিগারেটের প্যাকেটের গায়েই লেখা থাকে, ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’, ‘ধূমপান মৃত্যু ঘটায়’ ও ‘ধূমপান ক্যান্সারের কারণ’ ইত্যাদি। পৃথিবীতে এটিই একমাত্র পণ্য, যে পণ্যের প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য ভোগ করতে প্রত্যক্ষভাবে নিষেধ করে। নিরুৎসাহিত করে নিজেদের পণ্য ক্ষতিকর বলে ঘোষণা করে। আর যারা ধূমপান করে, তারা নিজেরাও বলে বা স্বীকার করে যে, ধূমপান করা ক্ষতিকর। আর বান্দার জন্য যে কোনো ক্ষতিকর বিষয়কে মহান আল্লাহ নিষিদ্ধ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘তিনি তোমাদের জন্য হালাল করে দেন ভালো ও উত্তম বস্তু আর হারাম করে দেন খারাপ ও ক্ষতিকর বস্তু।’ (সূরা আরাফ : ১৫৭)।
আবার এ ক্ষতি শুধু সাধারণ ক্ষতি নয়, বরং জীবননাশমূলক ক্ষতি। গবেষণায় দেখা গেছে, সিগারেটের ধোঁয়ায় নিকোটিনসহ ৫৬টি বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ বিদ্যমান থাকে। যেসব রাসায়নিক পদার্থ মানুষের মুখ, শ্বাসনালি, গ্রাসনালি এবং ফুসফুসে ক্যান্সার সৃষ্টি করে। ধূমপানের ফলে শ্বাসনালিতে প্রদাহ হয় ও শ্বাসনালি ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়। ফুসফুস অনেকাংশে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। মোটকথা ধূমপানের কারণে একজন ধূমপায়ী ব্রঙ্কাইটিস, হার্ট অ্যাটাক, ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ, এমফাইসিমা ও ক্যান্সার ইত্যাদিতে আক্রান্ত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকে।  
অতএব একথা প্রমাণিত, ধূমপান ধূমপায়ীদের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর। সুতরাং ধূমপান করা মানে নিজেই নিজেকে ক্ষতি বা ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া। আর নিজের ক্ষতি করাও ইসলামে নিষিদ্ধ। কেননা আল্লাহপাকের নিষেধাজ্ঞা হলো, ‘তোমরা নিজেদের হাতে নিজেদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিও না।’ (সূরা বাকারা : ১৯৫)। 
সেই সঙ্গে নিজের জীবনকে যে কোনো মাধ্যমে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়াও নিষিদ্ধ। আর চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, ধূমপান মানুষের জীবনকে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে দেয়। সুতরাং যদি কোনো ব্যক্তি ধূমপানের কারণে কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে অথবা ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে তবে সে আত্মহত্যাকারীর শামিল হবে। এ ক্ষেত্রে আল্লাহপাকের নিষেধাজ্ঞা হলো, ‘তোমরা নিজেরা নিজেকে হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়ালু। যে বিদ্বেষ ও জুলুমবশত এমন করবে, আমি অবশ্যই তাকে জাহান্নামে দগ্ধ করব। আর আল্লাহর জন্য তা করা অতি সহজ।’ (সূরা নিসা : ২৯-৩০)। হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি বিষপানে (যে কোনো বিষ) আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামের আগুনের মধ্যে অবস্থান করে ওই বিষ পান করতে থাকবে এবং সেখানে চিরকাল অবস্থান করবে।’ (বোখারি, মুসলিম)।  
মানুষের ক্ষতি করার গোনাহ হয় : ধূমপান না করলেও ধূমপানের সময় ধূমপায়ীর পাশে থাকলে বা অন্য কোনোভাবে সিগারেট বা বিড়ির ধোঁয়া গ্রহণ করলে তাকে পরোক্ষ ধূমপান বলা হয়। এ পরোক্ষ ধূমপানও মানুষের জন্য খুবই ক্ষতিকর। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, পরোক্ষ ধূমপানের কারণে অধূমপায়ীরা ধূমপায়ীদের চেয়েও পাঁচগুণ বেশি ক্ষতির মুখে পড়ে।
গবেষণায় দেখা গেছে, নিজে ধূমপান না করলেও অন্যের ধূমপানের (পরোক্ষ ধূমপান) প্রভাবে বিশ্বব্যাপী কয়েক লাখ মানুষ মারা যায়। পরোক্ষ ধূমপান পুরুষের তুলনায় নারীর ওপর বেশি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। যে ধূমপানের কারণে বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৮১ হাজার নারী মৃত্যুবরণ করেন। শিশুরাও পরোক্ষ ধূমপানের কারণে নিউমোনিয়া ও অ্যাজমায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে পড়ে। 
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় রাজধানী ঢাকার প্রাথমিক স্কুলে পড়–য়া ৯৫ শতাংশ শিশুর দেহে উচ্চমাত্রার নিকোটিন পাওয়া গেছে, যার মূল কারণ পরোক্ষ ধূমপান। (ঢাকা ট্রিবিউন, ১ জুন ১৯)। এ ক্ষেত্রে ধূমপায়ীরা নিজেদের জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে নিজের স্ত্রী-সন্তান, পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব ও পাড়া-প্রতিবেশীসহ অসংখ্য মানুষের ক্ষতি করছে। অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী হচ্ছে।     
অর্থাৎ ধূমপানকারীরা সাধারণ মানুষের তথা অধূমপায়ীদের গুরুতর ক্ষতি করে থাকে। আর যে কোনো মাধ্যমে মানুষের ক্ষতি করা ইসলামে হারাম বা নিষিদ্ধ।     
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যারা মোমিন পুরুষ ও নারীদের বিনা অপরাধে কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে।’ (সূরা আহজাব : ৫৮)। মানুষের ক্ষতিকারীদের ব্যাপারে রাসুলের (সা.) সতর্কতামূলক ঘোষণা হলোÑ ‘আল্লাহর কসম! সে ব্যক্তি প্রকৃত মোমিন হতে পারে না।’ এভাবে তিনি তিনবার বললেন। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল, সে ব্যক্তি কে? তিনি বললেন, ‘যার অনিষ্টতা থেকে প্রতিবেশী নিরাপদ নয়।’ (বোখারি, মুসলিম, আহমদ)। তিনি আরও বলেছেন, ‘প্রকৃত মুসলমান সে, যার মুখ ও হাত থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ’ (তিরমিজি)।
অপব্যয় করার গোনাহ হয় : ধূমপানে যেহেতু কোনো উপকার নেই, সেহেতু এর পেছনে অর্থ ব্যয় করা অবশ্যই অপব্যয়। আর ইসলামে অপব্যয় বা অপচয় করা নিষিদ্ধ। অপব্যয় না করার ব্যাপারে আল্লাহর নিষেধাজ্ঞা হলো, ‘তোমরা আহার করো ও পান করো; কিন্তু অপব্যয় করবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না।’ (সূরা আরাফ : ৩১)। অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর তোমাদের অর্থ-সম্পদ অপ্রয়োজনীয় কাজে খরচ করবে না। জেনে রেখো, যারা অপব্যয় করে তারা শয়তানের ভাই, আর শয়তান নিজ প্রতিপালকের ঘোর অকৃতজ্ঞ।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ২৬-২৭)। হাদিসেও অপব্যয় বা অপচয়ের ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা এসেছে। যেমন একটি হাদিসে এসেছে ‘একদিন রাসুল (সা.) সা’দ (রা.) এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় সা’দ (রা.) অজু করছিলেন। তার অজুতে পানি বেশি খরচ হচ্ছিল। রাসুল (সা.) তা দেখে বললেন, কেন এ অপচয়? সা’দ (রা.) আরজ করলেন, অজুতেও কি অপচয় হয়? রাসুল (সা.) বললেন, হ্যাঁ, এমনকি বহমান নদীতে অজু করলেও।’ (ইবনে মাজাহ)।
সর্বোপরি ধূমপানে নেশা করা, নিজের ক্ষতি করা, মানুষের ক্ষতি করা ও অর্থের অপচয় করাÑ এসব স্পষ্ট নিষিদ্ধ কর্ম সংঘটিত হয় বিধায় তা হারাম এবং এটিই প্রসিদ্ধ মত। যদিও কেউ কেউ (আগেকার কিছু আলেম) এটিকে মাকরুহ বলেছেন। এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ অনেক সময় দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে পড়তে পারে। এজন্য নিরাপদ বিধান হলো হারাম তো বটেই মাকরুহ, এমনকি সন্দেহযুক্ত বিষয়গুলোও পরিহার করা উচিত। কারণ ইসলামে সন্দেহযুক্ত বিষয়কেও বর্জন করতে বলা হয়েছে। হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘হালাল স্পষ্ট এবং হারাম স্পষ্ট। এ দুইয়ের মাঝে আছে সন্দেহজনক বিষয়াবলি। (তা হালাল না হারাম) অনেক মানুষই জানে না। যে ব্যক্তি এসব সন্দেহজনক বিষয় পরিহার করল, সে তার ধর্ম ও স্বাস্থ্য রক্ষা করল। আর যে এসব সন্দেহজনক বিষয়ে লিপ্ত হলো, সে প্রকারান্তরে হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ল।’ (বোখারি ও মুসলিম)। তাছাড়া ধূমপানে তো কোনো উপকারই নেই। আর উপকারহীন বিষয় পরিত্যাগ করাও ইসলামের সৌন্দর্য। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যেসব কথা ও কাজ মানুষের কোনো উপকারে আসে না, তা পরিহার করা তার ইসলামের সৌন্দর্য।’ (মুসলিম)। ফুসফুস বিজ্ঞানী ট্রেন ভিলেন বার্গ বলেন, ‘ধূমপানের মতো মানবসৃষ্ট মহামারি সভ্যতাকে নিশ্চিতভাবে ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।’
অতএব নিজেকে, নিজের পরিবার ও সমাজকে এবং অন্য মানুষকে ধূমের বিষ থেকে থেকে বাঁচানোর জন্য ধূমপানের অভ্যাস থাকলে তা পরিত্যাগ করতে হবে। অপরকেও ধূমপান থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।