৯২তম অস্কার আসরে সেরা সিনেমার পুরস্কার জিতেছে কোরিয়ান ভাষার সিনেমা ‘প্যারাসাইট’। এবারের আসরে মোট ছয়টি বিভাগে মনোনয়ন জিতে এ সিনেমা। এর মধ্যে সেরা সিনেমা, সেরা বিদেশি ভাষার সিনেমা, সেরা পরিচালক ও সেরা মৌলিক চিত্রনাট্য বিভাগে পুরস্কার জিতেছে।
এই প্রথম কোনো কোরিয়ান সিনেমা অস্কার আসরে সেরার খেতাব পেল। শুধু তাই নয়, কিছুদিন আগেই বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র ক্যাটাগরিতে গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড জিতেছিল ‘প্যারাসাইট’। অনুষ্ঠানে পুরস্কার গ্রহণের সময় এ সিনেমার পরিচালক বং জুনুহো বলেছিলেন, ‘আপনার সামনের সাবটাইটেলের দেওয়াল টপকে দেখুন, কী অনন্য ও নান্দনিক একটি সিনেমা জগৎ সে দেয়ালের ওপাশে অপেক্ষা করছে।’
সত্যিই তাই, এ সাবটাইটেলের দেয়ালের ওপাশ থেকে যুগ যুগ ধরে উঁকি মারা সেরা সিনেমাগুলোর মধ্যে বরাবরই কোরিয়ান সিনেমার জুড়ি মেলা ভার। অস্কারের তালিকায়ও এ সময়ের অন্যতম আলোচিত সিনেমা ‘প্যারাসাইট’ নিজস্ব স্থানটি স্বমহিমায় দখল করে নিয়েছে। এ সিনেমা দুটি আলাদা পরিবারের গল্প নিয়ে, যে গল্পের মাধ্যমে পুরো পৃথিবীর অসামঞ্জস্যতা তুলে ধরতে চেয়েছেন পরিচালক। কবি শেলির সেই বিখ্যাত উক্তিটিই যেন বারবার ভেসে এসেছে দৃশ্যপটজুড়ে, ‘ঃযব ৎরপয মবঃ ৎরপযবৎ ধহফ ঃযব ঢ়ড়ড়ৎ মবঃ ঢ়ড়ড়ৎবৎ!’
‘প্যারাসাইট’ সিনেমায় অভিনয় করেছেন সং কাং হো। কোরিয়ান সিনেমার সেরা দশ অভিনেতার তালিকায় বরাবরই তার স্থান থেকে যাবে। এর আগে ‘ম্যামোরি অব মার্ডার’, ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’, ‘সিম্প্যাথি অব মিস্টার ভেঞ্জেন্স’সহ বেশ কয়েকটি সিনেমায় অসাধারণ অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শক মন জয় করে নিয়েছেন তিনি। সং কাং হো এরই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন এ সিনেমায়ও।
সিনেমায় কি উ বাবা, মা আর তার বোনকে নিয়ে রীতিমতো বসবাসের অযোগ্য একটি জায়গায় থাকেন। তাদের ঘর-সংসারের যাবতীয় খরচ নির্ভর করে পিজা ডেলিভারি বক্স র্যাপিং করার ওপর। পরবর্তী সময়ে কি উ এক ধনী পরিবারের মেয়ের গৃহশিক্ষকের চাকরি পেয়ে যায়। আর গৃহশিক্ষক হয়ে আসার পরপরই কি উ তার বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে সেই ধনী পরিবারের কাজের লোকদের জায়গায় নিজের পরিবারের লোকজনদের নিয়ে আসে। এখানে এই ধনী পরিবারে কাজ করতে আসা কি উ-এর পরিবার হয়তো প্যারাসাইট বা পরজীবী, যারা কি না এই ধনী পরিবারের ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে। তবে মোটা দাগে দেখতে গেলে, এ সিনেমায় একটি প্রশ্ন ভেসে আসে আদতে এই পরজীবী আসলে কারা? এই গরিব পরিবার? নাকি অভিজাত সেই পরিবার, যারা নিজদের আভিজাত্যের মোড়কের বাইরে থাকা অসহায় মানুষদের দুঃখ-কষ্ট একদমই উপলব্ধি করতে পারে না?
সিনেমার প্রতিটি পরতে যেন একেকটি চরিত্র নিজেদের মধ্যেই আরেকটি চরিত্র তৈরি করে নেয়। পিঠ ঠেকে যাওয়া দারিদ্র্য আর অনুধাবন পুরো গল্পের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে। এছাড়া বেশ কিছু হাস্যরস থাকলেও সেগুলো আদতে মনে হয় যেন ধনী-গরিবের ব্যবধানের ওপর পরোক্ষ বিদ্রুপ! আবার যখন আসে সিনেমার বাঁকে বাঁকে থাকা টুইস্টগুলোর এক ভিন্ন রূপের কথা, তখন বলতেই হয় নতুন ধরনের এ বাঁকগুলো পরিচালকের এক অনন্য সৃষ্টি। সাধারণত আমরা কাহিনিভিত্তিক টুইস্ট দেখে থাকি। তবে এ সিনেমার অনন্য বিষয় হলো এর চরিত্রগুলোই আদতে এই বাঁকের জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে কাং হো-এর প্রমিত অভিনয় দর্শক একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মুগ্ধতার সঙ্গে দেখেছে। এছাড়া অন্যান্য চরিত্রে থাকা পার্ক সো-ড্যাম, লি সান-গিউন, চো ইউং-জিয়ং এবং অন্যদের অভিনয়ও ছিল সুন্দর এবং প্রাণবন্ত। এছাড়া সিনেমার চিত্রগ্রহণ এতই চমৎকার এবং গল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্য যে, ‘প্যারাসাইট’ দেখতে দেখতে আপনি হয়তো নিজেকে সেই গল্পের কোনো একটি চরিত্র হিসেবে হুট করে আবিষ্কার করে ফেলতে পারেন। ঢুকে পড়তে পারেন এর জলজ্যান্ত এই স্ক্রিনপ্লেতে। পুরো বিষয়টিই এককথায় অসাধারণ বলতে হয়। খুব সাধারণ একটি কাহিনি যেন ধীরে ধীরে জীবন্ত হয়ে ডালপালা প্রশস্ত করে অসাধারণ এক অনন্য কাহিনিতে রূপ নিয়েছে। এখনও যদি সিনেমাটি না দেখে থাকেন তাহলে অবশ্যই ব্যস্ততার মধ্যে একটু সময় বের করে দেখে নিন। কে জানে, হয়তো জীবনকে নতুনভাবে উপলব্ধি করার রসদ পেয়ে যেতেও পারেন।