প্রাণহানির নিরিখে সার্সের ভয়াবহতাকেও ছাপিয়ে গেল করোনা ভাইরাস। চীনে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৯০৮-এ। এ সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা কেউ বলতে পারছে না। কীভাবে মৃত্যু রোখা সম্ভব, তা নিয়েই সন্দিহান চিকিৎসকরা। গোটা বিশ্বে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজারের বেশি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার দাবি, এখনও পর্যন্ত ২৩টিরও বেশি দেশে করোনা ভাইরাস ছড়িয়েছে। বিশ্বজুড়ে জনস্বাস্থ্যে জরুরি অবস্থা জারি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
আতঙ্কে গোটা বিশ্ব। বাংলাদেশও এ নিয়ে উদ্বিগ্ন। তবে আশার বিষয় হলো, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রদত্ত করোনা ঝুঁকিতে থাকা প্রথম ২০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই।
ভয়ের কোনো কারণ না থাকলেও আমাদের ভাইরাস সম্পর্কে ধারণা রেখে মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে হবে। প্রথমে জানতে হবে এটি কোন ধরনের ভাইরাস। এটি করোনা গোত্রের একটি নতুন ভাইরাস, যার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এটি একটি এনভেলপড (আরএনএ) ভাইরাস। এটি সার্স বা মার্স জাতীয় ভাইরাসের চেয়ে একটু ভিন্ন। এটি মূলত বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির মাধ্যমে অন্য মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়। এটি নিয়ে এখনও বিস্তর গবেষণা চলছে। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, বর্তমানে শনাক্তকৃত বেশিরভাগ রোগী উহান শহরের একটি সামুদ্রিক খাবার ও পশুর বাজার থেকে আক্রান্ত হয়েছে।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস, ২০০৩ সালে ৮০০-রও বেশি মানুষের মৃত্যু ও হাজার হাজার মানুষের আক্রান্ত হওয়ার কারণ ‘সার্স’ (সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম) ভাইরাসের পরিবার থেকেই এসেছে এই নতুন ধরনের করোনা ভাইরাস। চীনের বাজারে পাওয়া প্রাণিজ পণ্য বা সামুদ্রিক খাবার থেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। করোনা ভাইরাস বলতে এক গোত্রের অনেকগুলো ভাইরাসকে বোঝায়, যা মূলত প্রাণীদের মধ্যে পাওয়া যায়। বার্ড ফ্লু তথা সার্স ভাইরাসও এ গোত্রের। হিউম্যান করোনা ভাইরাস সংক্রমণটি প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ভাইরাসটির অনেক রকম প্রজাতি আছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা প্রায় ছয়টি করোনা ভাইরাস শনাক্ত করেছেন। হিউম্যান করোনা ভাইরাসের প্রথম খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল ১৯৬০ সালে একজন রোগীর মধ্যে, যিনি সর্দিতে ভুগছিলেন।
মানুষের দেহে ছয় ধরনের করোনা ভাইরাস সংক্রমিত হতে পারে, যথা আলফা করোনা ভাইরাস (NL63 Ges 229E), বিটা করোনা ভাইরাস (HKU1 I OC43) এবং বাকি দুইটি সার্স ও মার্স তাদের প্রাণঘাতী লক্ষণগুলোর জন্য পরিচিত। হিউম্যান করোনা ভাইরাস নির্দিষ্ট কয়েকটি পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করা হয়, যথা মলিকিউলার টেস্ট সক্রিয় সংক্রমণের লক্ষণগুলো খুঁজে বের করতে। সেরোলজি টেস্ট পরীক্ষাটি নজরদারি করার উদ্দেশ্যে। এটি পূর্ববর্তী সংক্রমণ থেকে অ্যান্টিবডিগুলো শনাক্ত করার জন্য করা হয়, যা একজন ব্যক্তির ভাইরাসের ধরন প্রকাশিত করে।
হিউম্যান করোনা ভাইরাস সাধারণত একজন ব্যক্তির শ্বাসনালিকে প্রভাবিত করে। শ্বাসনালিতে সংক্রমিত তরল কাশি বা হাঁচির সময় এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তির মধ্যে চলে যায়। এছাড়া যদি সংক্রমিত ব্যক্তি মুখ না ঢেকে খোলা বাতাসে হাঁচি বা কাশি দেয়, তাহলে ভাইরাসটি বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার অন্য কারণ হলো, সংক্রমিত ব্যক্তির সঙ্গে হ্যান্ডশেক, সংক্রামিত কোনো বস্তুর সঙ্গে নাক বা মুখ একসঙ্গে স্পর্শ করা এবং রোগীর মলমূত্র স্পর্শ করা। এ ভাইরাসের লক্ষণগুলো হলো - ক. সর্দি, খ. গলা ব্যথা, গ. কাশি, ঘ. মাথা ব্যথা, ঙ. জ্বর, চ. হাঁচি, ছ. অবসাদ, জ. শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, ঝ. দেহের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে যাওয়া। তবে মনে রাখতে হবে, ভাইরাসটি শরীরে ঢোকার পর সংক্রমণের লক্ষণ দেখা দিতে প্রায় পাঁচ দিন লাগে। প্রথম লক্ষণ হচ্ছে জ্বর। তারপর দেখা দেয় শুকনো কাশি। এক সপ্তাহের মধ্যে দেখা দেয় শ্বাসকষ্ট। করোনা ভাইরাস মানুষের ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায় এবং শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমেই এটি একজনের দেহ থেকে আরেকজনের দেহে ছড়ায়।
ভাইরাসটি প্রতিরোধে সরকার দেশের বিভিন্ন স্থল, নৌ ও বিমানবন্দরগুলোতে ইমিগ্রেশন ও স্বাস্থ্য ডেস্কগুলোতে সতর্কতা ও রোগের সার্ভেল্যান্স জোরদার করেছে। হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরসহ দেশের বিভিন্ন প্রবেশপথে স্ক্রিনিং-এর ব্যবস্থা নিয়েছে। পাশাপাশি হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরসহ দেশের সাতটি প্রবেশপথে ডিজিটাল থার্মাল স্ক্যানারের মাধ্যমে আক্রান্ত দেশ থেকে আগত রোগীদের স্পর্শ না করে জ্বর পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। নতুন ভাইরাস সম্পর্কে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যবহারের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ রোগ প্রতিরোধী পোশাক (PPE) মজুত রাখা হয়েছে। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ড রেফারেল হাসপাতাল হিসেবে নির্দিষ্ট রাখা হয়েছে। হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে কোয়ারেন্টাইন ওয়ার্ড প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বিমানের ভেতরের আক্রান্ত রোগীদের দ্রুত শনাক্তকরণের জন্য বিমানের ক্রুদের মাধ্যমে যাত্রীদের মধ্যে হেলথ ডিকলারেশন ফর্ম ও প্যাসেঞ্জার লোকেটের ফর্ম বিতরণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
এছাড়া এর চিকিৎসার জন্য বিশেষ ক্লিনিক্যাল ব্যবস্থাপনা প্রণয়ন করা হয়েছে। আইইডিসিআর ল্যাবরেটরিতে এ ভাইরাস শনাক্তরকরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছে।
এরই মধ্যে যেসব ফ্লাইট চীন থেকে এসেছে সেসব ফ্লাইটের যাত্রীদের স্ক্যানিংয়ের পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, তাদের মধ্যে আক্রান্ত কেউ নেই। সুতরাং এ মুহূর্তে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা শূন্য। তবে যে কোনো ভাইরাস নিয়ে যেমন সচেতন থাকাই প্রতিরোধের প্রাথমিক কৌশল, এক্ষেত্রেও সেই কৌশল অবলম্বন করা শ্রেয়। এক্ষেত্রে খাদ্যাভ্যাস একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
২.
আমাদের দেশের লোকেরা যেহেতু চীন কিংবা চীনের মতো অন্য দেশের লোকদের মতো খাদ্য গ্রহণ করে না, সেহেতু আমাদের এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম।
তবে আমাদের দেশে কিছু কিছু মানুষের ভেতরে আধাসিদ্ধ ডিম, আমিষ ও সবজি খাওয়ার প্রবণতা রয়েছে, তাদের এ খাদ্যাভ্যাস পরিহার করতে হবে। আধাসিদ্ধ আমিষ এবং সবজি গ্রহণ থেকে আপাতত বিরত থাকতে হবে।
এ ভাইরাসের কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যায় এবং যারা বয়স্ক তাদের এ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে এবং নিউমোনিয়া বা শ্বাসনালির ব্যাধির মতো মারাত্মক অসুস্থতায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও বেশি থাকে। কেউ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে সাধারণত দুই-এক সপ্তাহ পর এর উপসর্গ দেখা দেয়। এ অবস্থায় রোগীর প্রচুর পরিমাণে তরলজাতীয় খাবার খেতে হবে।
এ ভাইরাসের সঠিক চিকিৎসা এখনও আবিষ্কার করা হয়নি। বেশ কয়েকটি ভ্যাকসিন নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে। তবে অনেকগুলো সহায়ক চিকিৎসা পদ্ধতি এবং ওষুধ রয়েছে যেগুলো এর হালকা থেকে মাঝারি উপসর্গগুলোর চিকিৎসা করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ব্যথা ও জ্বরের চিকিৎসার জন্য ওষুধ বা গলা ব্যথা নিরাময়ের জন্য গরম পানি ইত্যাদি। যে কোনো ভাইরাস থেকে বাঁচতে প্রথমেই যেটা করতে হবে, তা হচ্ছে সেটা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা। এইচআইভি ভাইরাস যেমন যৌনতা বা রক্তের মাধ্যমেই ছড়ায়। হাঁচি, কাশি বা ছোঁয়ার মাধ্যমে নয়। তাই এইচআইভি রোগীর সঙ্গে যেমন মেলামেশা করবেন, বায়ুর মাধ্যমে ছড়ানো ভাইরাস (যেমন করোনা, ইবোলা ইত্যাদি) আক্রান্ত রোগীর সঙ্গে সেভাবে মেলামেশা করবেন না। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট এড়িয়ে চলার চেষ্টা করবেন। মাস্ক পরার চেষ্টা করুন। যে কোনো কিছু ছোঁয়ার আগে অবশ্যই মাথায় রাখবেন সেখানে প্রাণঘাতী জীবাণু থাকতে পারে।
যদি দেখেন আপনার শিশুর জ্বর এসেছে, তাকে স্কুলে পাঠাবেন না। যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলগুলোর নিয়ম হচ্ছে ২৪ ঘণ্টা জ্বরমুক্ত না থাকলে তাকে স্কুলে গ্রহণ করা হয় না। আগের দিন সকাল ১১টায় যদি শেষবারের মতো জ্বর রেকর্ড করা হয়ে থাকে (এ ক্ষেত্রে ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট শরীরের তাপমাত্রা), তবে পরের দিন সকাল ১১টার পর স্কুলে যেতে পারবে। আমাদের দেশের স্কুল কর্তৃপক্ষেরও এ বিষয়ে শিথিলতা প্রয়োজন। এ ছাড়া স্কুলেও যদি কোনো ছাত্রের জ্বর টের পাওয়া যায়, সঙ্গে সঙ্গে তাকে যেন বাড়িতে ফেরত পাঠানো হয়। শিক্ষক-অভিভাবকের যৌথ উদ্যোগেই স্কুল-কলেজ ফ্লুমুক্ত রাখার চেষ্টা করা উচিত। আপনি যদি নিজে অসুস্থ হন, তাহলে অফিসে যাবেন না। আপনার মাধ্যমে অফিসের কারও ফ্লু হতে পারে।
হিউম্যান করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে ক. হাঁচি বা কাশির পর হাত ধুয়ে নিন; খ. কাশি বা হাঁচির আগে মুখ ঢেকে নিন; গ. আপনার যদি মনে হয় যে আপনি সংক্রমিত, তাহলে কোনো ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এড়িয়ে চলুন; ঘ. রান্না না করা গোশত ও ডিম খাওয়া এড়িয়ে চলুন; ঙ. নিজেকে সারাক্ষণ হাইড্রেট রাখুন; চ. লক্ষণগুলো দেখা দেওয়া মাত্রই ওষুধ খান এবং পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে উঠতে দেবেন না; ছ. ধোঁয়াটে এলাকা বা ধূমপান করা এড়িয়ে চলুন; জ. যথাযথ বিশ্রাম নিন; ঝ. ভিড় থেকে দূরে থাকুন; ঞ. স্যানিটাইজার দিয়ে ব্যবহার্য জিনিসপত্র জীবাণুমুক্ত করবেন।
সবাইকে মনে রাখতে হবে, এ মুহূর্তে যেহেতু দেশে এ ভাইরাসে আক্রান্ত কোনো রোগী শনাক্ত হয়নি, তাই মাস্ক কেনার হুজুগে মেতে উঠে সমাজে আতঙ্ক সৃষ্টির কোনো প্রয়োজন নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সর্দি-কাশি-জ্বর হলে ভয় না পেয়ে বাড়তি সতর্কতার সঙ্গে হ্যান্ডেল করুন। নিজে ডাক্তারি ফলাতে যাবেন না। পরিবর্তে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসকের কাছে যান। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরই বোঝা যাবে আপনি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত নাকি নিছক জ্বর-সর্দি-কাশিতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
এরই মধ্যে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (IEDCR) ঝুঁকি সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য ভাইরাস প্রতিরোধ সংক্রান্ত গাইডলাইন প্রস্তুত করেছে। এবং দ্রুত যোগাযোগের জন্য আইইডিসিআরে মোট চারটি হটলাইন চালু করছে। (হটলাইন নম্বরগুলো : ০১৯৩৭০০০০১১/ ০১৯৩৭১১০০১১/ ০১৯২৭৭১১৭৮৪/ ০১৯২৭৭১১৭৮৫)। এসব ফোন ২৪ ঘণ্টা সচল রয়েছে। কেউ নিজের মধ্যে উপসর্গ বা সন্দেহ দেখতে পেলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে।
পিআইডি ফিচার