পুঁজিবাজারে মন্দাভাব কাটাতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও কার্যকর হয়নি কোনোটিই। পুঁজিবাজারের জন্য সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থার যে কোনো ঘোষণার একদিন পর সূচক ঊর্ধ্বমুখী হলেও তারপর আবার সেই পতন। তবে এবার পুঁজিবাজারের পতন রুখে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে উদ্যোগী হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য তালিকাভুক্ত ব্যাংকসহ ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে পুঁজিবাজারে সক্রিয় করতে গঠন করেছে বিশেষ তহবিল। এমন ঘোষণার পরই সুবাতাস বইছে পুঁজিবাজারে। তবে বাজারে বিনিয়োগকারীরা বলছেন, শুধু তহবিল ঘোষণা দিয়ে পুঁজিবাজারের আস্থা ফেরানো সম্ভব নয়। বরং তহবিল যেন পুঁজিবাজারে ব্যবহৃত হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। পুঁজিবাজার গতিশীল করতে বাংলাদেশ ব্যাংক যে বিশেষ তহবিল গঠন করছে, তা থেকে ডিলার লাইসেন্সধারী ব্রোকার হাউজ এবং মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো সুবিধা পাবে। আলোচ্য তহবিলের আওতায় প্রতিটি ব্যাংক ২০০ কোটি টাকার সুবিধা নিতে পারবে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো চাইলে নিজস্ব উৎস থেকে এ তহবিল গঠন করতে পারবে। আবার ব্যাংকের ধারণকৃত ট্রেজারি বিল বা ট্রেজারি বন্ড রেপোর মাধ্যমেও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তহবিল সংগ্রহ করতে পারবে। আবার প্রথমে নিজস্ব উৎস থেকে তহবিল গঠন করে পরবর্তীতে ট্রেজারি বিল বা ট্রেজারি বন্ডের রেপোর মাধ্যমেও তা সমন্বয় করার সুযোগ দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, বিশেষ তহবিলের ২০ শতাংশ অর্থসংশ্লিষ্ট ব্যাংকের নিজস্ব সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে বিনিয়োগের জন্য নতুন পোর্টফোলিও গঠনে ঋণ দিতে হবে। আর ৩০ শতাংশ অর্থে ঋণ দিতে হবে অন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পুঁজিবাজারসংক্রান্ত সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে। অন্যদিকে ১০ শতাংশ অর্থ সংরক্ষিত রাখতে হবে অন্য ব্রোকার হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংককে ঋণ দেওয়ার জন্য।
এ বিষয়ে ডিএসইর সাবেক প্রেসিডেন্ট মো. রকিবুর রহমান বলেন, গেল বছর থেকেই পুঁজিবাজারে যে মন্দা চলছে, তা কাটানোর জন্য প্রধান কাজ হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা ফেরানো। এ আস্থা ফেরানোর সম্ভব না হলে পুঁজিবাজারে তারল্য সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। পুঁজিবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা তৈরি হলে একদিকে যেমন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা নতুন বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন, অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও বিনিয়োগ করবে।
তিনি বলেন, পুঁজিবাজার উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ তহবিল গঠনের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নেওয়া উদ্যোগের বাস্তবায়ন আরও এক ধাপ এগিয়েছে। এছাড়া অর্থমন্ত্রী রাষ্ট্রায়ত্ত কিছু প্রতিষ্ঠানকে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছেন। একই সঙ্গে কিছু বিমা কোম্পানিও পুঁজিবাজারে আসার কথা রয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে এটি খুবই ভালো উদ্যোগ। এখন সেই অনুযায়ী পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা ধরে রাখা জরুরি।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক দেবব্রুত কুমার সরকার আলোকিত বাংলাদেশকে জানান, ফেব্রুয়ারির প্রথম থেকেই মূলত পুঁজিবাজারে পতন থেকে ভালো অবস্থায় যেতে শুরু করেছে। এর আগে নতুন বছরের শুরু থেকেই পুঁজিবাজারে আস্থাহীনতা, তারল্য সংকট প্রকট আকারে দেখা গেছে। তখন মূলত বিনিয়োগকারীরা নতুন বিনিয়োগ না করে বিনিয়োগ উত্তোলনে বেশি মনোযোগী ছিলেন। একই সঙ্গে পুঁজিবাজার মন্দা থাকায় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও নতুন বিনিয়োগ করেননি। এতে মন্দা আরও দীর্ঘায়িত হয়েছে। তিনি বলেন, এখন বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বশেষ যে নিদের্শনা দিয়েছে, সেটি পুঁজিবাজারবান্ধব। একই সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীসহ ব্যাংকগুলোয় নতুন বিনিয়োগের জায়গা তৈরি হয়েছে। এ নির্দেশনা যথাযথভাবে কার্যকর হলে পুঁজিবাজারের তারল্য সমস্যা অনেকাংশেই সমাধান হবে। একই সঙ্গে অর্থমন্ত্রী রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ বিমা কোম্পানির তালিকাভুক্তি নিয়ে ইতিবাচক বক্তব্য দিয়েছেন, যা বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারের প্রতি আস্থাশীল হবেন। চলমান তারল্য সমস্যা কেটে যাবে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক পুঁজিবাজারবান্ধব যে নিদের্শনা দিয়েছে; সেটি ব্যাংক, নন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেন যথাযথভাবে পরিপালন করে, সেদিক নজর দিতে হবে, তা না হলে সরকার যে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এ তহবিল গঠন করেছে, সেটি বিনিয়োগকারীদের কোনো কাজেই আসবে না।
সোমবারের পুঁজিবাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এদিন ডিএসই প্রধানসূচক ডিএসইএক্স ৮৫ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৪৭১ পয়েন্টে। অন্য সূচকগুলোর মধ্যে ডিএসইএস বা শরিয়া সূচক ১৩ পয়েন্ট বেড়ে অবস্থান করছে ১ হাজার ৩০ পয়েন্টে এবং ডিএস৩০ সূচক ২৫ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫১৭ পয়েন্টে। ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৫০৫ কোটি ৮৫ লাখ টাকা, যা গেল কার্যদিবস থেকে ১৬৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা বেশি। রোববার লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৩৪০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। লেনদেনে অংশ নেওয়া মোট ৩৫৬টি কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ২৯৬টির, কমেছে ৪০টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ২০টির। অন্যদিকে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ২৫১ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৬৩২ পয়েন্টে। সিএসইতে টাকার অঙ্কে ৩০ কোটি ৩৩ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে।
বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী সম্মিলিত জাতীয় ঐক্যের সভাপতি আ ন ম আতাউল্লাহ নাঈম জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, সেটি পুঁজিবাজারবান্ধব। এখন সেটি যেন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহার করে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে আসে, সেদিকেও নজর দেওয়া জরুরি।
তিনি বলেন, জানুয়ারি মাসের তুলনায় ফেব্রুয়ারিতে পুঁজিবাজারে লেনদেন বেড়েছে। আগে যেখানে ২০০ কোটি টাকার কিছু বেশি লেনদেন হতো, এখন সেটি ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। তবে এখনও অনেক কোম্পানির শেয়ারের দর আগের মতোই নিম্নমুখী। বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন নির্দেশনার পর কয়েক দিন শেয়ারের দাম বাড়ল আবার পতন শুরু হলে এতে দীর্ঘ সময় ধরে যারা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে রেখেছেন, তাদের কোনো উপকার হবে না। তাই শেয়ারের দাম বাড়লে মূল্য সংশোধন হবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই মূল্য সংশোধনের নামে সূচকের পতন যেন দীর্ঘ সময় ধরে অব্যাহত না থাকে, সেদিকেও নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজর দেওয়া উচিত।