আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ১২-০২-২০২০ তারিখে পত্রিকা

পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে অপারেটর নিয়োগে তোড়জোড়

নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল

নিজস্ব প্রতিবেদক
| শেষ পাতা

চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে কনটেইনারবাহী জাহাজের জট বাড়ছেই। মাত্র একটি অপারেটর দিয়ে কনটেইনার হ্যান্ডলিং করায় এ অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অপারেটর সংখ্যা না বাড়িয়ে একই প্রতিষ্ঠানকে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালে অপারেটর হিসেবে নিয়োগ দিতে তোড়জোড় শুরু করেছে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়। অথচ সম্প্রতি একনেক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, টেন্ডার ডকুমেন্ট এমনভাবে তৈরি করা যাবে না, যাতে বড় বড় প্রতিষ্ঠানই বারবার কাজ পায়। ছোট এবং অন্য কোম্পানিকেও কাজের সুযোগ করে দিতে হবে। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন একটু সহজ করতে হবে। যাতে নতুনরাও কাজ পায়, প্রতিযোগিতাও হয়। প্রতিযোগিতা না থাকায় একই প্রতিষ্ঠানকে বারবার কাজ দেওয়ায় বন্দরে সেবার মান অবনতি ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ অপচয় হতে পারে বলে মনে করছেন আমদানি-রপ্তানিকারক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। নৌপ্রতিমন্ত্রী ও মন্ত্রীপরিষদ সচিবের কাছে প্রতিকার চেয়ে আবেদন করেন ব্যবসায়ীরা।
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি ক্রয় আইন ও ক্রয় নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হচ্ছে। রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার প্রভাবে সরকারি খাতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানদ-ে অগ্রহণযোগ্য এ অনিয়ম হচ্ছে। চূড়ান্ত বিবেচনায় এর বোঝা জনগণকে বইতে হবে। সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছিল দেশের সব ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা এবং জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে দুর্নীতির পথগুলোকে সম্ভাব্য সব উপায়ে বন্ধ করা। একই সঙ্গে সব খাতে সবার জন্য সমান প্রতিযোগিতামূলক সুযোগ নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। কিন্তু বিশেষ প্রভাবে সরকারি ক্রয় নীতিমালার লঙ্ঘন ঘটিয়ে কোনো প্রকার নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে যদি কোনো বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে একতরফাভাবে কাজ দিয়ে দেওয়া হয়, তবে তা দেশের আইনের যেমন লঙ্ঘন, তেমনি জনগণের সঙ্গে প্রতারণার সামিল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে জেনারেল কনটেইনার বার্থে (জিসিবি) ছয়টি বার্থ রয়েছে এবং ছয়টি অপারেটর বার্থ প্রতিযোগিতামূলকভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) ও নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) এ দুটি টার্মিনালে বার্থের সংখ্যা সাতটি, যা মাত্র একজন বার্থ অপারেটর পরিচালনা করে আসছেন। দুটি টার্মিনালের সাতটি বার্থে মাত্র একজন অপারেটর থাকায় কনটেইনার লোডিং-আনলোডিংয়ের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিযোগিতা হয় না। যে কারণে এ দুটি টার্মিনালে জাহাজের গড় অবস্থান জিসিবির তুলনায় অনেক বেশি। দুটি টার্মিনাল তৈরির সময় দুইজন পৃথক অপারেটর নিয়োগ দেওয়ার প্রয়োজন থাকলেও তা করা হয়নি। ফলে একজন অপারেটরের মাধ্যমে দুটি টার্মিনাল পরিচালনা করায় বন্দর ব্যবহারকারীরা কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছে না। ব্যবহারকারীদের অভিযোগ, দুটি গুরুত্বপূর্ণ টার্মিনাল পরিচালনার জন্য একটি মাত্র প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়ায় কনটেইনার লোডিং-আনলোডিংয়ের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিযোগিতা হয় না। এতে ওই প্রতিষ্ঠানের স্বেচ্ছাচারিতার কাছে বন্দর, শিপিং এজেন্ট, আমদানি-রপ্তানিকারকরা জিম্মি হয়ে পড়েছেন। সংশ্লিষ্টরা বিভিন্ন সময় এর প্রতিবাদ করলেও কোনো প্রতিকার পাননি। 
২০০৭ সালে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডকে কোনো টেন্ডার ছাড়াই চট্টগ্রাম কনটেইনার টার্মিনালের (সিসিটি) কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের কাজ দেয়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠান এককভাবে কাজ করতে থাকে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সিসিটির কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য দরপত্র আহ্বান করে। এ দরপত্রে এমন শর্ত আরোপ করা হয়, যাতে আর কোনো প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। এর ফলে গেল ২৮ আগস্ট চট্টগ্রাম বন্দরের চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) পরিচালনায় ৬ বছরের জন্য নিয়োগ পায় সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড। সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ দেওয়ার প্রস্তাব অনুমোদন দেয়।
সভা শেষে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের বলেন, এ প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তবে আরও সোর্স খুঁজে বের করা কিংবা সরকার নিজেই এ কাজটি করতে পারে কি না, সেটা খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে। কারণ একটি মাত্র সোর্স থেকে সেবা গ্রহণ করায় অনেক সময় ঝুঁকি থাকে।
অর্থমন্ত্রী জানান, সিসিটিতে অপারেটর নিয়োগের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হলে চারটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র কিনলেও একটি প্রতিষ্ঠানই শুধু তা দাখিল করে। টিইসি কর্তৃক মূল্যায়িত ও সুপারিশকৃত সাবলিমেন্টারি রেসপনসিভ হিসেবে সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডকে ৬ বছরের জন্য টার্মিনাল অপারেট নিয়োগের কাজ সর্বসম্মতিক্রমে দেওয়া হয়। এরপর একইভাবে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) অপরাটের নিয়োগ দিতে প্রক্রিয়া শুরু করে চট্টগ্রাম বন্দর। এখানেও একইভাবে কর্মকর্তাদের যোগসাজসে একটি কোম্পানিকে কাজ দিতে দরপত্রে সব রকম শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়, যাতে পছন্দের ওই কোম্পানির বাইরে কোনো কোম্পানি আবেদন করতে না পারে।
দরপত্র বাতিল করে অপারেটর নিয়োগের শর্ত শিথিলের দাবি জানিয়ে ৫ ফেব্রুয়ারি নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী ও মন্ত্রী পরিষদ সচিব বরাবর আবেদন করেছে এভারেস্ট পোর্ট সার্ভিসেস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক জামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী মন্ত্রী পরিষদ সচিব ও পরিচালক মো. সহিদ হোসেন পৃথকভাবে প্রতিমন্ত্রী বরাবর চিঠির মাধ্যমে এ আবেদন করেন। আবেদনে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালে (এনসিটি) অপারেটর নিয়োগের দরপত্র বাতিল করে নতুন দরপত্র আহ্বানের অনুরোধ জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। 
চিঠিতে বলা হয়, চট্টগ্রাম বন্দরে কার্গো এবং কনটেইনার হ্যান্ডলিং করার জন্য আইন ও বিধি অনুসারে স্টিভিডোরিং লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান নিয়োজিত ছিল। ২০০৭ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে সংস্কার কর্মসূচির আওতায় লাইসেন্সধারী স্টিভিডোরিং প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যোগ্য, দক্ষ ও সুনামধারী প্রতিষ্ঠান বাছাই করে জেটিতে বার্থ অপারেটর এবং বহির্নোঙরে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর পদ্ধতি চালু করে, যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৭ সালের ২৮ নভেম্বর বার্থ অপারেটর সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে ওই গেজেট পরিবর্তন করে ২০১৮ সালের ১০ মে টার্মিনাল অপারেটরের সংজ্ঞা সংযোজন করে নতুন গেজেট প্রকাশিত হয়। বিশ্বব্যাপী টার্মিনাল অপারেটরের সংজ্ঞার সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল অপারেটরের সংজ্ঞার কোনো মিল নেই। সারা পৃথিবীতে টার্মিনাল অপারেটর টার্মিনাল তৈরি করা, যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা ও ট্যারিফ নির্ধারণ করাসহ যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করে। বাংলাদেশে টার্মিনাল নির্মাণ, যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও ট্যারিফ নির্ধারণের ক্ষমতা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের। এখানে টার্মিনাল অপারেটর শুধু জনবল সরবরাহ করে জাহাজে কনটেইনার লোডিং-আনলোডিংসহ কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করে।