এ জন্য দরকার হৃদয়কে আল্লাহর ভালোবাসায় গড়ে তোলা। আল্লাহর উলুহিয়্যাহ ও রুবুবিয়্যাহ তথা একমাত্র তিনিই পালনকর্তা ও ইবাদতের উপযুক্ত হওয়ার বিশ্বাসের সঙ্গে তাঁর গুণবাচক নামগুলোতে দৃঢ় ঈমান আনা তথা খাঁটি তাওহিদ বাস্তবায়ন করা। পাশাপাশি মোত্তাকি তথা আল্লাহভীরুদের জন্য তিনি সম্মানের আবাসে কত নেয়ামত ও পুরস্কার প্রস্তুত রেখেছেন এবং অবাধ্যদের জন্য কী শাস্তি ও মর্মন্তুদ পরিণতি অপেক্ষা করছে এ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা
এক শ্রেণির মানুষ আছে পার্থিব জীবনের প্রবঞ্চনা এবং পৃথিবীতে অমরত্বের বাসনা সর্বোপরি প্রবৃত্তির অনুসরণ ও বিশুদ্ধ বিশ্বাস সম্পর্কে অজ্ঞতা যাদের উদ্বুদ্ধ করে এমন সব কিছুকে ভয় করতে, যাকে সে হতবাক করা হুমকি মনে করে অথবা তার উঠানে নেমে আসা অমঙ্গল কিংবা তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন বা প্রয়োজন পূরণের পথে বাধা হিসেবে দেখতে পায়। বিপরীতে আল্লাহর কিছু বান্দা আছে যারা মধ্যম পথে চলেন এবং সিরাতে মুস্তাকিমে মধ্যমতালে হাঁটেন। অস্থির ও দোদুল্যমানদের পথ থেকে দূরে সরে এবং দুর্বল বিশ্বাস ও সংশয়বাদীদের পথপাশে রেখে। তারা হলেন ওইসব ব্যক্তি যারা আল্লাহ তায়ালা পানে তাঁর পথিকদের পদাঙ্ক মাফিক চলেন। যারা এগিয়ে আসেন আল্লাহর দিকে।
এরা আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় পান না। তিনি ছাড়া কারও কাছে কিছু আশাও করেন না। এরা হলেন ওইসব ব্যক্তি, যারা জেনে গেছেন যে, ভয়ের স্তরটি আল্লাহর ইবাদতকারী ও তাঁর সাহায্যপ্রার্থীদের সবচেয়ে মর্যাদার পদ। এ ভয় আত্মার জন্য সবচেয়ে বেশি উপকারী। ইহ-পরকালে সৃষ্টির জীবনে এটি সবচেয়ে বড় প্রভাবক। এটি বরং প্রত্যেক আদম সন্তানের জন্য ফরজ। আল্লাহ তায়ালা বলেন ‘এরা যে রয়েছে, এরাই হলো শয়তান, এরা নিজেদের বন্ধুদের ভীতি প্রদর্শন করে। সুতরাং তোমরা তাদের ভয় করো না। বরং আমাকে ভয় কর, যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাক।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৭৫)। মহান আল্লাহ আরও বলেন ‘অতএব, তোমরা মানুষকে ভয় করো না এবং আমাকে ভয় কর।’ (সূরা মায়িদা : ৪৪)।
তেমনি আল্লাহ তায়ালা এই ভয়সম্পন্নদের বন্দনা ও স্তুতি তুলে ধরেছেন নিজের বাণীতে ‘নিশ্চয় যারা তাদের পালনকর্তার ভয়ে সন্ত্রস্ত, যারা তাদের পালনকর্তার কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে, যারা তাদের পালনকর্তার সঙ্গে কাউকে শরিক করে না। এবং যারা যা দান করবার, তা ভীত, কম্পিত হৃদয়ে এ কারণে দান করে যে, তারা তাদের পালনকর্তার কাছে প্রত্যাবর্তন করবে, তারাই কল্যাণ দ্রুত অর্জন করে এবং তারা তাতে অগ্রগামী।’ (সূরা মোমিনুন : ৫৭-৬১)।
এটা এজন্য যেমনটা হাসান বসরি (রহ.) বলেছেন ‘তারা নেক কাজ করেছে, এতে কষ্ট-সাধনা করেছে। তথাপি তারা ভয় করেছে সেগুলো প্রত্যাখ্যাত হয় কিনা।...’ বস্তুত, মোমিন ব্যক্তি সৎকর্ম করে আবার পাশাপাশি ভয়ে ভয়ে থাকে। পক্ষান্তরে মোনাফেক মন্দ কর্ম করে আবার শাস্তি থেকে নিরাপদ মনে করে। আল্লাহ তায়ালা মোমিনের এ গুণের প্রশংসা করেছেন। এই একই গুণে গুণান্বিত বলে নৈকট্যশীল ফেরেশতাদেরও প্রশংসা করেছেন তিনি। এরশাদ করেছেন ‘তারা তাদের ওপর পরাক্রমশালী নিজেদের পালনকর্তাকে ভয় করে এবং যা আদেশ করা হয় তারা তা পালন করে।’ (সূরা নাহল : ৫০)। সব নবীর প্রশংসা করতে গিয়েও তাদের এ গুণে গুণান্বিত বলে আখ্যায়িত করেছেন। আল্লাহ বলেছেন ‘সেই নবীরা আল্লাহর পয়গাম প্রচার করতেন এবং তাঁকে ভয় করতেন। তারা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে ভয় করতেন না। আর হিসাব গ্রহণের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।’ (সূরা আহজাব : ৩৯)।
আর আল্লাহর এ ভয় যেহেতু আল্লাহর মারিফত (পরিচয়) ও ইলমের (জ্ঞানের) সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তাই এ মারেফাত ও ইলম অনুপাতেই ভেতরে আল্লাহর ভয় ও ভক্তি তৈরি হয়। এ কারণে আল্লাহর রাসুল (সা.) ছিলেন সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে বেশি আল্লাহর ভয় ও তাকওয়াসম্পন্ন। যেমনটি প্রতিভাত হয় সহিহ গ্রন্থে সংকলিত বোখারির হাদিসে নবীজি (সা.) এর কথায় ‘আল্লাহর কসম, আমি তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আল্লাহকে জানি এবং তাদের মধ্যে আমি সবচেয়ে বেশি আল্লাহকে ভয় করি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি যা জানি তোমরা যদি তা জানতে, তবে তোমরা কম হাসতে এবং বেশি কাঁদতে এবং বিছানায় তোমরা স্ত্রীদের সঙ্গে আনন্দ উপভোগ করতে না। (বরং) তোমরা আল্লাহ তায়ালার আশ্রয় নেওয়ার জন্য পথে পথে বের হয়ে যেতে।’ (ইমাম আহমাদ তার মুসনাদ ও তিরমিজি জামে গ্রন্থে হাসান সূত্রে বর্ণনা করেছেন)।
এজন্যই আল্লাহ তায়ালা আলেমদের প্রশংসায় বলেছেন তারা আল্লাহকে যথার্থ ভয় করেন। আল্লাহ সুবহানাহু বলেন, ‘অনুরূপভাবে বিভিন্ন বর্ণের মানুষ, জন্তু, চতুষ্পদ প্রাণী রয়েছে। আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে আলেমরাই শুধু তাঁকে (যথার্থ) ভয় করে। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী ক্ষমাময়।’ (সূরা ফাতির : ২৮)। আলেমদের মাঝে এ ভয় তৈরি হয়, কারণ তারা জানতে পারেন, একমাত্র আল্লাহই পুরো বিশ্বচরাচরের অধিপতি। তাঁর হাতেই আসমান-জমিনের চাবি। সব কাজের প্রত্যাবর্তন তাঁরই দিকে। যাবতীয় সৃষ্টির সব কর্মের তিনিই নির্বাহী। এমন চিরঞ্জীব, যার মৃত্যু নেই। এমন চিরস্থায়ী, যার ওপর সব মাখলুক নির্ভরশীল। সবাই যার মুখাপেক্ষী। তিনি ছাড়া অন্য সবাই এর বিপরীত। কারণ তারা অক্ষম, তারা নিজেরই ভালো-মন্দ, জীবন-মৃত্যু-পুনরুত্থানের ক্ষমতা রাখে না। বরং সব মাখলুক শুধু আল্লাহ যা লিখেছেন এবং তকদির রচনা করেছেন তার মাধ্যম। যেমন জামে গ্রন্থে সংকলিত ইমাম তিরমিজির হাদিসে বিষয়টি পরিষ্কার তুলে ধরা হয়েছে। ইমাম আহমাদ তার মুসনাদ এবং ইমাম হাকেম তার মুস্তাদরাক গ্রন্থেও সহিহ সনদে হাদিসটি সংকলন করেছেন। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আমি একদা (সওয়ারিতে) রাসুলুল্লাহ (সা.) এর পেছনে (বসে) ছিলাম। তিনি বললেন, ‘ওহে কিশোর! আমি তোমাকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা শিক্ষা দেব (তুমি সেগুলো স্মরণ রেখো)। তুমি আল্লাহর (বিধানগুলোর) রক্ষণাবেক্ষণ কর (তাহলে) আল্লাহও তোমার রক্ষণাবেক্ষণ করবেন। তুমি আল্লাহর (অধিকারগুলো) স্মরণ রাখ, তাহলে তুমি তাঁকে তোমার সম্মুখে পাবে। যখন তুমি চাইবে, তখন আল্লাহর কাছেই চাও। আর যখন তুমি প্রার্থনা করবে, তখন একমাত্র আল্লাহর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা কর। আর এ কথা জেনে রাখ যে, যদি সমগ্র উম্মত তোমার উপকার করার জন্য একত্রিত হয়ে যায়, তবে ততটুকুই উপকার করতে পারবে, যতটুকু আল্লাহ তোমার (তকদিরে) লিখে রেখেছেন। আর তারা যদি তোমার ক্ষতি করার জন্য একত্রিত হয়ে যায়, তবে ততটুকুই ক্ষতি করতে পারবে যতটুকু আল্লাহ তোমার (তকদিরে) লিখে রেখেছেন। কলমগুলো উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং খাতাগুলো (তকদিরের লিপি) শুকিয়ে গেছে।’
স্মর্তব্য, এই ভয় কিন্তু মূল লক্ষ্য নয়। বরং অন্য এক বিষয়ের লক্ষ্য। ফলে ভয় ওসিলা ও উপলক্ষ, লক্ষ্য বা গন্তব্য নয়। কেননা ভয়ের বিষয় উঠে গেলে ভয়ও উঠে যাবে। তাই তো জান্নাতের অধিবাসীদের অবস্থা এমন হবে যে, তাদের কোনো ভয় থাকবে না, অস্থিরতাও থাকবে না। শাস্তির ভয় উঠে যাওয়ার কারণে এবং আল্লাহর দয়ায় পুণ্য ও পুরস্কারের আবাস জান্নাতে প্রবেশের কারণে।
অতএব আমাদের কর্তব্য হবে, আল্লাহর এ ভয় অর্জনের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা ও পূর্ণ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। এ জন্য দরকার হৃদয়কে আল্লাহর ভালোবাসায় গড়ে তোলা। আল্লাহর উলুহিয়্যাহ ও রুবুবিয়্যাহ তথা একমাত্র তিনিই পালনকর্তা ও ইবাদতের উপযুক্ত হওয়ার বিশ্বাসের সঙ্গে তাঁর গুণবাচক নামগুলোতে দৃঢ় ঈমান আনা তথা খাঁটি তাওহিদ বাস্তবায়ন করা। পাশাপাশি মোত্তাকি তথা আল্লাহভীরুদের জন্য তিনি সম্মানের আবাসে কত নেয়ামত ও পুরস্কার প্রস্তুত রেখেছেন এবং অবাধ্যদের জন্য কী শাস্তি ও মর্মন্তুদ পরিণতি অপেক্ষা করছে এ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা। সর্বোপরি সবসময় অন্তরকে অবাধ্যতা থেকে রক্ষা, সব ধরনের বাতিল থেকে দূরে রাখা এবং সরল পথে অবিচল রাখতে আত্মপর্যালোচনা অব্যাহত রাখা।
আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন ‘আমি তওরাত অবতীর্ণ করেছি। এতে হেদায়াত ও আলো রয়েছে। আল্লাহর আজ্ঞাবহ পয়গম্বর, দরবেশ ও আলেমরা এর মাধ্যমে ইহুদিদের ফয়সালা দিতেন। কেননা, তাদের এ খোদায়ি গ্রন্থের দেখাশোনা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল এবং তাঁরা এর রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত ছিলেন। অতএব, তোমরা মানুষকে ভয় করো না এবং আমাকে ভয় কর এবং আমার আয়াতগুলোর বিনিময়ে স্বল্পমূল্যে গ্রহণ করো না, যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফায়সালা করে না, তারাই কাফের।’ (সূরা মায়িদা : ৪৪)।
২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১ হিজরি মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার
সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর আলী হাসান তৈয়ব