‘প্রকৃতিতে লেগেছে আজ ফাগুনের হাওয়া, ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু নেই চাওয়া।’
ফাগুনে প্রকৃতি আজ প্রাণবন্ত। গাছে গাছে ফুটেছে শিমুল পলাশ। প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে বসন্ত আর ভালোবাসার ছোঁয়া লেগেছে তরুণ-তরুণীর বেশভুশায়। সুদীর্ঘকাল থেকে বাংলাদেশের সংস্কৃতির অংশ হিসেবে উন্মাদনায় বসন্ত উৎসব পালিত হচ্ছে। বাংলা পঞ্জিকা পরিবর্তনে ১ ফাল্গুন আর ভালোবাসা দিবস আজ শুক্রবার একই দিন। ভালোবাসা দিবস বা সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স দিবস পশ্চিমা দুনিয়ায় প্রচলন বহুকাল ধরে। গেল শতাব্দীর শেষ দশকে ভালোবাসা দিবসের হাওয়া লাগে বাংলাদেশেও। আজ বাঙালির বসন্ত দিনের সঙ্গে ভালোবাসা দিবস মিলেমিশে একাকার। উৎসবের দুইটি দিবস একই দিনে পালিত হতে যাওয়ায় উৎসাহ উন্মাদনাও দ্বিগুন।
পাতাঝরা শীতের রুক্ষতা কাটিয়ে দখিনা বাতাসের দোলায় তরুণ-তরুণীর মন উদ্বেলিত। ভালোবাসার কথা বলতে আজ তাদের হৃদয় ব্যাকুল। ফুল আর উপহারসামগ্রীর দোকানগুলোতে ভীড় জমেছে। মুঠোফোনে, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেইসবুকে আগাম শুভেচ্ছা শুরু হয়েছে গেল রাত থেকেই। দূরত্বে থাকা ভালোবাসার মানুষকে উপহার পাঠিয়েছেন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে। শুক্রবার দিনভর রেস্তোরাঁয়, পার্কে, শপিং মলে, রাজপথে থাকবে তরু-তরুণীদের ভিড়। দখিনা বাতাসের দোলা লেগেছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতেও।
ভালোবাসার দিন নিয়ে অজস্র কবিতা আর গান সুরে-বেসুরে শোনানো হবে প্রিয়জনকে। প্রিয়তমার হাত ধরে কিংবা পাশে বসে অনেকেই রচনা করবে নিজেদের ভবিষ্যৎ। হয়তো এদিনেই বিভেদ ভুলে মিলন হবে দুইজনের। মুঠোফোনের মেসেজ, ই-মেইল অথবা ফেইসবুকের চ্যাটিংয়ে খুঁজে পাবে ভালোবাসার ঠিকানা। হৃদয়ের ব্যাকুলতা জানানোর যেমন রয়েছে বিভিন্ন উপলক্ষ, তেমনি ভিন্নতা রয়েছে প্রকাশ ভঙ্গিতেও। সময়, স্থান, ব্যক্তিভেদে রয়েছে ভালোবাসার রকমফের। প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্য কবিতা, গান আর পঙ্ক্তিমালায় অব্যক্ত ভালোবাসা প্রকাশের পথ খুঁজে নেয় শাশ্বত প্রেম। এ বছর বাংলা দিনপঞ্জিতে পরিবর্তন আসায় পয়লা ফাল্গুন পিছিয়েছে একদিন। তারপরও চিরায়ত নিয়মের রেশ তো সহজে মুছে না। তাই তো প্রতিবছরের মতো এবারও ১৩ ফেব্রুয়ারি বাসন্তী সাজে সেজেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, কলাভবন, বটতলা সবখানেই চোখে পড়ছে বসন্তের আমেজ। অনেকেই সেজেছেন বাসন্তী সাজে। বন্ধুরা সবাই মিলে আনন্দ-হুল্লোড়ে মেতে উঠেছেন।
প্রতিবছর ১ ফাল্গুনে বটতলায় বসন্ত উৎসবের আয়োজন হলেও এ বছর একদিন আগেই হচ্ছে এ উৎসব। মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার এ উৎসবে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন। শুক্রবার বিশ্ববিদ্যালয় এবং অফিস-আদালত ছুটি হওয়ায় একদিন আগেই তারা বসন্ত বরণ উৎসবের আয়োজন করেছেন বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা। ঋতুরাজ বসন্ত আসার একদিন আগেই উৎসবের আয়োজন করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) চারুকলা পরিবার। বৃহস্পতিবার থেকে দুই দিনব্যাপী বসন্তবরণ ও পিঠা উৎসব আয়োজন করেছে চারুকলার শিক্ষার্থীরা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুক্রবার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকবে বিধায় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃহস্পতিবারই বসন্ত বরণ উৎসবের আয়োজন করেছে।
বসন্ত উৎসব দীর্ঘকাল বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হিসেবে উদযাপিত হচ্ছে। কিন্তু ভালোবাসা দিবসের পেছনের যে গল্প, তা আত্মদানের গল্প। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার তথ্যমতে, রোমান সম্রাট ক্লডিয়াস সেনাবাহিনীতে লোকবল বাড়াচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি ঘোষণা দিলেন, কোনো যুবক আর বিয়ে করতে পারবেন না। এ অদ্ভূত ঘোষণার বিরোধিতা করে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন গোপনে যুবকদের বিয়ের আয়োজন চালিয়ে যেতে লাগলেন। একসময় ধরা পড়ে গেলেন ভ্যালেন্টাইন, নিক্ষিপ্ত হলেন কারাগারে। এর মধ্যে ভ্যালেন্টাইন মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছেন কারারক্ষীর মেয়েটিকে। এর কিছুদিন পর ২৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি সম্রাটের নির্দেশে ভ্যালেন্টাইনের শিরñেদ করা হয়। কথিত আছে, ওই দিনই প্রথম তিনি মেয়েটিকে এক চিঠিতে জানান তার ভালোবাসার কথা। চিঠির নিচে লেখেন, ‘ইতি, তোমারই ভ্যালেন্টাইন’। দিনটিকে ইউরোপে পরিচিত করে তোলেন জিওফ্রে চসার চতুর্দশ শতকে। ৪৯৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম পোপ জুলিয়াস ঘোষণা করেন ভ্যালেনটাইন ডে। পরে এর ব্যাপ্তি ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে পৌঁছায় চীন, জাপান, ভারত ও বাংলাদেশের মতো এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও। বাংলাদেশে দিনটিতে ফুলের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো নানা আনন্দ আয়োজনের উদ্যোগ নেয়। অনেক কপোতকপোতি এ দিনে খুঁজে পেয়েছে তার ভালোবাসার ঠিকানা।