প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনসার বাহিনীকে দেশের সর্ববৃহৎ বাহিনী অভিহিত করে তাদের সততা, আন্তরিকতা এবং সাহসিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে জনগণের সুরক্ষা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা চাই আপনারা (আনসার বাহিনী) দেশের সর্ববৃহৎ বাহিনী হিসেবে আপনাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সততা, আন্তরিকতা ও সাহসিকতার সঙ্গে পালন করে জননিরাপত্তার ক্ষেত্রে অশুভ শক্তিকে পরাজিত করতে সমর্থ হবেন। বৃহস্পতিবার গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার সফিপুর আনসার একাডেমিতে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর ৪০তম জাতীয় সমাবেশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা যখন দেশ স্বাধীন করেছিলেন, তখন বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা এমন ছিল যে, ৮২ ভাগের ওপর মানুষ দরিদ্র সীমার নিচে বাস করত। জাতির পিতা যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজ হাতে নিয়েছিলেন। সময় পেয়েছিলেন মাত্র সাড়ে ৩ বছর। আমাদের দুর্ভাগ্য ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। তারপর থেকে আমাদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে আমরা পৌঁছাতে পারিনি। ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর জনগণের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ব্যাপকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আজকে দারিদ্যসীমা আমরা ২০ দশমিক ৫ ভাগে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। মাথা পিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নতি হয়েছি। সেটা আমাদের ধরে রাখতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে যোগাযোগ ব্যবস্থা সবকিছু ব্যাপক উন্নয়ন করে যাচ্ছি। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলেছি। স্যাটেলাইট-১, বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপণ করেছি। তাছাড়া বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার যোগ্যতা অর্জন করেছি। আমাদের দেশটাকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। এ ক্ষেত্রে আমরা সবাইকে এক হয়ে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছি। আমরা সবাই একযোগে কাজ করলে আমি মনে করি সেদিন বেশি দূরে নয় যে, বাংলাদেশ ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। তিনি বলেন, এরই মধ্যে মুজিববর্ষ উদযাপন করছি। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে উদযাপন করা হবে। কাউন্টডাউন শুরু হয়েছে। আমরা প্রতিটি ঘর আলোকিত করব। সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। জাতির পিতা স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন, এই স্বাধীনতার সুফল বাংলার প্রতিটা মানুষ পাবে। প্রতিটি গ্রাম হবে শহরের সুযোগ-সুবিধা সম্পূর্ণ নগর। বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল কাজী শরীফ কায়কোবাদের পরিচালনায় সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এসএম তরিকুল ইসলাম, গাজীপুরের পুলিশ সুপার শামসুন্নাহারসহ তিন বাহিনী প্রধানরা ও আনসার বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের আম্রকাননে (বর্তমানে মুজিবনগর) স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণে যারা গার্ড অব অনার দেয় সেখানে আনসার বাহিনীও মজুদ ছিল এবং তারাই সেই গার্ড অব অনার প্রদান করেছিল। তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতা অর্জনের পর যখন পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে জাতির পিতা ফিরে আসেন। তিনি বাংলাদেশের প্রতিটি বাহিনীকে গড়ে তোলার জন্য পদক্ষেপ নেন। সেই সঙ্গে আনসার বাহিনীকেও শক্তিশালী করে গড়ে তোলার পদক্ষেপ নিয়ে ছিলেন। জাতীয় নির্বাচনসহ বিভিন্ন নির্বাচনে দায়িত্ব পালনসহ সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ এগুলো নির্মূলে আনসার বাহিনী বিশেষ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, যখন অগ্নি সন্ত্রাস আমাদের দেশের মানুষের জীবনকে দুর্বিসহ করে চলেছিল। তখন আনসার বাহিনী বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষ করে রেললাইন সংরক্ষণে বিরাট অবদান রাখে। দেশের যে সময় জননিরাপত্তা রক্ষা প্রয়োজন হয় আনসার বাহিনীকেই তখন দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমাদের অকুতোভয় আনসার বাহিনী জনগণের জান-মাল রক্ষায় নিজেদের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বাহিনীর কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী সরকারের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় বিশেষ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। এ বাহিনীর সাহসিকতা ও কর্মদক্ষতা বর্তমানে সর্বজন স্বীকৃত। এ বাহিনীতে প্রায় ৬১ লাখ সদস্য রয়েছে। ৫০ হাজার অঙ্গীভূত আনসার সদস্য সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা বিধানে বিশেষ ভূমিকা রাখছেন। আমাদের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখেন। বিমান বন্দরের নিরাপত্তায় এ বাহিনীর সদস্যরা ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। দেশ ও জনগণকে নিরাপত্তা দিতে ২টি মহিলা ব্যাটালিয়নসহ এ বাহিনীর ৪২টি আনসার ব্যাটালিয়ন সৃষ্টি করা হয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এমনকি আমাদের কূটনৈতিক এলাকা এবং বিশিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যবসায়ী তারাও তাদের প্রয়োজনে এই বাহিনীকে ব্যবহার করে থাকেন।
তিনি আনসার সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর এ বাহিনীর বিভিন্ন সমস্যা দূর করে বাহিনীর উন্নয়নের ব্যাপক কাজ করেছিল। আনসার বাহিনীর জাতীয় পতাকা ছিল না। ১৯৯৮ সালে আমরা এ বাহিনীকে সর্বোচ্চ সম্মান জাতীয় পতাকা আমরা প্রদান করি। ক্রীড়া ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য স্বাধীনতা পদকও প্রদান করা হয়, একটি গার্ড ব্যাটালিয়নসহ ৪টি আনসার ব্যাটালিয়ন গঠন করাও হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা জানেন যে, বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা বহুমুখী বিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। তার মধ্যে পরমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মুজিব নগর মুক্তিযোদ্ধা সিটি কমপ্লেক্স, আম্রকাননের নিরাপত্তার জন্য ২টি আনসার ব্যাটালিয়ন কার্যক্রম প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। ব্যাটালিয়নের সাংগঠনিক কাঠামো পুনর্গঠন করে জনবল আরও বৃদ্ধি করা হয়েছে। তাছাড়া আনসার ব্যাটালিয়ন আইন প্রণয়নের কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। উপ-মহাপরিচালক থেকে পরিচালক পর্যন্ত পদোন্নতি সমন্বয় করা হয়েছে। ২০১৯ সালে ৬টি উপ-পরিচালক এবং ১৭টি পরিচালকের পদ সৃজন করা হয়েছে। বিগত বছরে বাহিনীর কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পদবির ৯৬৬ জন পদোন্নতি পেয়েছে। আনসার ও বিডিপি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছি। এ ব্যাংকের মালিক আনসার ভিডিপি সদস্যরা, আপনারাই ঋণ নিতে পারেন, আপনার যে কোনো কাজ করতে পারেন। অর্থাৎ আপনারা নিজেরা যেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেন সেই ব্যবস্থাই আমরা করে দিয়েছি। তাছাড়া আপনাদের জন্য ঝুঁকি ভাতাও প্রবর্তন করেছি। আপনাদের কাজের প্রতি আন্তরিকতা ও দৃষ্টান্তমূলক দায়িত্বশীলতার স্বীকৃতিস্বরূপ প্রতিবছর সেবা ও সাহসিকতা পদক আওয়ামী লীগ সরকারই প্রবর্তন করেছে।
তিনি বলেন, নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আপনারা এ বাহিনীর সদস্যরা খেলাধুলা ও সংস্কৃতি চর্চায় অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন। বিশেষ করে আন্তজার্তিক পর্যায়ে দেশের সুনাম বৃদ্ধি করেছে। সদ্য সমাপ্ত এসএ গেমসে বাংলাদেশের অর্জিত ১৪২ পদকের মধ্যে ৬৮টি পদক অর্জন করেছে এ বাহিনীর সদস্যরা। এর আগে এদিন সকাল ১১টার দিকে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের সালাম গ্রহণ ও খোলা জীপে করে কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করেন। এসময় বিভিন্ন কৃতিত্বের জন্য ১৪৩ জনকে বিভিন্ন পদক প্রদান করে। পরে আনসার একাডেমির লেকের মঞ্চে এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষে যুবাদের বিশ^জয়ের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে স্বপ্ন নিয়ে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে এদেশ স্বাধীন করা হয়েছে। সে স্বাধীন দেশে আমরা মাথা উঁচু করে চলব। আগামী প্রজন্মের জন্য আমরা গড়ে যেতে চাই এ দেশকে। জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ। আমরা ক্ষুধামুক্ত করতে পেরেছি। এখন আমরা দৃষ্টি দিচ্ছি পুষ্টির দিকে। মানুষের সার্বিক জীবন উন্নয়নের দিকে দৃষ্টি দিচ্ছি। মানুষ যেন তার জীবনের সব চাহিদা মিটিয়ে সুন্দরভাবে উন্নত জীবনযাপন করতে পারে। সেই লক্ষ্য সামনে রেখেই এগিয়ে যাচ্ছি।