পহেলা ফাল্গুন ছিল ১৩ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু বাংলা বর্ষপঞ্জি সংশোধনের পর তা পিছিয়েছে একদিন। কিন্তু ঋতুরাজকে বরণ করে নিতে আগেভাগেই সেজেছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। বৃহস্পতিবার বিকালে বইমেলা প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা যায়, মেলায় আসা তরুণ-তরুণীদের পরনে বাসন্তী রঙের পোশাক। কারও এক হাতে বই, আর অন্য হাত বন্দি প্রিয় মানুষের হাতে।
এদিন বিকালে অমর একুশে গ্রন্থমেলার দুয়ার খুলতেই প্রকৃতির রঙে নিজেদের সাজিয়ে নেওয়া পাঠক-দর্শনার্থীরা প্রবেশ করে মেলা চত্বরে। বসন্ত না এলেও তার আগমনী বার্তায় মেলায় লেগেছিল ফাল্গুনের রঙ। মেলাজুড়ে যেদিকেই চোখ যায়, শুধুই হলুদ আর বাসন্তী রঙের সমারোহ। শাহবাগ মোড়, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, টিএসসি, চারুকলার বকুলতলা, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, রবীন্দ্র সরোবরসহ রাজধানীর সর্বত্রই দেখা যায় ফাল্গুনের রঙ। বাসন্তী সাজের আনন্দে মেতে ওঠে তরুণ-তরুণীর মন।
মেলায় জনস্রোত দেখে খুশি প্রকাশকরাও। তাদের মধ্যেও বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ। তাদের ভাবনা, অতীতের যে কোনো বারের থেকে বই বিক্রির পরিমাণ এবার বেশি হবে। সময় প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী ফরিদ আহমেদ বলেন, এখন থেকে যে ভিড় হচ্ছে, তা মেলার শেষ দিন পর্যন্ত দেখা যাবে। মেলা ঘুরে দেখা যায়, গোটা মেলা চত্বর জুড়েই ছিল ফাল্গুনের রঙ। শীতের শুষ্কতাকে বিদায় করে, সজীবতার আহ্বান জানিয়ে বইপ্রেমীরা এসেছেন বইমেলায়। তবে প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় এদিন নবীন পাঠকরাই মুখর করে তুলেছেন মেলা প্রাঙ্গণ। বই কেনার পাশাপাশি আড্ডা-গল্পে মেতে ছিলেন সবাই।
মাথায় টায়রা ও বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে মেলায় ঘুরতে আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের তিন বান্ধবী। তাদের মধ্যে কথা হয় ফারজানা ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানান, আগেও একবার এসেছেন। তখন বই কিনেছিলেন। কিন্তু আজ এসেছি ঘুরতে। শীতের শেষ আর বসন্তের শুরুর সময়টার সাক্ষী হব। বইমেলায় ‘কসমিক লাইফ’: কর্নেল মো. রাব্বি আহসানের লেখা প্রথম প্রয়াস ‘কসমিক লাইফ’। এটি আত্মোন্নয়নমূলক ও অনুপ্রেরণামূলক জীবনদর্শনের এক অসাধারণ প্রতিচ্ছবি। আহসান পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত এই বইটির মূল্য ৩০০ টাকা। যা পাওয়া যাবে গ্রন্থমেলার শিশু কানন ৮০১ নম্বর স্টলে।
হৃদিতার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট : বাসস এর সাংবাদিক তানভীর আলাদিনের দুটি রোমান্টিক উপন্যাস ও একটি সায়েন্স ফিকশনসহ তিনটি নতুন বই এসেছে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ফেনীর গ্রন্থমেলায়। বইগুলো হচ্ছেÑ ‘হৃদিতার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট’, ‘মন থেকে দিয়ে যাই শুভকামনা’ ও ‘এলিয়েন ৬৯’। গ্রন্থগুলো নিয়ে সাংবাদিক তানভীর আলাদিন জানান, ‘হৃদিতার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট’ এবং ‘মন থেকে দিয়ে যাই শুভকামনা’ এই উপন্যাস দুটি আশাকরি বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে রোমান্টিক মনগুলোকে রাঙিয়ে দিতে সহায়তা করবে। বইগুলো পড়ার সময় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের রোমান্টিক মানুষগুলোর চিত্তের দরজায় একটুখানি সময়ের জন্য হলেও কড়া নেড়ে যাবে। বই তিনটি পাওয়া যাচ্ছেÑ ঢাকায় : সাহিত্যদেশ (স্টল # ২৩৪), ভাটিয়াল (লিটলম্যাগ চত্বর, স্টল # ২৭), বাতিঘর (স্টল # ৪৪৪)। চট্টগ্রামে : হৃৎকলম (লিটলম্যাগ কর্নার), বাতিঘর ও সাহিত্যদেশ-এর স্টলে। ফেনীতে ভাটিয়াল প্রকাশন (শহীদ মিনার সংলগ্ন, রাজাঝির দীঘির পাড়)।
মানুষের মানচিত্র : মানুষের মানচিত্র মূলত্ব খ্যাতিমান সাংবাদিক ফয়েজ আহ্মদের জীবনালেখ্য। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন ফয়েজ আহ্?মদ। শৈশবে ভীষণ দুরন্ত ছিলেন তিনি। তার এই দুরন্তপনার বিস্তার ছিল জীবনের সব স্তরেই। কখনও তা থামেনি, বরং ক্রমেই আরও জীবন্ত ও প্রাণবন্ত হয়েছে। শৈশব থেকেই জীবনকে উপভোগ করার আকুতি ছিল তার। দিবা-রাত্রি মাছ ধরেছেন। বক শিকার করতে গিয়ে পুকুরঘাটে মহিলাকে আহত করেছেন। ট্রেনে ঘুমাতে গিয়ে স্টেশন পার হয়ে গেছেন। বিমানে চড়ার জন্য কৈশোরে যুদ্ধে গেছেন। যুদ্ধে গিয়ে পরীক্ষার বয়স হারিয়েছেন। সুযোগ পেলেই বাড়ি থেকে পালিয়েছেন। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে কারাগারে গেছেন। হিমালয়ের চূড়ায় উঠবেন বলে দেখা করেছেন তেনজিং নোরগে’র সঙ্গে। বিনা পাসপোর্টে ঘুরে বেড়িয়েছেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, যোগ দিয়েছেন ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক যুব সম্মেলনে। এসব কিছু অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে ধরা হয়েছে ‘মানুষের মানচিত্র’ বইটিতে। ১ ফাল্গুন অমর একুশে গ্রন্থমেলায় এসেছে বইটি। লিখেছেন ফয়েজ আহ্?মদের ভাবশিষ্য জাকির হোসেন। প্রচ্ছদ এঁকেছেন মুকুল রেজা, প্রকাশ করেছে আলোকায়ন, স্টল # ৫৬৬।
মূল পর্বের অনুষ্ঠান : বৃহস্পতিবার একুশে গ্রন্থমেলার ১২তম দিন। মেলা চলে বিকাল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। মেলায় নতুন বই আসে ১৮০টি। বিকাল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় সুব্রত বড়–য়া রচিত বঙ্গবন্ধুর জীবনকথা শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুজন বড়–য়া। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন লুৎফর রহমান রিটন এবং মনি হায়দার। লেখকের বক্তব্য প্রদান করেন সুব্রত বড়–য়া। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. আবু হেনা মোস্তফা কামাল এনডিসি।
প্রাবন্ধিক বলেন, আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শ দর্শন জানা ও চর্চা করা। নতুন প্রজন্মের নবীন-তরুণদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে যত আগ্রহ সৃষ্টি করা যাবে, তারা ততই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সোনার বাংলা গড়ার পক্ষে এটা হতে পারে অত্যন্ত জরুরি উদ্যোগ। সুব্রত বড়ুয়া রচিত বঙ্গবন্ধুর জীবনকথা গ্রন্থখানি কিছুটা হলেও আমাদের এগিয়ে দেবে সেই লক্ষ্যে। উক্তি-ভাষ্যে, আলোচনায় বঙ্গবন্ধুকে এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে বিশ্বনেতার মানদ-ে।
আলোচকরা বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বিশাল সমুদ্রের মতো যিনি তাঁর চেতনায় ধারণ করেছেন বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর জীবনকথা গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত পরিসরে লেখক সুব্রত বড়–য়া বঙ্গবন্ধুর বর্ণাঢ্য ও সংগ্রামী জীবনকে ইতিহাস ও তথ্যের ভিত্তিতে তুলে আনার প্রয়াস পেয়েছেন। এককথায় বলা যায়, সাবলীল ভাষায় লেখা বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম বিষয়ক এটি এক অনন্য গ্রন্থ। গ্রন্থের লেখক বলেন, বঙ্গবন্ধুর জীবনকথা গ্রন্থটি লেখার পেছনে যে দুটি বিষয় আমার প্রেরণা হয়ে কাজ করেছে তা হলো বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। এ গ্রন্থে আমি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর জীবনকে ইতিহাস, সংগ্রাম ও কর্মের প্রেক্ষাপটে তুলে আনার চেষ্টা করেছি।
সভাপতির বক্তব্যে ড. মো. আবু হেনা মোস্তফা কামাল এনডিসি বলেন, সুব্রত বড়–য়ার লিখিত এ গ্রন্থ অত্যন্ত তথ্যনিষ্ঠ এবং বিশ্লেষণ-ঋদ্ধ। আমাদের এবং নতুন প্রজন্মের জন্য প্রয়োজনীয় একটি গ্রন্থ। বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু একই সূত্রে গাঁথা। অতীতে বহুবার বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে তার নাম মুছে দেয়ার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে কিন্তু তা সফল হয়নি। কারণ, বাংলার প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু চিরকালের জন্য স্থান করে নিয়েছেন। আজ লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী, মৌলি আজাদ, রাসেল আশেকী এবং শোয়েব সর্বনাম।
আজকের অনুষ্ঠানসূচি : শুক্রবার অমর একুশে গ্রন্থমেলার ১৩তম দিন। মেলা চলবে সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। সকাল ১১টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত মেলায় থাকবে শিশু প্রহর। সকাল ১০টায় শিশু-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বিকাল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে আসাদ চৌধুরী রচিত সংগ্রামী নায়ক বঙ্গবন্ধু শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন শোয়াইব জিবরান। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন আনিসুর রহমান এবং নূরুন্নাহার মুক্তা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন অধ্যাপক খুরশীদা বেগম।