রাজশাহীতে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘনের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে একটি জরিপে। এতে বলা হয়েছে, রাজশাহীর ৭৭ শতাংশ সরকারি অফিসে ধূমপানের নজির পাওয়া গেছে। এছাড়া ৮৬ শতাংশ অফিসে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘন করা হচ্ছে। ৮০ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ৫১ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে এবং ৭৪ শতাংশ রেস্তোরাঁয় দেদারছে লঙ্ঘিত হচ্ছে এ আইন।
বৃহস্পতিবার সকালে উন্নয়ন সংস্থা ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট (এসিডি) এক সংবাদ সম্মেলনে আইন লঙ্ঘনের এ চিত্র তুলে ধরে। ‘রাজশাহী শহরের পাবলিক প্লেসে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নের বর্তমান অবস্থা’ শীর্ষক এক জরিপের ফল উপস্থাপনে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। রাজশাহী মহানগরীর সাগরপাড়া এলাকায় সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সেখানে জানানো হয়Ñ গেল বছর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এসিডির তত্ত্বাবধানে এবং ‘ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস-সিটিএফকে’র সহযোগিতায় ‘ক্রস সেকশনাল’ পদ্ধতিতে একটি বেসলাইন জরিপ পরিচালিত হয়। রাজশাহী শহরের মোট ৭০২টি জনবহুল স্থানে জরিপটি করা হয়। এর মধ্যে ১৫৪টি সরকারি অফিস, ১০৫টি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, ১২৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ৩১৬টি রেস্তোরাঁকে বেছে নেওয়া হয়।
এসিডি বলছে, রাজশাহীর ৭৭ শতাংশ সরকারি অফিসে ধূমপানের নিদর্শন পাওয়া গেছে। এছাড়া ৪৭ শতাংশ অফিসে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী সতর্কতামূলক নোটিশ পাওয়া যায়নি এবং ৪৯ শতাংশ সরকারি অফিসে পানের পিক দেখা গেছে। ৪৩ শতাংশ সরকারি অফিসে সিগারেট বা বিড়ির গন্ধ পাওয়া গেছে। আইন অনুযায়ী ৪৭ শতাংশ অফিসে সতর্কতামূলক নোটিশ পাওয়া যায়নি। এমনকি ৪০ শতাংশে কোনো ধরনের সতর্কতামূলক নোটিশও দেখা যায়নি। এছাড়া ৭০ শতাংশ অফিসের সীমানা থেকে ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়কেন্দ্র পাওয়া গেছে।
জরিপে দেখানো হয়Ñ ৩৪ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের ভবনের ভেতরে ধূমপানের নিদর্শন পাওয়া গেছে। আর ১০ ভাগ স্বাস্থ্যকেন্দ্র ভবনের বাইরে কিন্তু সীমানার মধ্যে ধূমপান, ২৩ শতাংশের আইন অনুযায়ী সতর্কতামূলক নোটিশ পাওয়া যায়নি এবং ২৬ শতাংশ সেবাকেন্দ্রে পানের পিক দেখা গেছে। সামগ্রিকভাবে ধূমপান হয়েছে ৩৪ শতাংশ সেবাকেন্দ্রে। আর সরকারি ধূমপান হয়েছে ৪ শতাংশ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। ২৮ শতাংশে সিগারেট বা বিড়ির বাঁট এবং ১১ শতাংশ সেবাকেন্দ্রে সিগারেটের গন্ধ পাওয়া গেছে।
এছাড়া ৯৪ শতাংশ কেন্দ্রে আইন অনুযায়ী সতর্কতামূলক নোটিশ পাওয়া যায়নি। এমনকি ৬৯ শতাংশ সেবাকেন্দ্রে সতর্কতামূলক কোনো ধরনের নোটিশই নেই। দুই শতাংশ সেবাকেন্দ্রে ভবনের ভেতরে তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়কেন্দ্র, সাত শতাংশ কেন্দ্রে ভবনের বাইরে কিন্তু সীমানার মধ্যে তামাকের বিক্রয়কেন্দ্র, এক শতাংশ কেন্দ্রের সীমানার মধ্যে ভ্রাম্যমাণ তামাক বিক্রেতা এবং ৬৫ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের সীমানা থেকে ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়কেন্দ্র পাওয়া গেছে। তবে মাত্র তিন শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে তামাকের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে বার্তা (ভর্তি ফরম, ছাড়পত্র এবং লিফলেটের মাধ্যমে) দেওয়া হচ্ছে বলে জরিপে উঠে এসেছে।
জরিপের প্রতিবেদনে আরও দেখা গেছে, রাজশাহীর ৪৭ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধূমপানের নিদর্শন। আর পানের পিক দেখা গেছে ২৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে। ৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে সরাসরি ধূমপান, ৪৩ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে সিগারেট-বিড়ির বাঁট পাওয়া গেছে। ৬০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে আইন অনুযায়ী সতর্কতামূলক নোটিশ পাওয়া যায়নি। এমনকি ৪৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে কোনো ধরনের সতর্কতামূলক নোটিশই নেই। এছাড়া ৭৮ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সীমানা থেকে ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়কেন্দ্র পাওয়া গেছে।
এছাড়া জরিপে দেখানো হয়, ৪৮ শতাংশ রেস্তোরাঁয় ধূমপানের নিদর্শন এবং ৩৯ শতাংশ রেস্তোরাঁয় পানের পিক দেখা গেছে। সরাসরি ধূমপান করতে দেখা গেছে ২৫ শতাংশ রেস্তোরাঁয়। ৪৩ শতাংশে সিগারেট বা বিড়ির বাঁট এবং ১১ শতাংশে ধূমপানের গন্ধ পাওয়া গেছে। ৬৯ শতাংশ রেস্তোরাঁয় আইন অনুযায়ী সতর্কতামূলক নোটিশ পাওয়া যায়নি। এমনকি ৫৯ শতাংশ রেস্তোরাঁয় কোনো ধরনের সতর্কতামূলক নোটিশই নেই। ৭ শতাংশ রেস্তোরাঁয় তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন ও ১০ শতাংশ রেস্তোরাঁর ভেতরে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় করতে দেখা গেছে।
এসিডির নির্বাহী পরিচালক সালীমা সারোয়ারের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেনÑ স্থানীয় দৈনিক সোনার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আকবারুল হাসান মিল্লাত। সংস্থাটির মিডিয়া ম্যানেজার আমজাদ হোসেন শিমুলের উপস্থাপনায় এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি কাজী শাহেদ, ইংরেজি দৈনিক বাংলাদেশ পোস্ট পত্রিকার রিজিওনাল করেসপনডেন্ট ও সিনিয়র সাংবাদিক সরকার শরিফুল ইসলাম ও ‘এন্টি টোব্যাকো মিডিয়া এলায়েন্স-আত্মা’র রাজশাহী বিভাগীয় সমন্বয়ক শরিফ সুমন। সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই গবেষণার উদ্দেশ্য তুলে ধরেন এসিডির তামাক নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোস্তফা কামাল। পাওয়ার পয়েন্টে জরিপের ফল উপস্থাপন করে বিস্তারিত তুলে ধরেন এসিডির অ্যাডভোকেসি অফিসার শরিফুল ইসলাম শামীম। সংবাদ সম্মেলনে এসিডির প্রোগ্রাম অফিসার কৃষ্ণা রানী বিশ্বাস, আনোয়ার হোসেন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে ১০ ফেব্রুয়ারি সকালে রাজশাহী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে জরিপের ফল উপস্থাপন নিয়ে এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়েছিল। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা প্রশাসক মো. হামিদুল হক। অনুষ্ঠানে তিনি জনবহুল স্থানে ধূমপান করতে দেওয়া হবে না বলে ঘোষণা দেন। সেইসঙ্গে তিনি স্কুলের পাশে তামাকপণ্য বিক্রি বন্ধে প্রয়োজনীয় উদ্যোগের কথাও জানান। পাশাপাশি রাজশাহী সিটিকে ধূমপানমুক্ত করতে তা তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও আশ্বাস দেন জেলা প্রশাসক।
