আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ১৬-০২-২০২০ তারিখে পত্রিকা

বসন্ত জাগ্রত দ্বারে

আফতাব চৌধুরী
| সম্পাদকীয়

শীতের শেষ রাত বসন্তের প্রথম দিন। ঋতুরাজ বসন্তের আগমন। শীতের কুয়াশার আলো-আঁধারি ফোটে নতুন আমেজে, নতুন সাজে ধরা দেয় বসন্ত। বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। বসন্তের আগমনী বার্তা সবাইকে জানিয়ে গেল সাজ-উৎসবের মধ্য দিয়ে। বসন্ত মানেই উৎসব উৎসব ভাব। জমজমাট এক রঙিন দিন। চারদিকে যেন নতুন প্রাণের ছোঁয়া। মানুষের জীবন এবং প্রকৃতির মাঝে এক পরিবর্তিত রূপ ধরা পড়ে ঋতুরাজ বসন্তের উজ্জ¦ল উপস্থিতিতে। ফাগুনের আগুন লাগে পলাশের ডালে ডালে, কৃষ্ণচূড়ার শাখায়Ñ বসন্ত ডাক দিয়ে যায় আমাদের নতুনের বার্তা শোনায় উজ্জ্বল উচ্ছ্বাসে-প্রাণের আবেগে।

ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় ভরেছে মন-প্রাণ। আমাদের উৎসবে, জীবনে লাগুক ফাগুন হাওয়া। বসন্ত হচ্ছে যৌবনের ঋতু, প্রেমের ঋতু, উজ্জ্বল-উদ্দমতার ঋতু। তাই তো সবাই ঋতুরাজ বলে বসন্তকে। সারা পৃথিবীর মানুষ বসন্তকে বরণ করে নেয় উৎসবের মাধ্যমে। প্রাচীন গ্রিক পুরাণে ও বসন্তকে বরণ করে নেওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। এটাকে তারা ফাগেনা উৎসব বলে। আমাদের বাংলাদেশেও কোনো কোনো জায়গায় বসন্ত উৎসবকে ‘ফগু’ বা ফাগ বলা হয়। আবহমান বাংলার স্বকীয় সংস্কৃতির ধারায়, চিরায়ত বাংলার লোকসংস্কৃতির উৎসব হিসাবে ‘বসন্ত উৎসব’ আমাদের জীবনে স্থান করে নিয়েছে। প্রেমিক-প্রেমিকাদের উৎসব, রাধা-কৃষ্ণের উৎসব, কাম দেবতার উৎসব, দোলযাত্রা বা হোলি উৎসব, ঝুলনযাত্রা, চরক উৎসব, বহ্নি উৎসব এমনকি ভালোবাসার উৎসব ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ সবই এ বসন্ত দিনে।

ঋতুভিত্তিক যত কবিতা গল্প-প্রবন্ধ বা শিল্প সাহিত্য রচনা হয়েছে, তার সিংহভাগজুড়ে রয়েছে ঋতুরাজ বসন্ত। নানা ফুলের সুবাস আর কোকিলের কুহু কুহু সুমিষ্ট ধ্বনি আমাদের প্রাণকে আন্দোলিত করে। কালের পরিবর্তনের ছোঁয়া অনুভূত হয় বসন্তের পেলব পরশে। প্রকৃতিও বদলে যায়। গাছের নতুন শাখায় সবুজ কচি পাতা ঊষার প্রথম আলোতে চিকচিক করে ওঠে। তাই তো কবিতা ও গানে, সুরের তান ও লহরিতে, নূপুরের নিক্কণ ছন্দে বসন্ত ধরা দেয়। তাই তো কবি গেয়ে ওঠেন ‘আসে বসন্ত ফুল বনেÑ সাজে বনভূমি সুন্দরী।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বলেছেন, ব্যর্থ প্রেমের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে, আগুন জ্বালো...

ডাক দিয়েছেন বহ্ন্যুৎসবে। গ্রামে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য খড়কুটো জ্বালিয়ে উৎসব করা হতো। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক নীহার রঞ্জন রায় এ প্রসঙ্গে বলেছেনÑ ‘প্রাকবৈদিক আদিম কৃষি সমাজের বলি ও নৃত্য-গীত উৎসব অভাবেই বর্তমানে হোলিতে রূপান্তরিত হয়েছে।’ আজও বাংলার উৎসবে ফাগুনী পূর্ণিমার দোল বা হোলি উৎসব আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে। রঙ ছিটানো হয় এ উৎসবে লাল-হলুদ, বাসন্তী রঙ। 

এ বছর বসন্ত বরণের পরের দিনই প্রেমিক-প্রেমিকার জন্য কাক্সিক্ষত সে দিনÑ ‘হ্যাপি ভ্যালেন্টাইনস ডে’। নবফাগুনের এ দিনে ছড়িয়ে পড়বে ভালোবাসার আলোকধারাÑ এ সত্যকে সামনে রেখে এবারে বেশ উৎসব-আনন্দে অতিবাহিত হবে এ ভালোবাসা দিবস। প্রিয়জনকে নতুন আবেগে কাছে পাওয়ার আশার প্রতীক্ষায় থাকে প্রেমিক-প্রেমিকারা। এ দিনে প্রিয়জনরা একে অন্যে তাদের মধ্যে বিভিন্ন ফুল, কার্ড ও উপহারসামগ্রী দিয়ে ভালোবাসা জানায়। ১৪ ফেব্রুয়ারির সে হাজার বছরের পুরোনো ইতিহাস ইউরোপ ছাড়িয়ে এখন বাংলাদেশে। আমাদের দেশে আজ তা ভালোবাসার দিন হিসেবে উদযাপিত হয়। যদিও বা বিদেশি সংস্কৃতি। 

আমাদের চেতনায়, প্রাণের আবেগে, হƒদয়ের তন্তুতে একুশ আজও চির ভাস্বর। আমাদের সৃষ্টিতে, আনন্দ-বেদনায়, কৃষ্টিতে মায়ের ভালোবাসায় একুশ আজও অম্লান হয়ে উজ্জ্বল দীপ্তিতে দেদিপ্যমান হয়ে আছে আমাদের হƒদয়ে। একুশ আমার গর্ব, একুশ আমার অহংকার, আমার হাজার বছরের প্রেম। আমার বেড়ে ওঠার দীপ্ত প্রেরণা। বসন্তের এমনি দিনে একুশ আমাদের ধরা দেয়। যখন পলাশ ফোটেÑ লাল হয়ে ওঠে আকাশ, কৃষ্ণচূড়ার রঙে রাঙা হয় সবুজ প্রান্তর। তখনই আমাদের জানিয়ে যায় একুশের কথা, বাংলা ভাষার কথা। বসন্ত যেমনি আনন্দের তেমনি বেদনার। মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য যাদের বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল এ পৃথিবী, তাদের কথা যেন আমরা ভুলে না যাই। তাদের সে স্বপ্নকে যেন আমরা বাস্তবে রূপদান করতে পারি। এ হোক আমাদের অঙ্গীকার। বিশ্ব বলয়ে মাতৃভাষা বাংলার আন্তর্জাতিক স্বীকৃত বাংলাকে করেছে গৌরবান্বিত। আমাদের দেশপ্রেম, মূল্যবোধ জাগ্রত হোক অসীম ভালোবাসায়, অনন্ত বিশ্বাসে। আমার তারুণ্য, আমার বসন্ত...

আমাদের রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। তাই আমাদের শিল্প সংস্কৃতির শিখরও গভীর থেকে গভীরে প্রোথিত। হঠাৎ বৃষ্টি বা ঝড়োহাওয়ায় তা মুছে যাওয়ার নয়। আমাদের দেশ, আমাদের বর্ণমালা, আমার তারুণ্য, আমার বসন্তÑ আমার অহংকার। চেতনার উৎসমূলে রয়েছে আমাদের দেশপ্রেম-ভালোবাসা। সে ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার আমরা, ঐতিহ্য আর শিল্পবোধ এসব প্রকাশ পায় চলনে-বলনে, পোশাক-পরিচ্ছদে। সব কিছুতেই স্বাভাবিকভাবে দেখা যায় নিজস্ব সংস্কৃতি, ইতিহাস ইত্যাদি। ষড়ঋতুর পূর্ণতা প্রকাশ পায় বসন্তের বিপুল বৈভবে। তেমনি জীবনের উৎকৃষ্ট সময়, সে যৌবনে প্রকাশ ঘটে সব সুন্দরের। সব মলিনতা, আবিলতা দূর করে সুন্দরকে প্রকাশ করতে হবে। আমাদের শিল্প-সাহিত্যে, আবহমান বাংলার ঐতিহ্যে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বসন্ত চিরজাগ্রত থাকুক এ আমাদের প্রত্যাশা। হ

 

 আফতাব চৌধুরী

সাংবাদিক-কলামিস্ট