আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ১৬-০২-২০২০ তারিখে পত্রিকা

ওষুধের দামের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে?

জনস্বাস্থ্য

আবু আফজাল সালেহ
| সম্পাদকীয়

জীবনদায়ী ও বেশি বিক্রীত ওষুধের দাম একেবারেই নিয়ন্ত্রণে নেই। অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ নিয়ে ব্যবসা করে থাকে দেশের বেশিরভাগ কোম্পানি। পত্রিকা ও বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, পাঁচ মাসে কখনও ৫ শতাংশ, কখনও আবার ১০ শতাংশ হারে দাম বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এ ধারা অব্যাহত। কিন্তু কর্তৃপক্ষ দেখেও ‘না দেখার’ ভান করে থাকে

মানুষের মৌলিক অধিকারের একটি হচ্ছে চিকিৎসা। আর এ ক্ষেত্রে প্রধান হচ্ছে ওষুধপত্র। কিন্তু ভেজাল, নিম্নমান ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধে সয়লাব দেশ। প্যাকেটের গায়ে মূল্য লেখা না থাকা, যখন-তখন ওষুধের মূল্য বৃদ্ধি বাংলাদেশে সাধারণ ব্যাপার। সঙ্গে সিন্ডিকেট তো আছেই। ভেজাল আর নিম্নমানের ওষুধের বাজার বল্গাহীন গতিতে রয়েছে। এতে সাধারণ ক্রেতারাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। লাভবান হচ্ছে সিন্ডিকেট, মালিক ও ব্যবসায়ীরা। কিছু ডাক্তার সিন্ডিকেটে জড়িত। তারাও এসব অসদুপায় অবলম্বন করে লাভবান হচ্ছেন। বাংলাদেশের ওষুধের বাজারে চলছে নৈরাজ্য। ইচ্ছামতো দাম বাড়িয়ে নিচ্ছে ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো। খুচরা ব্যবসায়ীরা নির্ধারিত মূল্য মানছে না। নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর এক্ষেত্রে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। আর নিয়ন্ত্রণহীন বাজারে নাকাল হচ্ছেন রোগী আর তাদের পরিবার। আমরা প্রায় সবাই বিবেককে ঠকিয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। ভেজাল ওষুধে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে গ্রামের মানুষ। তাদের সচেতনতার অভাবের কারণেই এ দুর্ভোগের শিকার বেশি। এখনই লাগাম টেনে ধরতে না পারলে ভয়াবহভাবে বেড়ে যাওয়া এ প্রবণতা মারাত্মকরূপ ধারণ করবে।
ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানেরই সরাসরি ভূমিকা নেই। ১৯৯৪ সালে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশনায় ‘অত্যাবশ্যকীয় তালিকাভুক্ত ওষুধের দাম নিজ নিজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করবে’ বলে জানানো হয়। সে নির্দেশনার ভিত্তিতে কোম্পানিগুলো ওষুধের দাম বাড়াচ্ছে নিজেদের ইচ্ছেমতো। এটার ইচ্ছেমতো ব্যবহার হচ্ছে। যদিও ২০১৫ সালের নীতিমালায় কিছুটা পরিবর্তন করা হয়। কিন্তু বর্তমানে কোম্পানিগুলো যে দাম চায়, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সাধারণত সে দামেই বিক্রির অনুমতি দিয়ে থাকে। ফলে ওষুধের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি সরকারের অনেকটা নিয়ন্ত্রণের বাইরেই থেকে যাচ্ছে।
সরকারি প্রতিষ্ঠান ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অগোচরেই বাড়ানো হয় ওষুধের দাম। ওষুধ কোম্পানিগুলো ওষুধের দাম বাড়াতে কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের প্রয়োজনও মনে করে না। সত্যি বলতে কি, শুধু দাম বৃদ্ধিই নয়, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ নিয়ে দেশে চলছে অরাজকতা। একদিকে দাম বাড়ানো হচ্ছে ইচ্ছেমতো, অন্যদিকে মেয়াদোত্তীর্ণ ও ভেজাল ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। বেশ কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি রয়েছে, যেগুলো নিম্নমানের ওষুধ তৈরি করে বাজারে ছাড়ছে। ১৯৮২ সালের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশে যেকোনো ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ছিল সরকারের। এ ব্যবস্থা অবশ্যই ফিরিয়ে আনতে হবে। এ ব্যাপারে যথাযথ আইন ও বিধিবিধান প্রণয়ন করতে হবে। 
‘জাতীয় ঔষধ নীতিমালা-২০১৫’ এর প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে ভালো মানের ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন করা। এ ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসরণের কথা বলা হয়েছে (ধারা-৪)। নীতিমালার ৩নং ধারার বিভিন্ন উপধারায় ওষুধের গুণগত মান, নিরাপত্তা, কার্যকারিতা বা উপকারিতা প্রভৃতি বিষয়ে পূর্বনির্ধারিত মানদণ্ড হওয়া উচিত বলে নির্দেশনা আছে। সব ওষুধ ও ওষুধজাতীয় দ্রব্যের বিভিন্ন ‘ডোজেস ফর্ম’ ও এ নিয়ে আমদানি, বিতরণ ও বিপণন অবশ্যই ‘ঔষধ নিয়ন্ত্রণ কমিটি’ কর্তৃক সুপারিশকৃত ও নিবন্ধিত হতে হবে বলে ওই ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে। মূলত নিবন্ধন পাওয়ার পর অনেক কো¤পানি অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধে ভরে গেছে সারাদেশ। এ ব্যাপারে আমরা অনেকটাই অসহায় হয়ে পড়েছি। আদালতের অনেক নির্দেশনা ও ভ্রাম্যমাণ আদালত অনেক সময় অসহায় হয়ে পড়ে সংশ্লিষ্ট অনেকের অসহযোগিতার ফলে। 
‘জাতীয় ঔষধ নীতিমালা-২০১৫’ এর ৭ ধারায় ওষুধের মূল্য নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সহজলভ্যতার জন্য অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের যুক্তিযুক্ত দাম নির্ধারণের কথা বলা হলেও তা মানা হয় না। যুক্তিযুক্ত দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে কাঁচামাল ও প্যাকেটিং সামগ্রীর পরিব্যয়ের কথা মাথায় রাখার কথা বলা হয়েছে। ওষুধের কাঁচামালের (এপিআই) দাম স্বাভাবিক রয়েছে বলে জানা যায়। কিন্তু দেশে বিভিন্ন কোম্পানি একই ওষুধ উৎপাদন করে ভিন্ন ভিন্ন দামে বিক্রি করছে। ওষুধ প্রশাসনের হিসেবে আড়াই হাজারের বেশি ওষুধ দেশে উৎপাদন বা পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ করে থাকে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো। এর মধ্যে মাত্র ১১৭টি ওষুধের মূল্য সরকার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। বাকিগুলোর মূল্য নির্ধারণে সরকারের তেমন কোনো ভূমিকা নেই। এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ডাক্তার ফায়েজুল হাকিম রেডিও তেহরানকে বলেছেন, ‘বাংলাদেশে চিকিৎসা খাতে রোগীর পকেট থেকে ব্যয় হয় সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই ব্যয় হয় ওষুধের পেছনে। এখানে সরকার পক্ষের লোকজন ওষুধ ব্যবসায় যুক্ত বলে তারা অন্যসব ভোগ্যপণ্যের মতো জীবন রক্ষাকারী ওষুধকেও মুনাফা অর্জনের ক্ষেত্র বানিয়ে জনগণের পকেট কাটছে।’
নিয়ন্ত্রণহীন ওষুধের বাজার। প্যাকেটে খুচরা মূল্য উল্লেখ থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে দামে বিক্রি হয় না। বেশির ভাগ ওষুধের পাতায় মূল্য লেখা থাকে না। অনেক সময় ২৫ টাকার ইনজেকশন ৫০০ টাকায়ও বিক্রি হয়ে থাকে। বৈধ-অবৈধ খুচরা ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো দামে ওষুধ বিক্রি করছেন। অসাধু সিন্ডিকেট ও বিক্রয় প্রতিনিধিরাও অনেক সময় অনৈতিক এ সহযোগিতা করে থাকে। প্রতিটি ট্যাবলেটের পাতায় ও ইনজেকশনের গায়ে খুচরা মূল্য অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে। এতে কিছুটা লাগাম টানা যাবে। 
জীবনদায়ী ও বেশি বিক্রীত ওষুধের দাম একেবারেই নিয়ন্ত্রণে নেই। অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ নিয়ে ব্যবসা করে থাকে দেশের বেশিরভাগ কোম্পানি। পত্রিকা ও বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, গত পাঁচ মাসে কখনও ৫ শতাংশ, কখনও আবার ১০ শতাংশ হারে দাম বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এ ধারা অব্যাহত। কিন্তু কর্তৃপক্ষ দেখেও ‘না দেখার’ ভান করে থাকে। কারণ পত্রপত্রিকায় এগুলো বহুল প্রচারিত হচ্ছে। নিউরোলজি, হার্ট, উচ্চ রক্তচাপ, অ্যান্টিবায়োটিক, ডায়াবেটিস, গ্যাস্ট্রিক ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ব্যবহৃত হাঁপানি ও কাশির ওষুধের দাম নিয়মিত বাড়ে এবং সেটা খুব অল্প সময়ের ব্যবধানেই বাড়ে। অস্ত্রোপচারের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধের দামও অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়েই চলেছে। এ অবস্থার পরিত্রাণ পেতে চাই। প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি পাক এখানে। আর কারও ওপর ভরসা পাওয়া মুশকিল। আদালতও অনেকসময় বিভিন্ন নির্দেশনা দিচ্ছেন। সেগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না দেখা দরকার। আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে ওষুধের দাম ও ভেজাল নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নিলে আরও বেশি ফলপ্রসূ হবে বলে মনে করি। হ

 আবু আফজাল সালেহ
কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট