ব্যক্তি মালিকানা সম্পর্কে ইসলামের অন্যতম নীতি হচ্ছেÑ ভূমি তথা সম্পদ মালিকের যথার্থ উপকারে আসতে হবে। লক্ষণীয় যে, বহু ক্ষেত্রে মানুষ তার সম্পদ জাতীয় কল্যাণে নিয়োজিত না করে ব্যক্তির স্বেচ্ছাচারিতার ইন্ধন হিসেবে ব্যবহার করে। এটা অবশ্যই ইসলামের মৌলিক নীতির বিরোধী। এ বিধানে অবশ্যই নিশ্চিত হতে হবে যে, ভূমি কখনও ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ব্যবহার করা যাবে না। ইসলামি আইন সব আর্থিক চাপ ও প্রভাব থেকে মুক্ত থেকে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার প্রয়াসী। ব্যক্তি মালিকানা সম্পর্কে শর্ত হচ্ছে, ভূমি তথা সম্পদ জীবিত ব্যক্তির
স্বার্থে ব্যয়িত হতে হবে। মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তির কোনো ভূমি বা সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণ বা ভোগ করার প্রশ্নই আসে না। কাজেই ইসলামি বিধান মোতাবেক মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তির
স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি তার উত্তরাধিকারদের মধ্যে বণ্টন করে দিতে হবে
ভূমি মানব জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ মতে, ভূমি থেকেই সব কিছুর উৎপত্তি আবার এ ভূমিতেই সবকিছু বিলীন হয়ে যাবে। ভূমির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। সৃষ্টির শুরু থেকে ভূমির ব্যবহার বিদ্যমান। মানব সমাজের ক্রমবিকাশের একপর্যায়ে ভূমি ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ভূমির মালিকানা কার? সৃষ্টির শুরু থেকে এ প্রশ্ন চলে আসছে। একসময় যে ব্যক্তি জঙ্গল পরিষ্কার করে জমি চাষযোগ্য করত সে তার মালিক বনে যেত। কিংবা কেউ যদি কোনো পরিত্যক্ত জমি বা অন্যের জমি জোরপূর্বক দখল করে নিরবচ্ছিন্নভাবে তা ১২ বছর ভোগ করত তবে সে ওই জমির মালিকানা অর্জন করত। কিন্তু ইসলাম এ ধরনের মালিকানাকে স্বীকার করে না। ইসলাম উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত কিংবা বৈধ উপায়ে উপার্জিত ভূমির মালিককেই প্রকৃত মালিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
ইসলামে ‘ব্যক্তি মালিকানা’ বা আমানতি মালিকানা কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। পুঁজিবাদ ও সমাজবাদ ব্যক্তিকে সমাজের সোপান হিসেবে সংগঠিত করতে কার্যত সফল হতে পারেনি। কিন্তু ইসলামি অর্থনীতি এ ক্ষেত্রে পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের তুলনায় সর্বতোভাবে সফল। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় লাগামহীন ব্যক্তি মালিকানা বহু অপচয় ও অপবণ্টনের জন্য দায়ী। ফলে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় সমাজে ধনী আরও ধনী হয় এবং দরিদ্র আরও দরিদ্র হতে থাকে। ভোক্তার সার্বভৌমত্বের নামে মূল্য ব্যবস্থার আঘাতে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষ শোষিত হয়।
অপরদিকে সমাজতন্ত্রে যৌথ মালিকানা ও রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যবস্থার পক্ষে ব্যক্তি মালিকানাকে উপেক্ষা করা হয়। এ ব্যবস্থায় বেকার সমস্যা ও অসম বণ্টনের খানিকটা সুরাহা হতে পারে, কিন্তু উৎপাদনে মানুষের অভিনবত্ব উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। তাছাড়া সমাজতন্ত্রে ব্যক্তি স্বাধীনতা বলতে কিছুই থাকে না। শ্রমিকরা রাষ্ট্রযন্ত্রের অংশ হিসেবে বেঁচে থাকে। এ দুটি অর্থব্যবস্থা একই রোগের দ্বিবিধ লক্ষণ মাত্র। কিন্তু ইসলামি অর্থব্যবস্থা পুঁজিবাদ ও সমাজবাদ এ দুই প্রান্তিক চরম মতবাদ পরিহার করে মধ্যমপন্থা অনুসরণ করে।
আল কোরআনে বলা হয়েছে, ‘ইয়াতিমদের তাদের ধনসম্পদ সমর্পণ করবে এবং ভালোর সঙ্গে মন্দ বদল করবে না। তোমাদের সম্পদের সঙ্গে তাদের সম্পদ মিশিয়ে গ্রাস করো না; নিশ্চয় তা মহাপাপ।’ অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘পুরুষ যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ এবং নারী যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ।’ আরও বলা হয়েছে, ‘মা-বাবা ও আত্মীয়স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তির প্রত্যেকটির জন্য আমি উত্তরাধিকারী করেছি এবং যাদের সঙ্গে তোমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ তাদেরকে তাদের অংশ দিবে।’ মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কারও এক বিঘৎ পরিমাণ জমি জোর করে দখল করবে কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তার গলায় সাত স্তর জমি বেড়িরূপে পরিয়ে দিবেন।’ ইসলাম ব্যক্তি মালিকানা স্বীকার করে নিলেও তা শর্তহীন নয় বরং ইসলামে ব্যক্তি মালিকানা কয়েকটি শর্তসাপেক্ষে স্বীকৃত। সম্পদের কল্যাণকর ও সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এসব শর্তারোপ করা হয়েছে। শর্তগুলো হলোÑ
ভূমির নিরবচ্ছিন্ন ব্যবহার : ভূমির নিরবচ্ছিন্ন ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে অন্যথায় মালিকানা রোহিত বলে গণ্য হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, হজরত বেলাল ইবনুল হারিস (রা.) কে মহানবী (সা.) প্রচুর জমি আবাদ করার জন্য দিয়েছিলেন। ওমর (রা.) খলিফা নিযুক্ত হওয়ার পর তাকে ডেকে বললেন, ‘মহানবী (সা.) আপনাকে অনেক জমি দিয়েছেন, আর আপনি পুরো জমি চাষাবাদ করতে পারছেন না। এরপর বললেন, যে পরিমাণ জমি আপনি নিজে চাষাবাদ করতে পারবেন, সে পরিমাণই আপনি নিজের দখলে রাখুন। আর যা সামলাতে পারবেন না কিংবা যে পরিমাণ জমির ব্যবস্থাপনা করা আপনার পক্ষে সম্ভব নয়, তা আমাদের (রাষ্ট্রের) কাছে ফেরত দিন, আমরা তা অন্য মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করে দেব। হজরত বেলাল (রা.) তার জমি ফেরত দিতে রাজি না হওয়া সত্ত্বেও তার সাধ্যাতীত পরিমাণ জমি ওমর (রা.) ফেরত নিলেন এবং মুসলমানদের মধ্যে পুনর্বণ্টন করে দিলেন।
ভূমির কল্যাণকর ব্যবহার : ভূমি থেকে উৎপন্ন ফসলের কিছু অংশ মহান আল্লাহর রাস্তায় অর্থাৎ কল্যাণকর কাজে ব্যয় করতে হবে। ইসলামি অর্থনীতিতে ভূমি তথা সম্পদের ব্যবহার নীতি কোরআনের নিম্নোক্ত আয়াতে পরিষ্কারভাবে বর্ণিত হয়েছে, ‘যারা নিজেদের ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে তাদের উপমা একটি শস্যবীজ, যা সাতটি শীষ উৎপাদন করে, প্রত্যেক শীষে থাকে ১০০ শস্যদানা। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। যারা আল্লাহর পথে ধনসম্পদ ব্যয় করে, এরপর যা ব্যয় করে তার কথা বলে বেড়ায় না এবং ক্লেশও দেয় না, তাদের পুরস্কার তাদের প্রতিপালকের কাছে। তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।’
জাকাত প্রদান : সমাজের যে কয়জন লোক তাদের উচ্চতর যোগ্যতা ও সৌভাগ্যের কারণে নিজেদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধনসম্পদ আহরণ করেছে ইসলাম চায় তারা যেন এ সম্পদ পুঞ্জিভূত করে না রাখে, বরং এগুলো ব্যয় করে এবং এমন সব ক্ষেত্রে ব্যয় করে যেখান থেকে সম্পদের আবর্তনের ফলে সমাজের স্বল্পবিত্তভোগীরাও যথেষ্ট অংশ লাভ করতে সক্ষম হয়। এ লক্ষ্যেই ইসলাম জাকাত ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে। জাকাতের বিধানাবলি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কৃষিজ পণ্যই এর অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। ভূমি একটি রাষ্ট্রের অপরিহার্য উপাদান। ভূমি মানুষের রিজিক ও জীবন ধারণের মূল উৎস। ইসলামের ভূমি ব্যবস্থা ইনসাফপূর্ণ। ভূমি ব্যবস্থারই অন্যতম দিক হলো উশর ও খারাজ। কোনো কোনো অবস্থায় উৎপাদিত ফসলের এক-দশমাংশ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে দেওয়া ফরজ হয়, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ দিতে হয়। ইসলামি সরকার কর্তৃক ফসল ও ভূমির ওপর আরোপিত করকে উশর ও খারাজ বলা হয়। উশর মুসলমানদের জমির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ও নির্দিষ্ট। অমুসলিমদের জমিতে উশর নেই, আছে খারাজ।
আইনানুগ দখলস্বত্ব : ভূমি দখল আইন সঙ্গত হতে হবে। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কারও এক বিঘৎ জমি জোর করে দখল করবে কেয়ামতের দিন আল্লাহ তার গলায় সাত তবক জমিন বেড়িরূপে পরিয়ে দিবেন।’ মিথ্যা দলিল ও ভুয়া সাক্ষী-প্রমাণের মাধ্যমে কোর্টের রায় নিজের অনুকূলে নেওয়ার প্রচেষ্টা তথা দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পত্তি ভোগ-দখল করা ইসলামি ব্যবস্থায় সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।
সুষম ব্যবহার : ব্যক্তি মালিকানা সম্পর্কে শরিয়তের স্পষ্ট নীতি হচ্ছে মালিককে তার ভূমি তথা সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার করতে হবে। ব্যক্তি মালিকানা অবশ্যই কোরআন ও সুন্নাহ প্রবর্তিত নীতি থেকে যাতে বিচ্যুত না হয় সেজন্য সমাজ তথা রাষ্ট্রকে সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। সম্পদের মালিককে কৃপণ কিংবা অপচয়কারী হওয়া যাবে না। কেননা মহান আল্লাহ উদ্ধত, দাম্ভিক, কৃপণ ও অপচয়কারী ব্যক্তিকে পছন্দ করেন না। অন্যায়ভাবে অপরিমিত সম্পদের মালিক হওয়া ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়।
ভূমি দ্বারা যথার্থ উপকার লাভ : ব্যক্তি মালিকানা সম্পর্কে ইসলামের অন্যতম নীতি হচ্ছেÑ ভূমি তথা সম্পদ মালিকের যথার্থ উপকারে আসতে হবে। লক্ষণীয় যে, বহু ক্ষেত্রে মানুষ তার সম্পদ জাতীয় কল্যাণে নিয়োজিত না করে ব্যক্তির স্বেচ্ছাচারিতার ইন্ধন হিসেবে ব্যবহার করে। এটা অবশ্যই ইসলামের মৌলিক নীতির বিরোধী। এ বিধানে অবশ্যই নিশ্চিত হতে হবে যে, ভূমি কখনও ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ব্যবহার করা যাবে না। ইসলামি আইন সব আর্থিক চাপ ও প্রভাব থেকে মুক্ত থেকে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার প্রয়াসী। ব্যক্তি মালিকানা সম্পর্কে শর্ত হচ্ছে, ভূমি তথা সম্পদ জীবিত ব্যক্তির স্বার্থে ব্যয়িত হতে হবে। মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তির কোনো ভূমি বা সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণ বা ভোগ করার প্রশ্নই আসে না। কাজেই ইসলামি বিধান মোতাবেক মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তির স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি তার উত্তরাধিকারদের মধ্যে বণ্টন করে দিতে হবে।
হালাল-হারাম বিবেচনা : ভূমি তথা সম্পদ ব্যবহারে হালাল-হারামের বিবেচনা করতে হবে। অবৈধভাবে কোনো ভূমি কিংবা সম্পদ দখল বা ভোগ করা সম্পূর্ণ হারাম। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মানব জাতি! পৃথিবীতে যা কিছু বৈধ ও পবিত্র খাদ্যবস্তু রয়েছে তা থেকে তোমরা আহার কর এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না, নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শক্র।’ ইসলামে ভূমি মালিকানা তথা ব্যক্তি মালিকানা নৈতিক ও ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কোনো ব্যক্তি তার মালিকানাধীন ভূমি বা সম্পদ ইসলামের মৌলিক নীতিবিরোধী কাজে ব্যবহার করলে ইসলামি রাষ্ট্র তার মালিকানা রহিত করার অধিকার রাখে।