১৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী। ওই দিন থেকে শুরু হচ্ছে মুজিববর্ষ, যার আলোকে বছরব্যাপী চলবে নানা আনুষ্ঠানিকতা। মুজিববর্ষ সামনে রেখে এবার অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রথমবারের মতো স্থাপন করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু কর্নার’। এ কর্নার সাজানো হয়েছে জাতির পিতার দুর্লভ ছবি দিয়ে। তা দেখতে দর্শনার্থী ভিড় করছেন বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু কর্নারের এ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এর মূল উদ্যোক্তা ডাকসুর স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক সাদ বিন কাদের চৌধুরী। কর্নার ঘুরে দেখা যায়, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ এখানে স্থান পেয়েছে। এছাড়া বাঙালির মুক্তির সনদ ছয়দফা, বিভিন্ন দেশি-বিদেশি পত্রিকার সংবাদ ও বঙ্গবন্ধুর দুর্লভ ছবি দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে এটি। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত সব ধরনের বইও প্রদর্শন করা হয়। শনিবার প্রদর্শনী ঘুরে দেখা যায়, শত শত তরুণ-তরুণী এবং বিভিন্ন বয়সের দর্শনার্থী এ প্রদর্শনী দেখছেন। কেউ প্রদর্শনীর ছবি তুলতে ব্যস্ত, আবার অনেকেই ঘুরে ঘুরে দেখছেন দুর্লভ ছবিগুলো। প্রদর্শনীতে ঘুরতে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রফিকুল ইসলাম সবুজ বলেন, আমি বই কিনতে মেলায় এসেছিলাম। পরে এখানে এসেছি। প্রথম বারের মতো বইমেলায় বঙ্গবন্ধু কর্নার স্থাপন করা হয়েছে, যেটা এর আগে কখনও হয়নি। এজন্য সবচেয়ে বেশি ভালো লাগছে। আয়োজনের বিষয়ে সাদ বিন কাদের চৌধুরী বলেন, বইমেলায় প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থী আসেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এমন উদ্যোগ এর আগে কখনও না হওয়ায় তারা এগুলো মিস করতেন। প্রথমবারের মতো ভিড় জমছে বঙ্গবন্ধু
এ আয়োজন করতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত। এখানে বঙ্গবন্ধুর সব ধরনের দুর্লভ ছবি প্রদর্শন করা হয়েছে। সবচেয়ে ভালো লাগছে এখানে সব বয়সের মানুষ আসছেন। তারা প্রদর্শনী দেখছেন, ছবি তুলছেন।
শিশু প্রহর : শনিবার সকালে ছিল শিশু প্রহর। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ছোট্ট ছোট্ট শিশুরা বাবা-মায়ের সঙ্গে বই কিনছে। শিশু চত্বরের স্টেজে ‘চলছে গাড়ি সিসিমপুরে’ গানে আপন মনে নাচতে দেখা যায় শিশুদের। মেলা চত্বরে শিশুদের জন্য বিনোদনের পাশাপাশি ছিল ৩০টি স্টলে হরেক রকমের বই। আর বই পড়ার জন্য চত্বরে রয়েছে আলাদা জায়গা। এবারই প্রথম বইমেলায় এসেছে ধানমন্ডির একটি স্কুলের কেজি ওয়ানের শিক্ষার্থী ফারিহা আক্তার। তার অনুভূতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সে বলল, খুব মজা লাগছে; বই কিনেছি, আবারও মেলায় আসতে চাই। শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন থাকায় বিকালে ভিড় বাড়ে। প্রকাশকরা জানিয়েছেন, কয়েক দিন ধরে বইমেলায় ভিড় বাড়ছে। এজন্য বেচাকেনাও ভালো হচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন তারা।
‘মাখফির অশ্রু’ : মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের কন্যা শাহজাদী জেব-উন-নেছার জীবন ও কবিতা নিয়ে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় এসেছে ‘মাখফির অশ্রু’। বইটির লেখক তুহিন তৌহিদ এবং এটি প্রকাশ করেন প্রকাশনা সংস্থা প্রকৃতির কর্নধার কবি সৈকত হাবিব; পাওয়া যাবে ৭০৭ নম্বর স্টলে। প্রচ্ছদ করেছেন নাজিব তারেক। শাহজাদী জেব-উন-নেছা কবিতা লিখতেন মাখফি ছদ্মনামে; তার সময়ের কবি-শিল্পীদের পৃষ্টপোষকতাও দিতেন তিনি। পিতা আওরঙ্গজেবের প্রশাসনিক বিষয়াশয়ে মতামত দিয়ে সাম্রাজ্য শাসনে প্রভাব রাখতেন। প্রভাবশালী এ শাহজাদীর ওপরই এক সময় ক্ষীপ্ত হয়ে ওঠেন আওরঙ্গজেব। তাকে দুর্গের চার দেওয়ালে বন্দি করা হয়। আর এভাবে কুড়ি বছর বন্দিদশায় কাটে তার। শেষতক বন্দিদশায়ই চিরমুক্তি পান রূপবতী এ শাহজাদী। ‘মাখফির অশ্রু’ গ্রন্থে তার জীবন, সময়, রাজনৈতিক-সামাজিক অবস্থা ও বেশ কয়েকটি অনুদিত কবিতা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বইটির লেখক তুহিন তৌহিদ বলেন, মাখফিকে নিয়ে বাংলা ভাষায় তেমন কোনো কাজ নেই। এটা খুবই বিস্ময়কর। সম্ভবত এটাই মাখফিকে নিয়ে প্রথম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ। আশা করছি, এখন অনেকে তাকে নিয়ে কাজ করবেন।
‘সুখমহল’ : ১৪ ফেব্রুয়ারি ফাল্গুনের প্রথম দিন ও ভালোবাসা দিবসে প্রকাশিত হয়েছে কথা সাহিত্যিক ও নাট্যকার মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদের উপন্যাস ‘সুখমহল’। কুঁড়েঘর প্রকাশনী লিমিটেড থেকে প্রকাশিত উপন্যাসটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন মিতা মেহেদী। ‘সুখমহল’ একটি সামাজিক ও জীবনধর্মী উপন্যাস। বইটিতে জীবন বোধের গল্প ফুটে উঠেছে। উপন্যাসের গল্পটা সব বয়সের পাঠকের পাঠযোগ্য। অন্যদিকে বইমেলায় তার শিশুতোষ গ্রন্থ ‘ভূতের অঙ্ক পরীক্ষা’ প্রকাশিত হচ্ছে টুনটুনি প্রকাশনী থেকে। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রব এষ। ভূতের গল্প হলেও বইটির প্রতিটি গল্পে আলাদা আলাদা বার্তা রয়েছে।
‘তুপা’ : অমর একুশে বইমেলায় এম মামুন হোসেনের ‘তুপা’ উপন্যাসে তুপা, হাসান, সজিবের গল্পের সময়টি সেই ৯০ দশকের। যখন সম্পর্কগুলো খুব সহজ-সরল। এখনকার মতো এত বেশি টেকনোলজি নির্ভর নয়। সময়টা আজ থেকে ২০ বছর আগের। বইটির প্রকাশক অনিন্দ্য প্রকাশ। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় ৩১ নম্বর প্যাভিলিয়নে (অনিন্দ্য প্রকাশ) পাওয়া যাচ্ছে। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। এরই মধ্যে বইটির প্রথম সংস্করণ শেষ হয়েছে। বইটির মূল্য ১২০ টাকা। বইটি রকমারি.কম (যঃঃঢ়ং://িি.িৎড়শড়সধৎর.পড়স/নড়ড়শ/১৯৩৪৭১/ঃঁঢ়ধ) থেকে কেনা যাবে।
মূল মঞ্চের আয়োজন : শনিবার ছিল গ্রন্থমেলার ১৪তম দিন। মেলা চলে বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। এদিন নতুন বই আসে ২০৩টি। সকাল ১০টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে শিশু-কিশোর সংগীত প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিযোগিতায় বিচারক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শিল্পী কল্যাণী ঘোষ, ইয়াকুব আলী খান এবং চন্দনা মজুমদার। এতে ‘ক’ বিভাগে ১৫ জন, ‘খ’ বিভাগে ১৬ জন প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করেন। ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ বিজয়ীদের পুরস্কার প্রদান করা হবে। বিকাল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় শাহ্জাহান কিবরিয়া রচিত ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আনজীর লিটন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন হরিশংকর জলদাস এবং খালিদ মারুফ। লেখকের বক্তব্য প্রদান করেন শাহ্জাহান কিবরিয়া। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ। প্রাবন্ধিক বলেন, শহীদ মিনার থেকে স্মৃতিসৌধ। ১৯৫২ থেকে ১৯৭১। বাঙালি জাতি শিক্ষা নিয়েছে প্রতিবাদে-প্রতিরোধে জেগে উঠবার। এ চেতনার উৎস আমাদের মাতৃভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি। বাঙালির সংগ্রামমুখর ইতিহাসের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় আমরা পেয়েছি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। আমাদের নিরন্তর পথচলার তিনিই প্রদর্শক, শক্তি ও উদ্দীপনার উৎস। গ্রন্থের লেখক বলেন, বঙ্গবন্ধু শুধু সফল রাজনৈতিক নেতাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন মানবিক নেতা। সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ বলেন, শাহ্জাহান কিবরিয়া রচিত ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু’ গ্রন্থে লেখক বঙ্গবন্ধুর জীবনের মূল দিকগুলো ধারাবাহিকভাবে উন্মোচন করেছেন। লেখক দেখিয়েছেন, কীভাবে তিনি বাঙালি জাতিকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র উপহার দিলেন এবং হয়ে উঠলেন হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন আলম তালুকদার, মণিকা চক্রবর্তী, হামীম কামরুল হক এবং তপন পালিত।
আজকের অনুষ্ঠান সূচি : রোববার গ্রন্থমেলার ১৫তম দিন। মেলা চলবে বিকাল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকাল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলা একাডেমি’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন শাহিদা খাতুন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন শিহাব সরকার এবং ইসরাইল খান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।