সিরাজগঞ্জের যমুনায় মাছ আহরণে ব্যস্ত সময় কাটান জেলেরা- আলোকিত বাংলাদেশ
আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়ায় একদিকে কিছু মানুষ উন্নত জীবনযাপন করছেন, অন্যদিকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহকারী জেলেরা সিরাজগঞ্জের যমুনায় মাছ না পেয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন। যমুনায় জেগেছে অসংখ্য ডুবোচর, ফলে কমে গেছে পানি। এতে নদীতে কমে গেছে মাছের আনাগোনা। মাছ ধরে বিক্রি করে যাদের জীবন ধারণ করতে হয়, সেই জেলেরা এখন অভাবের তাড়নায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। যমুনা নদী দাপিয়ে বেড়িয়েও মাছের দেখা না পেয়ে অনেকে বাপ-দাদার কাছ থেকে পাওয়া জেলে পেশা ছেড়ে অন্য পেশা বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। ৫০ বছর বয়সি মোংলা হাওয়ালদার পেটের তাগিদে রাতের অন্ধকার কেটে আলো ফোটার আগেই যমুনার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত মাছ আহরণে নৌকা নিয়ে চষে বেড়ান। তার মতো আরও অনেকে এভাবেই যমুনা নদীতে মাছ আহরণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে চোখের কোণে জমে থাকা কান্নায় ভাসিয়ে দেন নৌকার গলুই। সরেজমিন দেখা যায়, নদীর পাড়ে কেউ মাছ ধরার ছেঁড়া জাল মেরামত করছেন, কেউ করছেন রান্নার কাজ, কেউবা ঘুমাচ্ছেন অঘোরে। এসব জেলে ১৫ থেকে ২০ দিনের খাবার নিয়ে বাড়ি থেকে নৌকা নিয়ে বের হন মাছ ধরতে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর নৌকায়ই শুরু হয় তাদের রান্না-খাওয়া- ঘুম। সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা, কাজিপুর, চৌহালী, এনায়েতপুর, শাহজাদপুরসহ অনেক এলাকায় এ দৃশ্য হরহামেশাই চোখে পড়ে। এখানকার জেলে পরিবারের সদস্যরা শিক্ষা-দীক্ষা ও অর্থনৈতিক দিক থেকে এখনও অনেক পিছিয়ে রয়েছেন। যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়, তাদের জীবনে শিক্ষার শিকে ছিঁড়ে পড়েনি। তাই তারা অশিক্ষিতের বদনাম ঘাড়ে বয়ে পেটের তাগিদে বের হন মাছ ধরতে। প্রত্যেক নৌকায় ৮ থেকে ১০ জেলে থাকেন। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম তারা মাছ ধরতে গিয়ে নদীর জলে ভেসে ভেসে কাটিয়ে দেন বছরের পর বছর। ঝুঁকি নিয়ে প্রতিনিয়ত জীবনযুদ্ধে লড়েন তারা। সূর্য ওঠার আগেই নৌকা নিয়ে বের হন তারা মাছ ধরতে। মাছ পাওয়া গেলে নদীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে বিকালে ফিরে আসেন সিরাজগঞ্জ সদর, কাজিপুর ও চৌহালী উপজেলার বাজারের মাছের আড়তে। নদীপাড়ের স্থানীয় বাজারে মাছ বিক্রি করে পাওনাদারদের দেনা পরিশোধ ও খাদ্যসামগ্রী কেনার পর তাদের হাতে যৎসামান্য যে অর্থ থাকে, তাতেই চলে সংসার ও ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া। চৌহালী উপজেলার আ. হামিদ, আ. সালাম, বিন্দাবন, কাজিপুর উপজেলার হোটকা, হাবিব কামাল ও সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার মেছড়া ইউনিয়নের আকনাদিঘী গ্রামের বাহেচ শেখের ছেলে আবদুল মালেক ও লোকমান শেখের ছেলে বাদশা আলম জানান, নদী এখন শুকিয়ে মাঝে মাঝে ডুবোচর জেগেছে। আবার কোথাও পলি জমে নালায় পরিণত হয়েছে। এ কারণে বর্তমানে মাছের আকাল। অনেকে বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে দিয়ে বিভিন্ন পেশায় চলে গেছে। অনেকের বয়স বেড়েছে। তাই তারা বাপ-দাদার জেলে পেশা আঁকড়ে ধরে কোনোরকমে বেঁচে থেকে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার ছোনগাছা ইউপির পাঁচঠাকুরী স্পার বাঁধ এলাকায় কথা হয় কুড়িগ্রাম জেলার চরজাৎরাপুর গ্রামের ময়নুল শেখের ছেলে নুর হোসেন, আজগর আলীর ছেলে মিজানুর ও ময়নাল ম-লের ছেলে আবদুল খালেকের সঙ্গে। তারা জানান, বর্তমানে যমুনায় খুব একটা মাছ জালে পড়ছে না। কপাল ভালো থাকলে মাছ পেয়ে ৭ থেকে ১০ দিন পর বাড়িতে চলে যান তারা। কপাল মন্দ হলে ১৫ থেকে ২০ দিনেও মাছ ধরা পড়ে না। এতে বাড়ি যাওয়া আর হয় না। তারা প্রতি নৌকায় তিন থেকে চার জেলে থাকেন। তারা মাছ বিক্রি করে যে টাকা পান, সবাই সমানভাবে ভাগ করে নেন। জেলেরা আরও জানান, নদীতে এখন পর্যাপ্ত মাছ ধরা পড়ছে না। এ নিয়ে তারা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। সপ্তাহে ঋণের কিস্তি ও বাড়িতে স্ত্রী-সন্তান আছে। যে পরিমাণ মাছ ধরা পড়ছে, তাতে কোনোরকমে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছেন তারা। তারপরও আশায় আছেন যদি জালে বড় মাছ পড়ে! সিরাজগঞ্জ জেলা মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি মো. সুরুতজামান বলেন, যমুনা নদীর নাব্য হ্রাস পাওয়ায় জেলার চরাঞ্চলের ১ হাজারের বেশি নৌ-শ্রমিক এবং জেলে বেকার হয়ে পড়েছেন। এসব নৌ-শ্রমিক ও জেলেরা বাপ-দাদার পেশা আঁকড়ে ধরে অতি কষ্টে জীবনযাপন করছেন। অনেকে জেলে পেশা ছেড়ে অন্য পেশার দিকে ঝুঁকেছেন। যমুনা নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনলে তারা ফের আগের পেশায় ফিরে আসবেন। তাদের জীবন-জীবিকার স্বার্থে নদী খনন করা জরুরি হয়ে পড়েছে।