আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ১৬-০২-২০২০ তারিখে পত্রিকা

মশায় বাড়ছে ডেঙ্গুর ভয়

রিয়াজ উদ্দীন
| প্রথম পাতা

- গেলবারের তুলনায় প্রকোপ বেশি হতে পারে 

- নিধন কার্যক্রমের পাশাপাশি সচেতন হতে হবে নাগরিকদেরও

-ডিএনসিসির নতুন আনা যন্ত্র বিকল

শীত কমছে। প্রকৃতির উত্তাপ বাড়ছে। সেই সঙ্গে রাজধানীতে বাড়ছে মশার উপদ্রব। এ কারণে নগরবাসীর মনে ভর করছে ডেঙ্গুর ভয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিটি করপোরেশনের কার্যক্রমের পাশাপাশি নাগরিকদেরও সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই।

ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত রোগ। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা। আগে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে এ রোগের প্রাদুর্ভাব হলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার সারা বছরই ডেঙ্গু রোগ হতে পারে। এমনই আকার ধারণ করছে রোগটি। এবারের শীতেই এমন প্রমাণ পাওয়া গেছে। আগে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু হওয়ার ঘটনা ছিল না বললেই চলে। এবার জানুয়ারি মাসে রাজধানীতে এডিস মশার বেশ উপস্থিতি পাওয়া গেছে। গেল বছর জানুয়ারির তুলনায় এবার ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার রোগী পাঁচগুণ বেশি। এবার ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতেই শীতের প্রকোপ কমতে শুরু করেছে। ফলে তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে মশাও। ভুক্তভোগী নগরবাসী বলছেন, কোনোমতে দিন পার করলেও সন্ধ্যা থেকেই শুরু হয় মশার উপদ্রব। দুই সিটি করপোরেশন মশক নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা বললেও নগরবাসী বলছেন, এসব কার্যক্রম প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। 

মগবাজার এলাকার বাসিন্দা সাঈদ বলেন, ডেঙ্গু নিয়ে অনেক কথাবার্তা হওয়ার পর গেল বছর ওষুধ ছিটিয়েছিল সিটি করপোরেশন। এর ফলে কিছুদিন মশা কম ছিল। এরপর আর কোনো ওষুধ দিতে দেখিনি। এখন আবার বেড়েছে মশার উপদ্রব। সন্ধ্যার পর তো টেকাই দায়। একই অভিযোগ করেন মুদি দোকানি রবিউল। তিনি বলেন, আগে মশার ওষুধ ছিটিয়েছিল। এখন আর ছিটায় না। সপ্তাহ দুই মশার উৎপাত খুব বেড়েছে। সন্ধ্যার পর আমার দোকানে লোকজন দাঁড়াতে পারে না। উত্তরার আজমপুর কাঁচাবাজারের বাসিন্দা হাসান আলী বলেন, বিকালে কোথাও দাঁড়ালে মাথার ওপর মশা কিলবিল করে। এটা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৫০ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে। এখানে মশার ওষুধ ছিটাতে দেখিনি। 

বিমানবন্দর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় গিয়ে দেখা গেল পুরোনো পত্রিকা পুড়িয়ে ধোঁয়া তৈরি করছেন বাস কাউন্টারের দুই টিকিট বিক্রেতা। শাহ আলম নামে একজন বললেন, মশার হাত থেকে বাঁচতেই এ ধোঁয়ার ব্যবস্থা। কী পরিমাণ মশা সেটা বলে বোঝানো যাবে না। এইখানে জীবন্ত একজনকে এক ঘণ্টা রাখেন, দেখবেন মশা কামড়িয়ে তাকে মেরে ফেলবে। 

জানুয়ারিতেও এডিস মশা : শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ‘ডেঙ্গু সার্ভিলেন্স অ্যান্ড প্রেডিকশন প্রোজেক্ট’ এর আওতায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মশার উপস্থিতি নিয়ে গবেষণা করছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ। সেজন্য রাজধানীর বিভিন্ন এলাকাকে ছয়টি অঞ্চলে ভাগ করে জানুয়ারির ১ তারিখ থেকে মশার উপস্থিতি দেখা হচ্ছে। এ জরিপ চলবে দুই বছর। এ জরিপে দেখা যায়, জানুয়ারি মাসেও রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার উপস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ। জরিপ অনুযায়ী, জানুয়ারিতে দক্ষিণ সিটি এমশায় বাড়ছে ডেঙ্গুর

করপোরেশনের পরীবাগ ও শাহবাগ এলাকায় মশার ব্রুটো ইনডেক্স ছিল সবচেয়ে বেশিÑ ২৬ দশমিক ৬৭। এছাড়া লালমাটিয়া-মোহাম্মদপুরে ১০, গুলশান-বনানীতে শূন্য, বাসাবো-খিলগাঁওয়ে ১৩ দশমিক ৩৩, শাঁখারীবাজার ও পাটুয়াটুলীতে ১৩ দশমিক ৩৩ ছিল। ফেব্রুয়ারিতে এখন পর্যন্ত গুলশান-বনানী এবং লালমাটিয়া-মোহাম্মদপুর এ দুটি অঞ্চলের তথ্য নেওয়া হয়েছে। তাতে দেখা যায়, গুলশানে ব্রুটো ইনডেক্স বেড়ে ২০ হয়েছে। লালমাটিয়ায় কমে হয়েছে ৬ দশমিক ৬৭।
এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি হতে পারে : মশার লার্ভার উপস্থিতি হিসাব করা হয় ব্রুটো ইনডেক্সের মাধ্যমে। জরিপে প্রতি ১০০ প্রজনন উৎসের মধ্যে ২০টি বা তার বেশিতে যদি এডিস মশার লার্ভা বা পিউপা পাওয়া যায়, তাহলে সেটাকে ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতি বলা যায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলছেন, জানুয়ারিতে মশার এতটা উপস্থিতি ভালো কথা নয়। জানুয়ারিতে ব্রুটো ইনডেক্স পাঁচের নিচে থাকার কথা। এ সময় এটা হলে সামনের পরিস্থিতি অনুমেয়। গেল বছর জানুয়ারির চেয়ে এ বছর জানুয়ারিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যাও বেশি। তার মানে এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপও বেশি হতে পারে। 
২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন ৩৮ জন। আর এ বছর জানুয়ারিতে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৯৭ জন। আর ফেব্রুয়ারির প্রথম ১২ দিনে মোট ২২৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০১৯ সালে ডেঙ্গু এসেছে নানা রেকর্ড নিয়ে। ওই বছর সবচেয়ে বেশি ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আইইডিসিআর ২৬৩ জন মৃত্যুর তথ্য পাওয়ার পর তার মধ্যে ১৬৪ জনের মৃত্যু ডেঙ্গুর কারণে হয়েছে বলে নিশ্চিত করে। 
মশার উৎপাত নিয়ে নাগরিকের অভিযোগের বিষয়ে ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মমিনুর রহমান মামুন বলেন, কিউলেক্স মশার অন্যতম প্রজননস্থল সরু নর্দমাগুলোতে মশার ওষুধ ছিটানো যায় না। সেখানে কীভাবে কাজ করব সেটা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। বিভিন্ন সংস্থার জলাধারে কচুরিপানা আছে, যেগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি। আর এডিস মশার উপস্থিতিও যে আশঙ্কা জাগানোর মতো, তা স্বীকার করে মমিনুর রহমান মামুন বলেন, ব্রুটো ইনডেক্স ১০ এর বেশি হলেই আমরা বিষয়টি বিবেচনায় নিচ্ছি। গুলশানের মতো অভিজাত এলাকায় এডিস মশা বেশি হচ্ছে। কারণ এসব এলাকার বাসায় প্রচুর পরিমাণ ফুলের টব ও অন্যান্য জিনিস রয়েছে। সেখানে এডিস মশা জন্মাতে পারে। এছাড়া নির্মাণকাজও চলছে প্রচুর। তিনি বলেন, গেলবারও আমরা এসব এলাকায় এডিসের উপস্থিতি বেশি দেখেছি। আমাদের কার্যক্রম চলছে, তবে পাশাপাশি বাসিন্দাদের সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই। তারা যদি সচেতন না হন তাহলে এডিসের প্রকোপ আমরা কমাতে পারব না। 
মশা মারতে আনা ডিএনসিসির নতুন যন্ত্র বিকল, কর্মসূচি : ডেঙ্গু নিয়ে নানা শঙ্কার মধ্যেই শনিবার থেকে ডিএনসিসিতে শুরু হয়েছে মশা নিধনে দুই সপ্তাহের বিশেষ কর্মসূচি। তবে সেই কর্মসূচির শুরুর দিনই তা নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন। মশা নিধনের নতুন এ যন্ত্রের নাম ভেহিকল মাউন্টেন। ডিএনসিসির মশক নির্মূলে বিশেষ অভিযানের শুরুর দিনই বিকল এটি। ফগার মেশিন ছাড়াও ভর দুপুরে মশা মারতে নতুন এ যন্ত্রটি নিয়ে আসা হয়েছে, কিন্তু একটিবারের জন্যও কাজ করেনি তা। ক্যামেরার বাইরে অনেক কর্মীর অভিযোগ অনেকেই এটি চালাতে পারেন না। তবে এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মমিনুর রহমান মামুন। তিনি বলেন, যাদের থেকে মেশিন কেনা হয়েছে তারা প্রশিক্ষণ দিয়ে গেছে। এছাড়া আমাদের ওয়ারেন্টি পিরিয়ড থাকায় তারাই সমস্যা ঠিক করে দেবে।
শীত কমতে না কমতেই নগরীতে বেড়েছে মশার উপদ্রব। তাই এবার আগেভাগেই এডিসসহ সব ধরনের মশার আধিক্য ঠেকাতে উত্তর সিটির এ বিশেষ মশা নিধন কার্যক্রম। তবে কার্যক্রম শুরু হয়েছে মূল সড়কে। মিরপুর ১৩ নম্বরে যে স্থানে এ নিধন কার্যক্রম তার ৪০ কদম দূরেই মিরপুর বাগানবাড়ি খাল। এলাকাবাসী বলছেন, মশা মারা হয় শুধুই ভদ্র পল্লীতে। গেল বছরের মতো এবারও যাতে এডিস মশার কামড়ে মরতে না হয় সেই দাবি নগরবাসীর।