বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অভিনেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য তাপস পাল আর নেই। মঙ্গলবার ভোরে এই অভিনেতা মুম্বাইয়ের একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৬১ বছর।
বাংলা ছবিতে তিনি ছিলেন যেন সেই পরিচিত পাশের বাড়ির ছেলে। আজও বাঙালি দর্শক বারবার সেই ‘দাদার কীর্তি’র তাপসকে মনে করেন। সে ছবিতে প্রবল জনপ্রিয় হয়েছিল তার নিপাট ভালোমানুষি, যাকে হয়তো আমরা ‘বোকামি’ বলে পরিহাস করে থাকি। কিন্তু তা আজও প্রেমের বার্তা দিয়ে ফেরে। এখানেই বোধহয় তাপস পালের অভিনয়ের দক্ষতা। চিরঞ্জিত চক্রবর্তী বলেছিলেন, “তাপস পাল ‘দাদার কীর্তি’তে যে অভিনয় করেছেন তা আমি করতে পারতাম না।’’ ‘দাদার কীর্তি’র মতো ‘সাহেব’ ছবিতেও তিনি উজ্জ্বল। বারবার এমন চরিত্র নির্বাচন করছেন, যা বাংলার তথাকথিত ‘হিরোইজম’কে ভেঙে দিয়েছে। এ স্বাভাবিক সারল্যই ছিল তাপস পালের ইউএসপি। যে কারণে তার একের পর এক পারিবারিক ছবি হয়ে উঠেছিল তৎকালীন বাংলার ‘কমার্শিয়াল ছবি’। একদিকে নিপাট সারল্য অন্যদিকে ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছে বীরত্ব প্রদর্শন করে নায়িকাকে উদ্ধার। এমন বহু দৃশ্যে তিনি অভিনেতা থেকে স্টার হয়ে উঠেছিলেন। এ কমার্শিয়াল স্টারকে অভিনয়ের জন্য ডেকেছিলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের মতো পরিচালক। দর্শক দেখেছে ‘উত্তরা’ বা ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’ ছবিতে তার অসামান্য অভিনয়।
শুধু কি তাই? তার সহজিয়া অভিনয় তাকে আরব সাগরেও টেনে নিয়ে গিয়েছিল। ১৯৮৪-তে হীরেন নাগের ছবিতে তার বিপরীতে নায়িকা ছিলেন মাধুরী দীক্ষিত। রাখি গুলজারের সঙ্গেও অভিনয় করতে দেখা গেছে তাকে। কিন্তু তাপস পাল পুরোদস্তুর বাংলার অভিনেতা। কলকাতায় তরুণ মজুমদারের ডাকে মুম্বাই থেকে কলকাতা ফিরে এসে দেবশ্রী রায়ের সঙ্গে অভিনয় করেন ‘ভালবাসা ভালবাসা’ ছবিতে। ১৯৮৫-তে এই ছবি বক্স অফিসে বিপুল সাফল্য এনে দেয়। বাংলা ছবিতে তৈরি হয় দেবশ্রী-তাপস জুটি। একে একে বাড়তে থাকে ছবির তালিকা। যেমনÑ ‘অর্পণ’, ‘সুরের সাথী’, ‘সুরের আকাশে’, ‘নয়নমণি’, ‘চোখের আলোয়’, ‘তবু মনে রেখো’। তপন সিংহ থেকে অঞ্জন চৌধুরী, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় থেকে তরুণ মজুমদারÑ আশি থেকে নব্বই দশকের বাংলা চলচ্চিত্রের প্রেম, অভিমান, অনুরাগ এবং লড়াইয়ে বাঙালির সব আবেগের মিশেল সেই তাপস পাল।
পরবর্তীকালে দেবশ্রী পেরিয়ে শতাব্দীর সঙ্গে জুটি বাঁধেন এ নায়ক। হরনাথ চক্রবর্তী, তরুণ মজুমদারের হাত ধরে এই জুটির ম্যাজিক ক্লিক করে বক্স অফিসে। শুধু শতাব্দী বা দেবশ্রী নয়, ইন্দ্রানী হালদার থেকে রচনা ব্যানার্জির মতো অভিনেত্রীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন তিনি। দেবাদিত্যের ‘আটটা আটের বনগাঁ লোকাল’ ছবিতে শেষবারের মতো দেখা গিয়েছিল তাকে।
এক পর্যায়ে পথচলা শুরু হয় রুপালি পর্দার নায়ক থেকে সংসদের গ-িতে। ২০০৯ সালে মোড় ঘুরে যায় তাপস পালের অভিনেতা জীবনের। ওই বছর রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলের টিকিটে কৃষ্ণনগর থেকে জিতে সংসদ সদস্য হন তাপস পাল। নানা মন্তব্যকে ঘিরে বিতর্কেও জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে রোজভ্যালি কা-ে যুক্ত থাকার অভিযোগও ওঠে তার বিরুদ্ধে। তাকে গ্রেপ্তারও করে সিবিআই। শেষ পর্যন্ত অভিনয়ের চেনা জগতেও ফিরতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু অসুস্থতা তাকে সরিয়ে নিয়ে গেল সবার অলক্ষ্যে।
সামনেই দোল। বসন্তের মন কেমন করা হাওয়ায় ভরে গেছে শহর। ‘দাদার কীর্তি’র ‘কেদার’ আবার পথে নামবেন রং মাখতে। কিন্তু বাস্তব ‘কেদারের’ জীবনে ইতি টেনে দিল এই বসন্ত। সূত্র : আনন্দবাজার