বইমেলাকে ঘিরে প্রতি বছরই নতুন নতুন লেখকের সমাবেশ যেমন হয়, তেমনি নতুন নতুন প্রকাশকেরও আবির্ভাব হয় এ মেলার মাধ্যমে। নতুন ও পুরোনো লেখকরা তাদের বই প্রকাশের মূল সময় হিসেবে বছরের এ সময়টাকেই বেছে নেন। আর এর মাধ্যমে যেমন নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়, তেমনি বেকারত্বের অভিশাপ থেকেও মুক্তি পায় কর্মক্ষম অনেক শ্রমিক। পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক পসিংখ্যান মতে, প্রতি বছরই দেশে ৩০ লাখ নতুন শ্রমিক আসে কর্মক্ষেত্রে। কিন্তু তাদের কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করতে না পারলে বেকারত্বের সংখ্যা বেড়ে যায়। আর বেকারত্বের হার বেড়ে গেলে সমাজে মারামারি, হানাহানিসহ নানা অশান্তি বেড়ে যায়। একপর্যায়ে সামাজিক বিপর্যয় ঘটে। এ সামাজিক বিপর্যয় ঘটানো ঠেকাতে অর্থনীতির অন্যান্য খাতের মতো প্রকাশনা শিল্পও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মেলার পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দেশের অন্য খাতের মতো বইমেলার ওপরও প্রভাব পড়ে। কারণ, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে অর্থনৈতিক বিভিন্ন উপখাতের মতো বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান ও বইপ্রেমীদেরও সমাগম হয় বেশি হারে। আর এসবের পেছনে কাজ করে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। নতুন নতুন কর্মসংস্থানের মাধ্যমে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। আর ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে অর্থনীতির চাকা গতিশীল হয়, সমৃদ্ধি আনে দেশ ও জনগণের। অমর একুশে বইমেলা শুধু বইপ্রেমীদের জ্ঞানের খোরাকই মেটায় না, বই বিক্রেতা, প্রকাশক, ছাপাখানা, বই বাইন্ডিং ইত্যাদি খাতের সঙ্গে জড়িতদের কর্মেরও সংস্থান করে দেয়।
প্রকাশকদের কাক্সিক্ষত মাস এই ফেব্রুয়ারি। এ মাসকে ঘিরেই তাদের যত কর্মযজ্ঞ। ভালো লেখকদের লেখা পাওয়ার জন্য যেমন তাদের পেছনে ঘুরতে হয়, তেমনি নতুন নতুন লেখক সৃষ্টিরও প্রয়াস থাকে। কেননা, পৃথিবী পরিবর্তনশীল। প্রতিনিয়তই পরিবর্তন হচ্ছে পৃথিবী। সেই সঙ্গে পরিবর্তন হচ্ছে মানুষের রুচি ও আবেগের। পুরোনো লেখকদের লেখার পাশাপাশি নতুন লেখকদের লেখার আবেদন থাকে পাঠকদের কাছে। এ কারণেই প্রকাশকরা পুরোনো লেখকদের লেখা যেমন সংগ্রহ করে থাকেন, তেমনি নতুন লেখকদের লেখাও তারা সংগ্রহ করতে ব্যতিব্যস্ত থাকেন। এ মাসেই তাদের সারা বছরের কর্মকা-ের গুণগত মান যাচাই হয়। সর্বাধিক পাঠক যে প্রকাশকের বই কেনেন ওই প্রকাশকের মানদ- ততই বাড়ে। এদিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায়, ভালো লেখকদের অধিক বই কাটতির মাধ্যমে তারা যেমন অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য আনেন, তেমনি ভালো প্রকাশের বই অধিক বিক্রির মাধ্যমে ওই প্রকাশক অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হন। এ থেকে দেখা যায়, ভালো লেখকের পাশাপাশি ভালো প্রকাশক হওয়ারও প্রতিযোগিতা অর্থনৈতিক তাগিদেই থেকে যায়।
বর্তমানে প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছে কয়েক লাখ মানুষ। এর মধ্যে অন্যতম হলোÑ লেখক, প্রকাশক নিজে, টাইপরাইটার, কপি রিডার, ছাপাখানার টেকনিশিয়ান, ছাপাখানা থেকে ছাপা হওয়ার পর বই বাইন্ডিং করার জন্য বাইন্ডার ইত্যাদি খাত। প্রথমত লেখক লেখেন। কম্পোজিটর হাতের লেখাকে কম্পিউটারে কম্পোজ করেন। প্রচ্ছদশিল্পী (ক্ষেত্র বিশেষে অলঙ্করণ শিল্পীও যুক্ত হন) বইয়ের চরিত্র অনুযায়ী প্রচ্ছদ আঁকেন। প্রকাশক পা-ুলিপি ভেদে নির্ধারিত মাপে কাঠামো দাঁড় করান। কাগজে প্রিন্ট করার পর পা-ুলিপি যায় বানান সংশোধকের কাছে। লেখক-প্রকাশকের সম্মিলিত উদ্যোগে পা-ুলিপি ফাইনাল করা হলে প্রেসে যায়। বর্তমানে মুদ্রণশিল্পে এসেছে আধুনিক প্রযুক্তি। প্লেটের পরের স্তর ছাপাখানা। ছাপাখানার সঙ্গে ওতপ্রোত সম্পর্ক কাগজের। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন রকম কাগজই পাওয়া যায় বাজারে। লেখক ও প্রকাশকরা সামর্থ্য ও পছন্দ অনুযায়ী কাগজ বাছাই করেন।
বইমেলার অর্থনীতি নানাভাবে, বিভিন্ন দিকে বিস্তৃত। পরিবহন শ্রমিক-মজুররা দেখে বাড়তি টাকার মুখ। অন্যদিকে এ সময় বিজ্ঞাপনের ব্যবসাও থাকে রমরমা। দৈনিক পত্রিকা থেকে শুরু করে অনলাইন নিউজ পোর্টাল, বইমেলাকেন্দ্রিক বুলেটিনে ছাপা হয় কোটি কোটি টাকার বিজ্ঞাপন। এ বিজ্ঞাপন লেখক-প্রকাশক উভয়পক্ষই দিয়ে থাকেন। সংশ্লিষ্টরা চান, বইয়ের খবর সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে। ক্রেতা আকৃষ্ট করতে বিজ্ঞাপন একটি উল্লেখযোগ্য মাধ্যম। বইমেলায় প্রকাশিত বইগুলোই পরবর্তীকালে চলে যায় পুরোনো বইয়ের দোকানে। ঢাকার পল্টন, মিরপুর, নীলক্ষেত এলাকায় পুরোনো বইয়ের ব্যবসা সরগরম থাকে সারা বছরই।
মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও দিন দিন বেড়ে চলেছে। বাড়ছে বই ও বিক্রির পরিমাণও। বাংলা একাডেমির এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৯ সালে সর্বমোট ৮০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়া নানা ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকা- চলে। এর মধ্যে অন্যতম হলো স্টল নির্মাণ ও সাজসজ্জাকারীদের প্রতি বছরে একবার কর্মের সংস্থান হয়। খাবারের দোকান চলে সারা মাস। মেলা সহায়ক মেলা বসে। যেমন শিশুদের খেলনা, মহিলাদের সাজসজ্জার উপকরণ ইত্যাদি মেলাকে আরও অর্থবহ করে তোলে। এসব কর্মকা-ের সঙ্গে সরাসরি অর্থনৈতিক সম্পর্ক থাকে। সব মিলে বইমেলা পাঠক, লেখক-লেখিকাদের যেমন মিলন মেলায় পরিণত হয়, তেমনি অর্থনৈতিক দিক থেকেও এর সঙ্গে জড়িতরা লাভবান হন।
সেফাতুল করিম প্রান্ত
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়